সাহিত্য ও কবিতা

ওয়েনলক এজ

ওয়েনলক এজ

ওয়েনলক এজ

আমার মায়ের এক অবিবাহিত কাজিন ছিল। সে ছিল আমার মায়ের চেয়ে বয়সে অনেক ছোট।  সাধারণত প্রতি গ্রীষ্মে সে তার মা আন্ট নেল বট্সের সঙ্গে আমাদের খামারবাড়িতে আসত। তার নিজের নাম ছিল এরনি বট্স্। সে ছিল লম্বা, লাল বড় চৌকোনা মুখ ও ভালোমানুষি অভিব্যক্তিসম্পন্ন এক পুরুষ। তার সুন্দর কোঁকড়ানো চুল তার কপালের ওপর থেকে ঝুলত। তার হাত এবং হাতের নখ ছিল সাবানের মতোই পরিষ্কার। তার নিতম্ব ছিল খানিকটা মোটাসোটা। যখন সে আশপাশে থাকত না তখন তার জন্য আমার নিজস্ব একটা নাম ছিল- আর্নেস্ট বটম।

আন্ট নেল বটেসর মৃত্যুর পর এরনি আর আসত না, তবে ও সব সময় বড়দিনের কার্ড পাঠাত।

যখন আমি এরনি যে শহরে থাকে সেখানকার কলেজে ভর্তি হলাম ও আমাকে প্রতি রোববার সন্ধ্যায় ডিনারে নিয়ে যাওয়াটা একটা অভ্যাসে পরিণত করে তুলল। ও এটা করত কারণ আমি ছিলাম ওর আত্মীয়া- আমরা দুজন একত্রে সময় কাটাবার পক্ষে উপযুক্ত কি না, এটা ভাবা ওর পক্ষে অসম্ভব ছিল। এরনি সব সময় আমাকে একই জায়গায় নিয়ে যেত। একটা ভবনের দ্বিতীয় তলায় ওল্ড চেলসি নামের এক রেস্তোরাঁয়। হোটেলটা ছিল বেশ ব্যয়বহুল, সোজা ভাষায় বলতে গেলে তার সাধ্যের বাইরে কিন্তু আমি সেসব নিয়ে ভাবিত ছিলাম না। মফস্বলের মেয়ে হিসেবে আমার বিশ্বাস ছিল যেসব পুরুষেরা শহরে থাকে, প্রতিদিন একটা করে স্যুট পরে এবং এত পরিষ্কার নখ যাদের, তারা সাফল্যের এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তাদের জন্য এসব ব্যাপার খুব সাধারণ। আমি সব সময় খাবার তালিকার বিদেশি খাবারগুলোর জন্য অর্ডার করতাম। আমি পছন্দ করতে প্রচুর সময় নিতাম, যেন পাঁচ বছরের এক মেয়ে আইসক্রিমের ফ্লেভার বাছাই করার চেষ্টা করছে এবং এই ভরপেট খাবারের ক্ষতিপূরণ হিসাবে তার পরদিন সোমবার আমাকে সারা দিন উপোস করতে হতো ।

এরনির বয়স আমার বাবা হবার পক্ষে একটু কমই ছিল। আমি চাইতাম না আমার কলেজের কেউ আমাদের একসঙ্গে দেখুক এবং ভাবুক যে সে আমার বয়ফ্রেন্ড।

সে আমার কোর্স সম্পর্কে খোঁজখবর নিত এবং যখন আমি তাকে বলতাম বা স্মরণ করিয়ে দিতাম যে আমি ইংরেজি ও দর্শনে স্নাতক, তখন সে বিষণ্নভাবে মাথা নাড়াত। সে আমাকে বলত, তার শিক্ষার প্রতি প্রচণ্ড শ্রদ্ধা রয়েছে এবং দুঃখ প্রকাশ করত মাধ্যমিকের পর লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য তার ছিল না। পরিবর্তে সে কানাডিয়ান রেলওয়েতে টিকিট বিক্রির কাজ নিয়েছিল এবং এখন সে সুপারভাইজার।

পড়ার বিষয় থেকে আলোচনা অন্য দিকে ঘোরাতে আমি তাকে আমার থাকার ঘর সম্পর্কে বলতাম। সেই সময়ে কলেজে কোনো ডরমিটরি ছিল না। আমরা সবাই মিলে ভাড়া বাসায় অথবা সস্তা অ্যাপার্টমেন্টে থাকতাম। আমার রুমটা ছিল একটা পুরোনো বাড়ির চিলেকোঠার ঘর। সেখানে প্রশস্ত মেঝে ছিল কিন্তু মেঝে থেকে ছাদের উচ্চতা খুব বেশি ছিল না। প্রাক্তন মেইডের ঘর হবার কারণে এটার নিজস্ব বাথরুম ছিল। আরো দুজন স্কলারশিপপ্রাপ্ত ছাত্রী যারা আধুনিক ভাষা বিষয়ে শেষ বর্ষে পড়ছিল, তারা দ্বিতীয় তলায় বাস করত। তাদের একজনের নাম ছিল ‘কে’ আর অন্যজন বেভারলি। নিচ তলায় বাস করত একজন মেডিকেল ছাত্র যে কদাচিৎ বাড়িতে থাকত আর তার স্ত্রী বেথ সব সময় বাসায় থাকত। কারণ, তার দুটি ছোট বাচ্চা ছিল। বেথ ছিল বাড়ির ম্যানেজার এবং ভাড়া সংগ্রহকারী। সে সব সময় দ্বিতীয় তলার মেয়েদের সঙ্গে বাথরুমে কাপড় কাচা এবং সেখানেই শুকানোর জন্য ঝুলিয়ে রাখা নিয়ে ঝগড়া করত। যখন বেথের স্বামী বাসায় থাকত তাকে কিছু সময় ওই বাথরুম ব্যবহার করতে হতো। কারণ, নিচেরটাতে শিশুদের সমস্ত কিছু থাকত। কে এবং বেভারলি দ্রুত উত্তর দিত যে বাসাভাড়া নেবার সময় বাথরুমটা তাদের একান্তই নিজেদের মতো করে ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল।

কে এবং বেভারলি আমার কাছে ছিল হতাশার মতো। তারা আধুনিক ভাষার ওপর অনেক খাটাখাটুনি করত কিন্তু তাদের কথাবার্তা এবং চিন্তাভাবনা ব্যাংক ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা মেয়েদের থেকে খুব বেশি আলাদা ছিল না। তারা তাদের চুল পিনকার্ল করত এবং শনিবারে হাতে নেল পলিশ লাগাত।

