ফিচার্ড লেখালেখি

এ আগুনের গুণ নেই ।।।। পুলক বড়ুয়া 

এ আগুনের গুণ নেই ।।।। পুলক বড়ুয়া 
 
এত আগুন কখনো দেখেনি বাংলাদেশ। দাউ দাউ করে পুড়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আমার একাত্তরের কথা মনে পড়ে। পঁচিশে মার্চ রাত্তির থেকে যে বাংলাদেশ পুড়তে শুরু কর।  সে আগুন অবশ্য লাগিয়েছিল পাক হানাদার বাহিনী। ওদের উদ্দেশ্যই ছিল বাংলাদেশকে পুড়িয়ে ছারখার করে ফেলা। তাই যে যেভাবে পারে, হত্যা, লুন্ঠন, অগ্নি সংযোগ, ধর্ষণ—সবই করেছে ওরা। এদেশকে কুক্ষিগত করার জন্যে। শেষ পর্যন্ত পারে নাই। আজকে যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তার মধ্যে নাশকতার আশঙ্কা করছেন অনেকেই। একেবারে অমূলক নয়। নানান পরিবেশ-পরিস্থিতি সে কথাই বলে দেয়। যদিও তা তদন্ত সাপেক্ষ। তার আগে হলফ করে বলা যায় না। এবং জনমনে এ নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠাও প্রচুর। 
 
অবাক হওয়ার মতো বিষয়, খোদ রাজধানীতেই গত দুইমাসের মধ্যে ২০টি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য মত, চলতি মাসের গত ১৭ দিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ১২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। তারিখগুলো লক্ষ্য করুন : ৪, ৬, ৮, ১১, ১৩, ১৪,১৫, ১৬, ১৭। এর মধ্যে কোনো কোনো তারিখে একসঙ্গে দুটি জায়গায় আগুন লাগে। আরও লক্ষ্য করুন, দুই দিন পর পর, তিন দিন পর, একের পর এক প্রতিদিন। আগুন জ্বলছে। এসবই চলমান এই এপ্রিলে । টি.এস.এলিয়ট তাঁর ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ কবিতায় বলেছিলেন, ‘এপ্রিল ইজ দ্যা ক্রুয়েলেস্ট মান্থ’। এ কাব্যগ্রন্থটি ছিল বিংশ শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ 
এবং আধুনিক কাব্যধারার একটি কেন্দ্রীয় কাজ। তো, 
 
জায়গাগুলো সব আপনারা চিনবেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছে, বঙ্গবাজার ও নিউ সুপার মার্কেট, বঙ্গবাজারের বরিশাল প্লাজা, উত্তরার বিজিবি মার্কেট ও বায়তুল মোকারম মার্কেট। বাকিগুলো লক্ষ্য করুন : কাকরাইলের ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতাল, চকবাজারে একটি সিরামিক গোডাউন, পুরান ঢাকার নবাবপুর সুরিটোলা মার্কেটের পাশে একটি টিনশেড গোডাউন, হাজারীবাগে ট্যানারি কারখানা, মিরপুরে একটি আবাসিক ভবনে এবং শেরেবাংলা নগরে বিএনপি বাজার বস্তি। মার্চেও পাই, একের পর এক—১, ৫, ৭, ২৭, ২৮ তারিখে। জায়গাগুলো তেমনি : গোপীবাগে একটি রিকশার গ্যারেজ পুড়ে ছাই, সায়েন্স ল্যাবের শিরিন ম্যানসন আবাস, গুলিস্তান বিআরটিসি বাস কাউন্টারের কাছে সিদ্দিক বাজার, মহাখালীর সাততলা বস্তি, মধ্যবাড্ডার ইউলুপের পোস্ট অফিস গলির একটি মিস্টির দোকান। ব্যস্ত রাজধানীতে আগুন যেন শশব্যস্ত হয়ে উঠল! কী সাংঘাতিক! মুহুর্মুহু! অগ্ন্যুৎসব!
 
