১৭ এপ্রিল, ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসের সুবর্ণজয়ন্তী | বিদ্যুৎ ভৌমিক
১৭ এপ্রিল ২০২১ হল ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসের সুবর্ণজয়ন্তী। মহান স্বাধীনতার ৫০তম সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের পর আবির্ভূত হল ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসের সুবর্ণজয়ন্তী।
বাংলাদেশ ও বাঙালীর স্বাধীনতাসহ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম এবং এটি একটি অবিস্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার জেলার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অনুপসহিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে শপথ গ্রহণ করেছিল মুজিবনগর সরকার এবং মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে পঠিত হয়েছিল বাংলদেশের মহান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও দিকনির্দেশনা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার শপথ গ্রহণের পর স্থানটির নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। সেই থেকে ১৭ এপ্রিল দিনটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে পরিচিতি লাভ করে ‘ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস’ হিসেবে।আজ থেকে ৫০ বছর আগে ১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা এই দিনে হানাদার বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত বাঙালী জাতির আলোকবর্তিকা হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। রচিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস। নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেয় স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। আর স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হলো ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে অর্থাৎ বাংলার গণমানুষের সশস্ত্র প্রতিরোধের মাধ্যমে । নিজস্ব রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ভিত্তি তথা চূড়ান্ত লড়াই ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ থেকেই শুরু হয় । তাই ২৬ মার্চ হল বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা দিবস ।
১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে গ্রেফতার হওয়ার আগেই মহান স্বাধীনতার মহান স্হপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তৎকালীন ইপিআরের ওয়ারলেসের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দেন । এর তিন সপ্তাহ পর মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা নামে পরিচিত ঐ বিশাল আমবাগান এলাকাকেই পরে ‘মুজিবনগর’ নাম দিয়ে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করা হয়েছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাস্তবে রূপ দিতে বীরত্ব ও সাহসিকতার সহিত বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তৎকালীন আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ মুজিবনগরে একত্রিত হয়ে সরকার গঠন করেন । জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ও মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী এবং ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে মন্ত্রিসভার সদস্য করে স্বাধীন বাংলা অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠন করা হয়। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে করা হয় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। এ দিন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ ও অনুমোদন হয়। গ্রামবাসীর পাশাপাশি দেশি-বিদেশি শতাধিক সাংবাদিক এবং ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও আসেন। তাদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন তৎকালীন সৎসাহসী ব্রিটিশ সাংবাদিক মার্ক টালি ও পিটার হেস। আওয়ামী লীগের চিফ হুইপ দিনাজপুরের সংসদ সদস্য অধ্যাপক মো. ইউসুফ আলী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করান। সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল আবু উসমানীর পৌঁছাতে বিলম্ব হওয়ায় ক্যাপ্টেন মাহবুব উদ্দীন আহমেদ ইপিআর আনসারের একটি ছোট্ট দল নিয়ে নেতৃবৃন্দকে অভিবাদন জানান। অভিবাদন গ্রহণের পর স্থানীয় শিল্পীদের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।
মুজিবনগর সরকারের সকলেই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের বিশ্বস্হ সাথী ও ঘনিষ্ঠ সহচর । ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে মুজিবনগরে শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করেছিল। এদিন নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন দেশ-বিদেশের বহু বিখ্যাত সাংবাদিক । এ মুজিবনগর সরকারই শপথ গ্রহনের পর প্রথম ভারতসহ বিভিন্ন রায্ট্রের কাছে অবৈধ ও স্বৈরাচারী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বৈধ সরকারকে স্বীকৃতি ও সহযোগীতার আকুল আবেদন জানান । ঐতিহাসিক মুজিবনগরেই রচিত হয়েছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের ভিত্তি । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে প্রবাসী ‘মুজিবনগর সরকার’ বহু প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছিল । ১৯৭১ ভারতের সাহায্য ও সহযোগীতায় দীর্ঘ নয় মাসের নিরন্তর মুক্তির লড়াইয়ের পর ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকারের ঐকান্তিক ত্যাগ, তও্বাবধান ও আন্তরিক প্রচেয্ঠায় বিজয়ী হয় বাঙালী জাতি । এই মুজিবনগরে সরকারই ৯ মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয় এবং বাঙালী জাতি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছিল। অবশেষে ত্রিশ লাখ মানুষের জীবন ও দুলক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা চূড়ান্ত বিজয় সূচিত হলো একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে । বিশ্বের বুকে জন্ম নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ । বাংলাদেশে সহ বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস ভয়াবহ সংক্রমণের কারণে এবার দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা সম্ভব হবে না বাংলাদেশে । মুজিবনগর দিবসের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের জন্য কোভিড-১৯ পরিস্থিতি বিবেচনায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরের মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্রে ১৭ এপ্রিল সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে দিবসটির সূচনা করা হবে। সকাল সাড়ে ৯টায় মুজিবনগরের মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্রে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। এদিন সকাল ১০টায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর নেতৃত্বে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। দিবসের তাত্পর্য তুলে ধরে এ দিন সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে। বেতার ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াসমূহ বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে। বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতির জীবনে তথা স্বাধীনতাসহ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মুজিবনগর দিবসের তাৎপর্য, গুরুত্ব ও গভীরতা অপরিসীম । বাঙ্গালী জাতি ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসকে গর্বভরে স্মরণ করবে চিরদিন ।
সূত্র : বাংলদেশের সংবাদপত্র
১৭ এপ্রিল, ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসের সুবর্ণজয়ন্তী | বিদ্যুৎ ভৌমিক সাবেক অধ্যাপক লেখক ও সিবিএনএ’এর উপদেষ্টা। মন্ট্রিয়ল, ক্যানাডা, ১৭ এপ্রিল, ২০২১