কারণ, ওই রাতে তাদের বিশেষ ছেলেবন্ধুদের সঙ্গে ডেট থাকত। তাদের ছেলেবন্ধুরা তাদের মুখে দাড়ি-গোঁফের যে আঁচড় রেখে যেত, তার থেকে পরিত্রাণ পেতে রোববারে তাদের মুখে লোশন লাগানো থাকত । আমার কাছে ছেলেবন্ধুর ব্যাপারটা একদম অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল এবং আমি অবাক হয়ে ভাবতাম ওরা কীভাবে পারে।

ওরা বলত যে ওদের মাথায় একসময় জাতিসংঘে দোভাষী হিসেবে কাজ করার মতো একটা পাগলামি আইডিয়া এসেছিল কিন্তু এখন ওরা বুঝতে পেরেছে যে ওরা স্কুলে পড়াবে এবং ভাগ্য ভালো হলে বিয়ে করবে। ওরা আমাকে অপ্রীতিকর সব উপদেশ দিত। কলেজ ক্যাফেটেরিয়াতে আমি একটা চাকরি পেয়েছিলাম। আমি একটা হাতে ঠেলা ট্রলিতে করে নোংরা থালাবাটি সংগ্রহ করতাম এবং টেবিল পরিষ্কার করতাম।

ওরা আমাকে সতর্ক করত এই বলে যে, এ কাজ কোনো ভালো কিছু নয়।

‘কেউ তোমাকে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যাবে না যদি তারা তোমাকে এই ধরনের কাজ করতে দেখে।’

আমি এরনিকে এটা বলেছিলাম এবং সে বলেছিল, ‘তুমি কি উত্তর দিয়েছিলে?’

আমি তাকে বলেছিলাম যে আমি এমন কারো সঙ্গে বাইরে যাব না, যার বিচারবুদ্ধি এমন, সুতরাং সমস্যাটা কোথায়?

আমি ঠিক জায়গাতেই আঘাত করেছিলাম এবং এরপর এরনি জ্বলে উঠেছিল।

‘একদম ঠিক,’ সে বলেছিল ‘এটাই একমাত্র দৃষ্টিভঙ্গি, যা গ্রহণ করা উচিত। সৎকর্ম। কখনো এমন কারো কথায় পাত্তা দিয়ো না যে তোমাকে তোমার সৎ উপার্জনের জন্য ছোট করে দেখবে। তাদের অগ্রাহ্য করে সামনে এগিয়ে যাও। তোমার আত্মমর্যাদা বজায় রাখ।

সে রাতে আমি যখন বাসায় ফিরলাম দরজার নিচে আমার জন্য বেথের একটা নোট ছিল, যেখানে লেখা ছিল সে আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়।

দুর্ভোগ আর বিভ্রান্তিকর দৃশ্যের মধ্যে দরজা খুলে গেল এবং বেথকে দেখে মনে হচ্ছিল তার সমস্ত দিন শেষ হয়ে গেছে। ভেজা কাপড়চোপড়, ডায়াপার এবং বাচ্চাদের উলের কাপড় ছাদের র‌্যাক থেকে ঝুলছিল। স্টোভের ওপর বোতল পানিতে ফুটানো হচ্ছিল জীবাণুমুক্ত করার জন্য। জানালার কাচ বাষ্পে ঢাকা ছিল, চেয়ারগুলো ছিল ভেজা কাপড় আর মাটি মাখানো খেলনাতে ঢাকা। বড় বাচ্চাটা ঘিরে রাখা একটা জায়গা থেকে মুক্ত হবার চেষ্টা করছিল এবং ছোটটি ছিল উঁচু চেয়ারের ওপর। তার মুখে ও থুতনিতে মিষ্টিকুমড়ার রঙের মতো ঘন ও নরম খাবার লেপ্টে ছিল, যেটাকে দেখাচ্ছিল র‌্যাশের মতো।

বেথ এসব থেকে মুখ তুলল এবং তার ছোট সমান মুখটাতে শ্রেষ্ঠত্বের শক্ত অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলল, যেন সে বলতে চায়, খুব কম লোকই এই দুঃস্বপ্নের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারত, যা সে পেরেছে। যদিও পৃথিবী তাকে সামান্যতম কৃতিত্ব দেবার মতো সদয় ছিল না।

‘তুমি জানো, তুমি যখন এসেছিলে’ তারপর সে তার গলাটাকে আরো ওপরে তুলল, যেন তা বড় বাচ্চাটার কান্না সত্ত্বেও শোনা যায়, ‘তুমি যখন আস তখন আমি বলেছিলাম ঘরটাতে দুজনের থাকার মতো পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে।’

সে আমাকে জানাল আমার সাথে থাকার জন্য আরেকটা মেয়ে আসছে। নতুন মেয়েটি মঙ্গলবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত থাকবে। সে কলেজে কিছু বিষয়ে কোর্স করতে এসেছে।

‘ব্লেক আজ রাতে বিছানা নিয়ে আসবে। মেয়েটি খুব বেশি জায়গা নেবে না। আমার মনে হয় না সে খুব বেশি কাপড় নিয়ে আসবে- সে শহরে থাকে। ছয় সপ্তাহ তুমি সম্পূর্ণ একা থেকেছ এবং ছুটির দিনগুলোতে তেমনটাই থাকবে।’

ভাড়া কমানোর ব্যাপারে কোনো কথা হলো না।

নিনা সত্যিকার অর্থেই খুব বেশি জায়গা নেয়নি। সে ছিল ছোটখাটো এবং চলাফেরায় বেশ সাবধানী। সে কখনো কড়িকাঠের সঙ্গে ধাক্কা খায়নি যেমনটা আমি খেতাম। সে অধিকাংশ সময় বিছানায় আড়াআড়িভাবে দুই পা রেখে বসে থাকত। তার বাদামি-সোনালি চুল তার মুখের ওপর থেকে ঝুলে থাকত। জাপানি কিমোনো বাচ্চাদের মতো করে তার সাদা অন্তর্বাসের ওপর পরা থাকত। তার চমৎকার সব কাপড় ছিল- উটের পশমের কোট, কাশ্মীরি সোয়েটার, রুপার পিনওয়ালা স্কার্ট।

কিন্তু যখনই সে তার কলেজ থেকে ফিরত সে তার পোশাক ছেড়ে কিমোনো পরত। আমিও পোশাক পরিবর্তন করতাম কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তা ছিল স্কার্ট এবং ব্লাউজ বা সোয়েটার। নিনা তার কাপড় যেখানে-সেখানে ছুড়ে দিত। কলেজে আমি আমার উপার্জনের অংশ হিসেবে আমার রাতের খাবার আগেই খেয়ে নিতাম এবং নিনাকে দেখে মনে হতো সেও খেয়ে নিয়েছে, যদিও আমি জানতাম না কোথা থেকে।