শুধু তাই নয়। রাজধানীর বাইরেও—আশপাশ ছাড়িয়েও এ ঘটনা ঘটে চলেছে। নারায়ণগঞ্জে ওরিয়ন কারখানায়, রংপুরে মতিপ্লাজা মার্কেটে, বগুড়ার শিবগঞ্জে বস্তার গোডাউনে ও সিলেটের দক্ষিণ সুরমার কদমতলীতে ফলবাজারে।
 
এই যে একপলকে দেখতে পাচ্ছি—এসবই ইতোমধ্যে সংঘটিত ঘটনাচিত্র। এতে পণ্য ও অবকাঠামোগত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি চিন্তিত করেছে সরকার ও ব্যাবসায়ীদের। বিশেষত অবৈধ ও অপরিকল্পিত যে মার্কেটগুলো রয়েছে, তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই দুশ্চিন্তা উদয় হচ্ছে, সংগত কারণেই। এই মার্কেটগুলো দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান। ফায়ার সার্ভিসের হালনাগাদ তথ্য শুনলে বিস্মিত হবেন। শুধু ঢাকা অঞ্চলের ৫৮টি মার্কেট ঝুঁকির তালিকায়। রাজধানীর ৯টি অতিঝুঁকিপূর্ণ, ১৪টি মাঝারি আর ৩৫টি ঝুঁকিপূর্ণ। এবার দেখুন অতিঝুঁকিপূর্ণের তালিকায় কারা কারা : গাউছিয়া মার্কেট, রাজধানী সুপার মার্কেট, নিউ রাজধানী সুপার মার্কেট, ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট, চন্দ্রিমা সুপার মার্কেট ও নূর ম্যানশন। এ মুহূর্তে ঈদ বাজার, ঈদ মৌসুম। ফলে, সরকার, গোয়েন্দা নজরদারি, ফায়ার সার্ভিস, আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ, নিরাপত্তা কর্মী, প্রহরী, সিসি ক্যামেরা, মার্কেট কমিটি, ব্যাবসায়ী মহলসহ অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট সবাই নড়েচড়ে বসেছেন।  সময়টা খুব সাংঘাতিক। তাই। ব্যবসায়ীদের সারা বছরের একটা বড় ব্যাবসা হয়, এই সময়েই। এমনিতেই করোনাকালীন ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে—একটা দীর্ঘ সময় ব্যাবসায়ীরা মন্দাক্রান্ত। গভীর রাতে, ভোর রাতের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোয় বেশি রহস্যময়তার সৃষ্টি হয়েছে। তব, গাজীপুরের টঙ্গী বাজারের সবুরা মার্কেটে ব্যাবসায়ীরা ‘পরিকল্পিতভাবে’ আগুন দেওয়ার তথ্য খুঁজে পেয়েছেন। এ থেকে তাদের মন আরও আতঙ্কগ্রস্থ হয়েছে।  এখনো সার্বিক ঘটনাগুলো রহস্যাবৃত। তদন্তাধীন। প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যেই নয় কোটি টাকার অর্থ সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন। পবিত্র মাহে রমজান, ঈদুল ফিতর, ঈদের ছুটি—মানুষের চিরায়ত আবেগ-উচ্ছ্বাস—এই অবাঞ্চিত আতঙ্ককে পাশ কাটিয়ে, উজিয়ে, পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে চলেছে। আত্মবিশ্বাসে। আত্মমর্যাদাকে সমুন্নত রেখে। এ আগুন নিভবেই। জ্বলতে পারে না। 
 
কিন্তু, এখানেই শেষ নয়। এখানেই শেষ হলে হত। আরও একটি আগুন আছে। সেটা মানুষের মনের আগুন। সে আগুন জ্বলে মানুষের মনের মধ্যে। তাকে কে নেভাবে? কী করে নেভানো যায় আমি জানি না। মানুষের মনের ক্ষোভ। কেবল প্রকাশেই তার সাক্ষাৎ মেলে। এই ক্ষোভ সামাজিক, সাংসারিক, রাষ্ট্রিক, সাংস্কৃতিক, নৃতাত্ত্বিক, রাজনৈতিক, বৈশ্বিক, পরিবেশ-প্রতিবেশ, প্রাকৃতিক। আমরা দেখেছি মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সমাজে-সংসারে হানাহানি, জাতি ও গোষ্ঠীগত লড়াই, দেশে দেশে যুদ্ধ, অপসংস্কৃতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বৈশ্বিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত, পরিবেশ বিপর্যয় ইত্যাদি। কখনো ধিকিধিকি জ্বলে। কখনো ছাইচাপা আগুন। বহুদেশ এর দ্বারা আক্রান্ত। কখনো কোনোটা তীব্র হয়ে ওঠে।একেক সময় একেকটা। আমরাও কমবেশি এর মধ্য দিয়ে গেছি। যাচ্ছি। পার্থিব এই ঘটনা—সেটা বনভূমিতে সূর্যের প্রখর উত্তাপ থেকে দাবানলে পরিণত হতে পারে। পাথরে পাথরে ঘর্ষণে হতে পারে। মানুষে মানুষে মনোজগতে বা ভাবজগতে ও বস্তু নিচয়ে হয়। 
 
আমাদের দেশেও সম্প্রতি সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিমন্ডলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় দেখেছি। এরা অহেতুক কোনো কথা বলেন, বিতর্ক করতে ভালোবাসেন। মুশকিল হচ্ছে এ থেকে তিনি নিজে সমস্যায় আক্রান্ত হন। একই সঙ্গে দেশ-জাতি-সমাজ-রাষ্ট্রকেও জড়িয়ে ফেলেন, বিব্রত করেন, সংকটে ঠেলে দেন। প্রশাসনকে তখন হস্তক্ষেপ করতে হয়। এর উৎস সরকারি, বেসরকারি, সুশীল, পেশাজীবী বা যে কেউ হতে পারেন। আমরা দেখেছি। দেখছি। আরও দেখব!উদাহরণ টেনে লাভ নেই। খুব বেশি দূরে যেতে হবে না। অন্ততঃ স্বদেশেই, স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিটা দশকেই এই ঘটনা ঘটেছে। হোতারা কেউ নন। হয় দেশান্তরী হয়েছেন। নয় এখানে নানা অপঘাতের শিকার। অনেকে ভাইরাল হয়ে শুধু শুধু ‘বিখ্যাত’ হয়েছেন। বা আমরা ‘বিখ্যাত’ করেছি। কাজের কাজ কিছু হয়নি। ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতি ছাড়া। তবু, এসব থেকে আমরা কিছু শিখিনি। যথা পূর্বং তথা পরং। বরং, আকছার আজও ঘটছেই। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় নিজেকে খুঁজতে হবে। স্বরচিত বালখিল্যতা পরিহার করতে হবে। বুঝতে হবে, যে বিষয়ে কোনো কথা বলে লাভ নেই, তা নিয়ে বিড়ম্বনা কেন। স্পর্শকাতর এমন কিছু বিষয় আছে, তাতে আপনি হাত দিয়ে লাভ কী! দেশোদ্ধার করতে পারবেন? জাতিকে উদ্ধার করতে চান? তাহলে, কী চান? জনমনে প্রশ্ন জাগতেই পারে। মনগড়া কোনো কথা তো নয়ই—নিজের বা বৃহত্তর কোনো ভাবমূর্তি নষ্ট হয় মতো কাজ করার দরকার কী? সত্যিকারের পান্ডিত্য এক কথা আর উদ্দেশ্যমূলক উক্তি অন্য বিষয়। একদল মানুষকে বিভ্রান্ত করবেন না।। এবং দয়া করে, সবাইকে এক নিক্তিতে ওজন করার মতো ধোঁয়াশা ছড়াবেন না। মানুষের নির্মল-মানস- জগতকে সর্বনাশ করার মতো পরিস্থিতি কারও কাম্য নয়।
 
এ দুটি অতিসাম্প্রতিক অগ্ন্যুৎপাত-উৎপাত—এ মুহুর্তে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে লক্ষ্য করার মতো। বিষয়আশয়। ওপেন সিক্রেট বার্ণিং ইস্যু। কিন্তু, এ আগুনের কোনো গুণ নেই। নির্গুণ আগুন।
সংবাদটি শেয়ার করুন