আমি তাকে জিজ্ঞাসা করতাম তার ওই পাতলা কিমোনোতে শীত লাগে না? ‘উম্হুম্-’ সে জবাব দিত এবং আমার হাত তার গলায় চেপে ধরে বলত, ‘আমি সব সময় গরম থাকি’। এবং সত্যিই সে সব সময় গরম থাকত। চামড়ার এই উষ্ণতার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল একটা নির্দিষ্ট গন্ধ, যা ছিল অনেকটা বাদাম বা মসলার মতো। তার শরীরের গন্ধ অপ্রীতিকর ছিল না কিন্তু নিয়মিত গোসল করা পরিষ্কার শরীরের গন্ধ এটা ছিল না।

আমি সাধারণত গভীর রাত পর্যন্ত পড়তাম। আমি ভেবেছিলাম রুমে কেউ থাকলে পড়তে বেশ অসুবিধা হবে কিন্তু নিনার উপস্থিতি ছিল বেশ সহজ। সে কমলা এবং চকোলেটের খোসা ছাড়িয়ে নিয়ে সলিটেয়ার খেলতে বসত। যখন তাকে একটা তাস সরাতে হতো তখন সে সামান্য শব্দ করত যেন সে তার শরীরের এই সামান্য নড়াচড়াতে অভিযোগ জানাচ্ছে কিন্তু সে এটাতে আনন্দ পেত এবং সব সময় এমনটাই করত। অন্যথায় সে ছিল সুখী এবং যখনই তার ঘুম পেত তখনই সে কুণ্ডলী পাকিয়ে লাইট জ্বালানো অবস্থাতে ঘুমিয়ে পড়ত। আমাদের কথা বলার বিশেষ কোনো প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু শীঘ্রই আমরা আমাদের জীবন সম্পর্কে কথা বলতে শুরু করলাম।

প্রথম সে গর্ভবতী হয়েছিল এবং বিয়ে করেছিল যাকে সে, তার চেয়ে বয়সে ছোট ছিল। সেটা ছিল শিকাগোর বাইরে কোনো একটা শহর। শহরের নাম ছিল লেনিভিল। এবং সেখানে কাজ বলতে ছিল ছেলেদের জন্য কর্ন এলিভেটর বা অন্যান্য যন্ত্রপাতি মেরামত করা এবং মেয়েদের জন্য বিভিন্ন স্টোরে কাজ করা। নিনার ইচ্ছে ছিল একজন হেয়ারড্রেসার হওয়া। কিন্তু এ জন্য তার বাইরে যাওয়া এবং এটা শেখার প্রয়োজন ছিল। নিনা সব সময় লেনিভিলেই থাকেনি। এখানে তার দাদি থাকত। সে তার দাদির সঙ্গে থাকত, কারণ তার বাবা মারা গেলে তার মা আবার বিয়ে করেছিল এবং তার সৎবাবা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল।

তার দ্বিতীয় সন্তান হলে তার স্বামী চাকুরির জন্য অন্য শহরে গেল। সে নিনার জন্য খরচ পাঠাতে চেয়েছিল কিন্তু সে কখনো তা পাঠায়নি। তাই নিনা তার দুই বাচ্চাকে তার দাদির কাছে রেখে শিকাগোগামী বাসে চেপেছিল।

বাসে তার মার্সি নামে এক মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেও তার মতো শিকাগো যাচ্ছিল। মার্সি একজনকে চিনত, যার ওখানে একটা হোটেল ছিল এবং মার্সি তাকে বলেছিল লোকটি তাদের কাজ দিতে পারবে। কিন্তু যখন তারা শিকাগো  পৌঁছাল এবং হোটেলটি খুঁজে বের করল, তারা দেখল, লোকটি ওই হোটেলের মালিক নয় বরং সে হোটেলের একজন কর্মচারী এবং কিছুদিন আগে সে তার চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। প্রকৃত মালিক তাদের উপরতলার খালি একটা রুমে থাকতে দিতে রাজি হলো এই শর্তে যে তারা প্রতিদিন জায়গাটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করবে। হোটেলে তাদের মেয়েদের ঘর ব্যবহার করতে হতো কিন্তু দিনের বেলা তারা সেখানে খুব বেশি সময় কাটাতে পারত না।

তারা রাস্তার অপর পাশে অবস্থিত বারের একজন লোকের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল- লোকটি ছিল বিচিত্র কিন্তু সুন্দর এবং সে তাদের বিনা পয়সায় জিন্জার এল পান করতে দিত। সেখানেই তাদের একজন লোকের সঙ্গে পরিচয় হয় এবং লোকটি তাদের একটা পার্টিতে যেতে বলে। তার পর থেকে তারা অন্যান্য পার্টিতেও ডাক পেতে থাকে এবং সেই সময়টাতেই মিস্টার পারভিসের সঙ্গে নিনার দেখা হয়। মিস্টার পারভিসই নিনার নাম ‘নিনা’ দিয়েছিল । তার আগে নিনার নাম ছিল জুন। সে শিকাগোতে মিস্টার পারভিসের বাসায় তার সঙ্গে থাকতে গিয়েছিল।

সে তার ছেলেদের ব্যাপারটা মিস্টার পারভিসের কাছে বলার আগে খানিকটা সময় নিয়েছিল। মিস্টার পারভিসের বাড়িতে অনেক জায়গা ছিল, তাই সে ভেবেছিল সেখানে তার ছেলেরা তার সঙ্গে অনায়াসে থাকতে পারবে। কিন্তু মিস্টার পারভিসকে যখন সে এ কথা জানাল সে বলল, সে একদম বাচ্চা পছন্দ করে না আর এ জন্য সে চায় না কখনো নিনা গর্ভবতী হোক। কিন্তু যেকোনোভাবে নিনা গর্ভবতী হয়ে পড়ল এবং মিস্টার পারভিস তাকে নিয়ে জাপানে গেল তার গর্ভপাত ঘটানোর জন্য।

একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিনা ভেবেছিল সে গর্ভপাত করাবে। কিন্তু তারপর সে ভাবল, না- সে আরো সামনে এগিয়ে যাবে এবং বাচ্চাটা নেবে।

‘ঠিক আছে’ মিস্টার পারভিস বলেছিল। মিস্টার পারভিস তাকে শিকাগো ফিরে যাবার খরচ দেবে কিন্তু তারপর তাকে নিজের পথ বেছে নিতে হবে।

নিনা ইতোমধ্যে নিজের পথ চিনে নিতে শিখেছে। সে একটা জায়গায় গেল, যেখানে তারা ওকে বাচ্চা না হওয়া পর্যন্ত দেখাশোনা করবে এবং বাচ্চাটাকে ওখানে লালনপালনের ব্যবস্থাও হবে। বাচ্চাটা জন্ম নিল। এটা ছিল একটা মেয়ে। নিনা তার নাম দিল জেমা এবং নিনা বাচ্চাটাকে নিজের সঙ্গে রাখবে বলে সিদ্ধান্ত নিল।

সে ওখানকার আরেকটা মেয়েকে চিনত, যার বাচ্চা হয়েছিল এবং সেও তার বাচ্চাকে নিজের কাছে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। নিনা মেয়েটির সঙ্গে একটা চুক্তি করল যে তারা একসঙ্গে থাকবে, শিফট অনুযায়ী কাজ করবে এবং বাচ্চা লালনপালন করবে। তারা তাদের সাধ্যের মধ্যে একটা বাসা নিল। নিনা চাকরি নিল একটা ককটেল লাউঞ্জে এবং সবকিছু ঠিকঠাক মতো চলছিল। জেমার বয়স যখন আট, তখন ক্রিসমাসের আগে নিনা বাড়িতে ফিরে দেখল অন্য মেয়েটি অর্ধেক মাতাল অবস্থায় এক পুরুষের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে। জ্বরে জেমার গা পুড়ে যাচ্ছিল। সে এতটাই অসুস্থ ছিল যে কাঁদতে পর্যন্ত পারছিল না।

নিনা তাকে কাপড়ে মুড়ে নিয়ে ক্যাবে করে হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হলো। ক্রিসমাসের কারণে রাস্তায় যানবাহন অনেক বেশি ছিল এবং অবশেষে যখন সে হাসপাতালে পৌঁছাল, তারা তাকে বলল এটা ভুল হাসপাতাল এবং তাকে অন্য একটা হাসপাতালে পাঠাল। পথের মাঝে জেমার কাঁপুনি ওঠে এবং সে মারা যায়।

নিনা জেমাকে সঠিকভাবে সমাহিত করতে চেয়েছিল। সে বাচ্চাটাকে ভিক্ষুকদের কবরস্থানে কিছু ভিক্ষুকের সঙ্গে রেখে আসতে চায়নি। তাই সে পারভিসের কাছে গেল। সে যতটুকু আশা করেছিল মিস্টার পারভিস তার থেকেও সদয় ছিল। সে কফিন এবং জেমার নামাঙ্কিত সমাধিফলকের খরচ দিয়েছিল এবং সবকিছু শেষ হবার পর সে আবার নিনাকে নিজের কাছে ফিরিয়ে নিয়েছিল। সে তাকে উৎফুল্ল করে তোলার জন্য লন্ডন, প্যারিস এবং আরো অন্যান্য জায়গায় বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফিরে তারা শিকাগোর বাড়ি বন্ধ করে এখানে চলে আসে। নিকটেই মিস্টার পারভিসের খানিকটা সম্পত্তি ছিল এবং তার কিছু রেসের ঘোড়া ছিল।

মিস্টার পারভিস তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল সে শিক্ষা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক কি না। নিনা জানাল, সে ইচ্ছুক। মিস্টার পারভিস তখন তাকে বিভিন্ন কোর্সে বসে পরীক্ষা করতে বলল যে সে আসলে কী পড়তে পছন্দ করবে। নিনা তাকে বলেছিল পড়ার সময়টা সে সাধারণ ছাত্রীরা যেভাবে কাটায় সেভাবে কাটাতে চায়।

নিনার জীবনকাহিনী শুনে আমার নিজেকে অনেক অনভিজ্ঞ লাগছিল।

আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম মিস্টার পারভিসের প্রথম নাম কী?

‘আর্থার’

‘তুমি তাকে এই নামে ডাকো না কেন?’

‘এটা ঠিক স্বাভাবিক শোনাবে না।’

নিনা সাধারণত রাতে বাইরে বের হতো না যদি না কলেজে বিশেষ অনুষ্ঠান যেমন কোনো নাটক, কনসার্ট অথবা কোনো বক্তৃতা থাকত । সে সাধারণত ক্যাফেটেরিয়াতে দুপুর ও রাতের খাবার খেত। নাশতা ছিল ঘরে বসে নেসক্যাফে এবং এক দিনের বাসি ডোনাট, যা আমি ক্যাফেটেরিয়া থেকে নিয়ে আসতাম। মিস্টার পারভিস এসব খাওয়া তেমন পছন্দ করত না। কিন্তু সে নিনার কলেজের ছাত্রীদের জীবনাচরণের অনুকরণ হিসেবে এটাকে মেনে নিয়েছিল।

‘তুমি যদি বাইরে যাও সে কীভাবে জানবে?’

নিনা দাঁড়াল। তার সেই অভিযোগ বা আনন্দের মৃদু শব্দ করে সে জানালার কাছে গেল। ‘এখানে এসো’ সে বলল ‘এবং পর্দার আড়ালে থাক, দেখতে পাচ্ছ?’

একটা কালো গাড়ি কয়েক ঘর পরে রাস্তায় দাঁড় করানো রয়েছে। রাস্তার আলোয় চালকের চকচকে সাদা চুল দেখা যাচ্ছে।

‘মিসেস উইনার,’ সে বলল ‘সে ওখানে থাকবে মাঝরাত পর্যন্ত, হয়তো তার পরেও, আমি জানি না। যদি আমি বাইরে যাই তাহলে সে আমাকে অনুসরণ করবে এবং আমি যেখানেই যাই আমার আশপাশে থাকবে এবং আবার আমাকে অনুসরণ করে ফিরে আসবে।’

‘সে যদি ঘুমিয়ে পড়ে তাহলে?’

‘সে ঘুমাবে না, আর যদি ঘুমিয়েও পড়ে এবং আমি যদি কিছু করার চেষ্টা করি, তাহলে সে ত্বরিত জেগে উঠবে।’

মিসেস উইনারের খানিকটা অনুশীলনের জন্য এক সন্ধ্যায় আমরা বাসা থেকে বের হলাম এবং সিটি লাইব্রেরির উদ্দেশে একটা বাসে উঠলাম। বাসের জানালা দিয়ে আমরা দেখছিলাম কালো গাড়িটা প্রতিটি বাস স্টপেজে থেমে খানিকটা অপেক্ষা করছে তারপর আবার স্পিড তুলে কিছুক্ষণ পর আমাদের বাসের পেছনে চলে আসছে। আমাদের লাইব্রেরিতে যেতে খানিকটা হাঁটতে হতো। মিসেস উইনার আমাদের অতিক্রম করে লাইব্রেরির সামনের দরজার দিকে গাড়িটা দাঁড় করাল এবং আমরা বুঝতে পারছিলাম গাড়ির রিয়ারভিউ আয়নায় সে আমাদের ওপর লক্ষ রাখছে।

আমি দেখতে চাইছিলাম ‘দ্যা স্কারলেট লেটার’ বইটা পাওয়া যায় কি না। বইটা আমার একটা কোর্সের জন্য খুব প্রয়োজনীয় ছিল। এটা কেনার সামর্থ্য আমার ছিল না এবং কলেজের সমস্ত কপি ধারে গিয়েছিল। আমি নিনার জন্যও একটা বই নিতে চাচ্ছিলাম, যাতে ইতিহাসের সরল একটা ধারাক্রম থাকবে।

নিনা যেসব কোর্স অডিট করছিল সেসব কোর্সের বই কিনেছিল। সে নোটবুক এবং কলম কিনেছিল কালার ম্যাচ করে। সে প্রতি লেকচারের সময় একদম পেছনের সারিতে বসত, কারণ সে ভাবত ওটাই তার উপযুক্ত জায়গা। সে এমনভাবে বলত যেন সে কলাভবনের ভেতর দিয়ে অন্যান্য ছাত্রছাত্রীর ভিড়ে হেঁটে যাওয়া, তার আসন খুঁজে পাওয়া, তার পাঠ্যবইয়ের নির্দিষ্ট পাতা এবং কলম বের করা সবকিছু উপভোগ করত। কিন্তু তার নোটবুক থাকত শূন্য।

সমস্যা হলো কোনো বিষয়ে আলোচনা চালাবার মতো কোনো অজুহাতই তার ছিল না। সে জানত না ভিক্টোরিয়ান অথবা রোম্যান্টিক অথবা প্রাক কলম্বিয়ান কী? সে জাপান, বারবাডোজ এবং ইউরোপের আরো অনেক দেশ ভ্রমণ করেছে কিন্তু সে একটা মানচিত্রে এই দেশগুলো খুঁজে বের করতে পারত না। সে এটাও জানত না যে ফরাসি বিপ্লব প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে নাকি পরে।

আমি ভেবে অবাক হতাম যে কীভাবে এই কোর্সগুলো ওর জন্য পছন্দ করা হলো। মিস্টার পারভিস কি ভেবেছিল যে ও এগুলোতে দক্ষ হবে অথবা ও এগুলো পছন্দ করেছে, যাতে করে ও শীঘ্রই ওর ছাত্রী হবার সাধ পূরণ করতে পারে।

যখন আমার বইগুলো খুঁজছিলাম আমি, এরনি বটসকে দেখলাম। আমি ওকে নিনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। আমি এরনিকে নিনার আমার সঙ্গে থাকার ব্যাপারটা বলেছিলাম কিন্তু ওর আগের বা এখনকার জীবন নিয়ে কিছু বলিনি।

এরনি নিনার সঙ্গে করমর্দন করল আর বলল যে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে খুশি হয়েছে এবং তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞেস করল যে সে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারে কি না?

আমি প্রায় বলেই ফেলেছিলাম, না, ধন্যবাদ, আমরা বাসে করে যাব। ঠিক তখনই নিনা তাকে জিজ্ঞাসা করল তার গাড়ি কোথায় রাখা?

‘পেছনে’ সে বলল।

‘পেছন দিকে কি কোনো দরজা আছে?’

‘হ্যাঁ, এটা একটা সেডান।’

‘না, আমি পাঠাগারের কথা বলছি’, নিনা বলল, ‘এই ভবনের পেছন দিকে কোনো দরজা আছে কি না?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ আছে।’ এরনি জবাব দিল নার্ভাসনেসের সঙ্গে, ‘আমি দুঃখিত, আমি ভেবেছিলাম আপনি কার কথা বলছেন, হ্যাঁ পাঠাগারের একটা  পেছন দরজা আছে। আমি নিজে সেই দরজা দিয়েই ঢুকেছি। আমি দুঃখিত। এরনি লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছিল। তারপর সে ক্ষমা প্রার্থনা করতেই থাকত যদি না নিনা ওর সহজ হাসিতে ফেটে পড়ত।

এরনি আমাদের বাসায় নিয়ে এল। সে জানতে চাইল আমরা তার বাড়িতে যেতে চাই কি না এক কাপ কফি খাওয়ার জন্য।

‘দুঃখিত, আমরা আসলে একটু তাড়ার মধ্যে আছি’ নিনা বলল, ‘কিন্তু বলার জন্য ধন্যবাদ।’

‘আমার মনে হয় আপনার হোমওয়ার্ক রয়েছে।’

‘হোমওয়ার্ক, হ্যাঁ’, ও বলল, ‘আমরা অবশ্যই হোমওয়ার্ক করি।’

আমি ভাবছিলাম এরনি কখনো আমাকে একবারের জন্যও তার বাসায় যেতে বলেনি। সদাচরণ। একটা মেয়ে, না। দুইটা মেয়ে, ঠিক আছে।

রাস্তার ওপর কোনো কালো গাড়ি ছিল না যখন, আমরা পরস্পরকে ধন্যবাদ ও শুভরাত্রি জানালাম। কিছুক্ষণের মধ্যে নিনার ফোন এল এবং নিচতলার ঘরে আমি ওকে বলতে শুনলাম, ‘আরে না, আমরা শুধু লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম একটা বই নিয়ে আসতে এবং সেখান থেকে বাসে সোজা বাসায় ফিরেছি। আমি ভালো আছি, সম্পূর্ণরূপেই ভালো আছি, নাইট, নাইট।’ মৃদু হাসিতে সে দুলতে দুলতে ওপর তলায় এল এবং বলল, মিসেস উইনার আজ রাতে বেশ সমস্যায় পড়েছে।

এক সকালে নিনা বিছানা ছেড়ে উঠল না। ও বলল, ওর গলাব্যথা এবং জ্বর। ‘আমাকে ছুঁয়ে দেখো।’

‘আমার কাছে সব সময় তোমাকে গরম মনে হয়।’

‘আজ আমি অন্য দিনের তুলনায় বেশি গরম।’

দিনটা ছিল শুক্রবার। সে আমাকে মিস্টার পারভিসকে কল করতে বলল এবং বলতে বলল সে ছুটির দিনগুলো এখানে কাটাতে চায়।

‘সে আমাকে এখানে থাকতে দেবে। সে অসুস্থ কাউকে তার আশপাশে সহ্য করতে পারে না- এ ব্যাপারে তার খানিকটা পাগলামি আছে।’

মিস্টার পারভিস ডাক্তার পাঠাতে চাইতে পারেন। এটা ভেবে নিনা আমাকে বলতে বলল তার শুধু বিশ্রামের প্রয়োজন এবং অবস্থা খারাপ হলে সে অথবা আমি তাকে ফোনে জানাব। মিস্টার পারভিস বলল, ‘ভালো কথা, তাহলে ওকে বোলো নিজের যত্ন নিতে।’ মিস্টার পারভিস আমাকে ধন্যবাদ দিল ফোন করার জন্য এবং নিনার একজন ভালো বন্ধু হবার জন্য। এবং তার পরই সে আমাকে জিজ্ঞাসা করল শনিবার রাতের খাবার তার সঙ্গে খেতে আপত্তি আছে কি না? নিনা এটাও আগেই ভেবেছিল।

‘যদি সে আগামীকাল রাতে তোমাকে যেতেই বলে তার সঙ্গে খাবার খেতে তাহলে তুমি যাবে না কেন? শনিবার রাতে সব সময় খাওয়ার জন্য ভালো কিছু থাকে- এটা বিশেষ কিছু।’

শনিবার ক্যাফেটেরিয়া বন্ধ থাকে। মিস্টার পারভিসের সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনা আমাকে একই সঙ্গে বিরক্ত এবং উৎসাহী করে তুলল।

সুতরাং আমি তার সঙ্গে খাবার খেতে যেতে রাজি হলাম। যখন আমি উপরতলায় ফিরে গেলাম আর নিনাকে বললাম, ‘আমি কী পরব? ‘এক্ষনি দুশ্চিন্তা কেন? আগামী রাতের আগ পর্যন্ত এটা হচ্ছে না।’

সত্যিকার অর্থেই আমি কেন দুশ্চিন্তা করছিলাম? আমার একটাই ভালো পোশাক ছিল, যেটা আমি কিনেছিলাম আমার স্কলারশিপের টাকা দিয়ে আমার সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পরার জন্য।

মিসেস উইনার আমাকে নিতে এল। তার চুল সাদা ছিল না বরং ছিল প্লাটিনামের মতো। তার চুলের রঙ তার কঠিন হৃদয়ের কথাই আমাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল। ভদ্রতার খাতিরে আমি তার পাশে বসার জন্য গাড়ির সামনের দরজা খুললাম কিন্তু সে তখনি গাড়ি থেকে নেমে আমার পাশে দাঁড়াল এবং আমার জন্য পেছনের দরজা খুলে দিল।

আমি ভেবেছিলাম মিস্টার পারভিস হয়তো কয়েক একর অনাবাদি জমির ওপর লনে ঘেরা শহরের উত্তরে কোনো একঘেয়ে বাড়িতে বাস করে। রেসের ঘোড়াগুলো সম্ভবত আমাকে এমনটা ভাবতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু তার পরিবর্তে আমরা মোটামুটি প্রশস্ত একটা রাস্তা ধরে শহরের পূর্ব দিকে যাচ্ছিলাম। আমরা অবশেষে উঁচু ঝোপের মধ্যে দিয়ে যাওয়া এক সংকীর্ণ পথে মোড় নিলাম এবং একটা বাড়ির সামনে থামলাম। বাড়িটা দেখে আমি নিশ্চিত হলাম এটা কংক্রিটের তৈরি সমতল ছাদের একটি আধুনিক বাড়ি। ক্রিসমাসের কোনো আলো সেখানে ছিল না। কোনো প্রকার আলোই ছিল না।

এমনকি মিস্টার পারভিসেরও কোনো চিহ্ন ছিল না। গাড়িটা গ্যারেজে ঢুকে গেল। আমরা এলিভেটরে করে একতলা ওপরে উঠলাম এবং একটা হলঘরে উপস্থিত হলাম। ঘরটা হালকা আলোয় ভরা ছিল আর আসবাবগুলো, যেমন কিছু চেয়ার, ছোট্ট একটা মসৃণ টেবিল, আয়না এবং ছোট গালিচা দিয়ে ঘরটাকে ড্রইংরুমের মতো করে সাজানো ছিল।

মিসেস উইনার আমাকে পথ দেখিয়ে হলঘরের একদিককার দরজা খুলে অন্য একটা ঘরে নিয়ে গেল। ঘরটিতে কোনো জানালা ছিল না। পরিবর্তে ঘরটিতে ছিল একটা বেঞ্চ, এবং কাপড় ঝোলানোর জন্য দেয়ালময় অনেক হুক। কাঠের মসৃণতা আর মেঝের কার্পেট বাদ দিলে ঘরটি ছিল অনেকটা স্কুলের পোশাক এবং ব্যাগ জমা রাখা ঘরের মতো। মিসেস উইনার বলল, ‘এখানে তুমি তোমার কাপড় ছাড়’।

আমি আমার দস্তানাটা খুলে আমার কোটের পকেটে ঢুকালাম। আমি আমার কোটটা হুকে ঝুলিয়ে দিলাম। মিসেস উইনার আমার সঙ্গেই ছিল। আমার পকেটে একটা চিরুনি ছিল এবং আমি আমার চুলগুলো ঠিকঠাক করতে চাইছিলাম কিন্তু মিসেস উইনারের সামনে নয়। আর ওখানে কোনো আয়নাও ছিল না।

‘এখন বাকি কাপড়,’ সে বলল।

আমি তার আদেশ মানার কোনো চেষ্টাই করলাম না। সে তখন নিস্পৃহ গলায় বলল, ‘আশা করি তুমি বাচ্চা নও।’

কিন্তু আমি ওখানে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মিসেস উইনার তখন আমাকে বলল, ‘তাহলে তুমি শুধু বইয়ের পোকা, এর বেশি কিছু তুমি নও’।

আমি বসে আমার জুতা খুলে ফেললাম। তারপর মোজা এবং তারপর আমার পোশাক খুলে ফেললাম। কিন্তু আমি তখনো পাতলা জামাতে ঢাকা ছিলাম। জামার মধ্যে হাত গলিয়ে আমি আমার ব্রার পেছন দিককার হুক খুলে দিলাম এবং তারপর কসরত করে এটা জামার ভেতর থেকে বের করে আনলাম। তারপর আমার প্যান্টি ও গার্টার বেল্ট সবকিছু খোলা হলে আমি ওগুলো মুড়ে একটি বল বানিয়ে আমার ব্রার নিচে লুকিয়ে রাখলাম। এরপর আমি আবার জুতা পরলাম।

‘খালি পা’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিসেস উইনার বলল। আমি যখন জুতো খুললাম তখন সে বলল ‘সম্পূর্ণ নগ্ন, তুমি কি শব্দটার অর্থ জানো?’

আমি তখন পাতলা জামাটা আমার মাথা গলিয়ে বাইরে বের করে নিলাম। এরপর সে আমাকে এক বোতল লোশন দিয়ে বলল, ‘এটা সারা শরীরে মেখে নাও।’

লোশনটার গন্ধ ছিল নিনার শরীরের গন্ধের মতো। আমি এর কিছুটা আমার হাতে ও কাঁধে মেখে নিলাম। আমার লোশন মাখা শেষ হলে আমরা ওই রুম থেকে বের হয়ে হলরুমে ঢুকলাম। আমি আয়না থেকে নিজের চোখ সরিয়ে রাখছিলাম। মিসেস উইনার আরেকটি দরজা খুলল এবং এই রুমটাতে আমি একাই ঢুকলাম।

আমি এটা ভাবিনি যে মিস্টার পারভিস আমার জন্য একইভাবে ন্যাংটো হয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবে এবং সে তেমনটি ছিলও না। সে পরেছিল গাঢ় নীল রঙের ব্লেজার, একটা সাদা শার্ট এবং এসকট স্কার্ফ। মিস্টার পারভিস আমার চেয়ে লম্বা ছিল না। সে ছিল চিকন এবং বুড়ো। তার মাথার অধিকাংশ স্থানে টাক পড়ে গিয়েছিল এবং হাসার সময় তার কপালে ভাঁজ পড়ছিল।

পোশাক খোলাটা ধর্ষণ বা অন্য কোনো ঘটনার শুরু হতে পারত।  কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তেমনটা ঘটেনি বরং এটা ছিল রাতের খাবারের প্রস্তাব। আমার নগ্ন হওয়াকে আমি আমার অন্য সব পাপকর্মের শুরুর ঘটনা হিসেবে না দেখে এটাকে আমার সাহসের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখতে চাইছিলাম। এবং সেই শব্দটা, যেটা আমাকে এটা করতে উত্তেজিত করে তুলেছে -‘বইয়ের পোকা’।

আমার বলতে ইচ্ছা করছিল আমার খোলা দাঁতের জন্য যেমন লজ্জিত নই তেমনি আমার নগ্নতার জন্যও লজ্জিত নই। অবশ্য এটা সত্য ছিল না। সত্য ঘটনা এই যে আমি খুব ঘামছিলাম কিন্তু সতীত্বহানির ভয়ে নয়।

মিস্টার পারভিস আমার সঙ্গে করমর্দন করল এবং আমার নগ্নতার ব্যাপারে ও কোনো সচেতনতা দেখাল না। সে বলল, নিনার বন্ধুর সঙ্গে মিলিত হতে পারাটা তার জন্য বেশ আনন্দের। ও এমনভাবে বলছিল যেন নিনা কাউকে স্কুল থেকে বাড়ি ধরে এনেছে। যেটা একদিক থেকে সত্যি ছিল। সে বলেছিল নিনার জন্য আমি ছিলাম অনুপ্রেরণা।

‘সে তোমার খুব প্রশংসা করে। নিশ্চয় তোমার খুব খিদে পেয়েছে? আমরা কি দেখব আমাদের জন্য কী খাবার সরবরাহ করা হয়েছে?’

সে খাবারের ঢাকনা খুলল আর আমাকে তুলে দিতে গেল। কর্নিশ হেন, কিশমিশ দিয়ে রাধা হলুদ ভাত, সবুজ মেটে রঙের আচার এবং গাঢ় লাল রঙের জ্যাম।

মিস্টার পারভিস আচার ও জ্যাম দেখিয়ে আমাকে বলল, ‘এগুলো খুব বেশি নিওনা’। সে আমাকে টেবিলে নিয়ে বসাল, তারপর সে নিজের জন্য খাবার নিয়ে টেবিলে এল।

টেবিলের ওপর পানির জগ এবং মদের বোতল রাখা ছিল। আমি পানি খেলাম। সে আমাকে তার ঘরে মদ পরিবেশন করে বলল, এটা পান করা বড় ধরনের পাপ বলে গণ্য হবে। আমি খানিকটা অখুশি হলাম। আমার আগে মদ খাওয়ার কোনো সুযোগ আসেনি। যখন আমি ও এরনি ওল্ড চেলসিতে যেতাম, সে সব সময় রোববারে মদ পরিবেশন না করা নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করত।

‘নিনা আমাকে বলেছে’ মিস্টার পারভিস বলল, ‘তুমি ইংরেজি দর্শন পড়ছ, কিন্তু আমার মনে হয় এটা হবে ইংরেজি ও দর্শন, আমি কি ঠিক? সারা ইতিহাসে নিশ্চিতভাবেই খুব বেশি মহৎ ইংরেজ দার্শনিক নেই।’

তার সতর্কবার্তা সত্ত্বেও আমি একদলা সবুজ আচার মুখে নিয়েছিলাম। তাই তার প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারলাম না। সে ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করছিল।

অবশেষে আমি বললাম, ‘আমরা গ্রিকদের দিয়ে শুরু করি’।

‘ও হ্যাঁ। গ্রিস। ভালো কথা। তো এখন পর্যন্ত তোমার প্রিয় গ্রিক দার্শনিক কে?’

তারপর কর্নিশ হেনের মাংস কীভাবে হাড় থেকে আলাদা করতে হয়, এ বিষয়ে একটা বক্তব্য দিয়ে মিস্টার পারভিস আবার বলল, ‘তোমার প্রিয় দার্শনিক?’

‘আমি কলেজে এখনো আমার প্রিয় দার্শনিক অবধি পৌঁছাতে পারিনি-  আমরা এখনো প্রাক সক্রেটিস দর্শন পড়ছি। আমার প্রিয় প্লেটো।’

‘প্লেটো তোমার প্রিয়। তাহলে বোঝা যাচ্ছে তুমি সিলেবাসে আটকে না থেকে নিজে নিজে সামনে এগিয়ে যাচ্ছ। প্লেটো। তুমি প্লেটোর ‘দ্য কেইভ পছন্দ করো?’

‘হ্যাঁ’

‘অবশ্যই ‘দ্যা কেইভ’ অনেক সুন্দর, তাই না?’

Sarakhon

যখন আমি বসে ছিলাম, আমার সবচেয়ে প্রকাশিত অংশ ছিল দৃষ্টির বাইরে। যদি আমার স্তনগুলো নিনার মতো ছোট ও সুন্দর হতো তবে আমি বেশ স্বচ্ছন্দ বোধ করতাম কিন্তু এগুলো ছিল বেশ বড়। এগুলোকে উজ্জ্বল আলোয় হকচকিত নিশাচর প্রাণীদের মতো লাগছিল। সে যখন কথা বলছিল আমি তার দিকে তাকাতে চাইছিলাম কিন্তু প্রতিবারই আমি নিজের অজান্তেই লজ্জ্বায় আক্রান্ত হচ্ছিলাম। যখন এমন হচ্ছিল আমি মিস্টার পারভিসের কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন লক্ষ করছিলাম। আরো অধিক শান্ত এবং সন্তুষ্ট যেন সে এইমাত্র খেলায় জেতা চালটা দিয়েছে। কিন্তু সে তারপরও সহজভাবে তার গ্রিস ভ্রমণের কথা আমাকে বলছিল। ডেলফি, দুর্গ, বিখ্যাত আলো, পেলোপনিসাস-এর হাড় এসব বিষয়ে সে বলেছিল।

‘এরপর আসছে ক্রীট এর কথা। তুমি কি মিনোয়ান সভ্যতা সম্পর্কে জানো?’

‘হ্যাঁ।’

‘অবশ্যই তুমি জানো। এবং তুমি নিশ্চয় জানো মিনোয়ান মেয়েরা কীভাবে পোশাক পরত?’

‘হ্যাঁ।’

আমি এবার তার মুখের দিকে তাকালাম এবং তার চোখে চোখ রাখলাম। আমি তার চোখ থেকে চোখ না সরিয়ে নেবার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম।

‘মিনোয়ান মেয়েদের ওই স্টাইলটা বেশ সুন্দর ছিল’ মিস্টার পারভিস বেশ দুঃখের সঙ্গেই বলল, ‘এটা বেশ অদ্ভুত, বিভিন্ন যুগে ঢেকে রাখা এবং দেখানোর বিষয় ভিন্ন ভিন্ন ছিল।’

ডিজার্ট ছিল ভ্যানিলা কাস্টার্ড এবং ক্রিম। মিস্টার পারভিস সামান্যই মুখে দিল। আমার অস্বস্তির জন্য আমি প্রথমের খাবারগুলো তেমন উপভোগ করতে পারিনি, তাই এগুলো আমি মিস করতে চাইছিলাম না।

মিস্টার পারভিস ছোট কাপে কফি ঢালল এবং তার লাইব্রেরিতে বসে কফি পান করার আমন্ত্রণ জানাল।

আমি যখন চেয়ার ছেড়ে উঠতে গেলাম আমার নিতম্ব থেকে চাপড়ানোর মতো একটা শব্দ বের হলো। কিন্তু মিস্টার পারভিসের কাঁপা হাতে ধরা ট্রের ওপর সুন্দর কফির কাপগুলোর টুংটাং আওয়াজে শব্দটা ঢাকা পড়ে গেল।

মিস্টার পারভিস আমার আগে আগে যাবার জন্য ভদ্রতাসূচক ক্ষমা প্রার্থনা করল। আমার কাছে এটা ছিল হাপ ছেড়ে বাঁচার মতো, কারণ আমি তাকে আমার পিঠ দেখাতে চাইছিলাম না। আমার কাছে মনে হতো শুধু আমার নয়, যেকোনো মানুষের পেছন দিকটাই জন্তুর মতো।

যখন আমি আমার নির্দেশিত চেয়ারে বসলাম, সে আমাকে আমার কফি দিল। খাবার ঘরের চেয়ারে বসা যতটা সোজা ছিল এখানে প্রকাশ্যে বসাটা তত সোজা ছিল না। খাবার ঘরের চেয়ারটা মসৃণ রেশম কাপড়ে ঢাকা ছিল কিন্তু এখানকারটা ঢাকা ছিল মোটা মখমলে, যেটা আমাকে খোঁচাচ্ছিল আর আমি ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়ে উঠছিলাম।

মিস্টার পারভিস শেলফ থেকে একটা বই টেনে বের করে কিছু একটা খোঁজার জন্য পাতা ওল্টাতে লাগল।

‘এটা বেশ ভালো হয় তুমি যদি এটা আমাকে পড়ে শোনাও। সন্ধ্যায় আমার চোখ বেশ ক্লান্ত হয়ে থাকে। তুমি এই বইটা চেন?’

“A Shropshire Lad”

আমি এটা পড়েছিলাম এবং সত্যিটা হলো এর অনেক কবিতাই আমার মুখস্থ ছিল।

‘আমি তোমাকে অনুরোধ করতে পারি তোমার পাগুলো আড়াআড়ি না রাখার ব্যাপারে?’

যখন আমি তার কাছ থেকে বই নিলাম, আমার হাত কাঁপছিল।

সে বুককেসের সামনে একটা চেয়ার টেনে আমার মুখোমুখি বসল।

‘এখন পড়ো।’

‘On Wenlock Edge the wood’s in trouble,’

পরিচিত শব্দ এবং ছন্দ আমাকে শান্ত করল। আমি ক্রমাগত আরো শান্তি অনুভব করছিলাম।

The gale, it plies the saplings double,
It blows so hard, ’twill soon be gone:
To-day the Roman and his trouble
Are ashes under Uricon.

ইউরিকন কোথায়? কে জানে?

আমি ভুলে যাইনি আমি কোথায় কার সঙ্গে কী অবস্থায় বসে ছিলাম। কিন্তু কবিতা আমাকে দূরে কোথাও নিয়ে যাচ্ছিল এবং আমি দার্শনিকতায় আক্রান্ত হচ্ছিলাম। হঠাৎ আমার মনে হলো, এক দিক দিয়ে এই পৃথিবীর সবাই নগ্ন। মিস্টার পারভিস নগ্ন যদিও সে কাপড় পরে ছিল। আমরা সবাই নগ্ন দুঃখী প্রাণী। ক্রমাগত আমি আরো কম লজ্জা অনুভব করছিলাম। আমি একটার পর একটা কবিতা পড়ে যাচ্ছিলাম এবং পাতার পর পাতা উল্টে যাচ্ছিলাম। আমার নিজের কাছেই নিজের কণ্ঠস্বর অনেক ভালো লাগছিল। আরো চমৎকার সব কবিতা সামনে ছিল। ঠিক তখনি আমাকে খানিকটা বিস্মিত ও অসন্তুষ্ট করে মিস্টার পারভিস আমাকে থামিয়ে দিল। সে উঠে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

‘ব্যস ব্যস, খুব সুন্দর ছিল, তোমার আঞ্চলিক উচ্চারণ বেশ সুন্দর ছিল। ধন্যবাদ। কিন্তু আমার ঘুমের সময় হয়েছে।’

আমি তাকে বইটা হস্তান্তর করলাম। সে এটা শেলফে আগের জায়গায় রাখল এবং কাচের দরজা বন্ধ করল।

‘আঞ্চলিক উচ্চারণটা আমার জন্য নতুন ছিল। আমার মনে হয় এখন সময় হয়েছে তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবার।’

আমরা আবার বড় হলঘরটাতে ঢুকলাম। আমি তাকে ডিনারের জন্য ধন্যবাদ জানালাম। সে বুড়ো ভাঙা ও নিস্পৃহ গলায় কিছু শুকনো শব্দ বলল এবং তারপর অন্য একটা দরজা খুলে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। সে আমাকে একবারের জন্য সামান্য স্পর্শ করেও দেখেনি।

সেই একই রুম, যেখানে আমি আমার পোশাক ছেড়ে গিয়েছিলাম। আমি যখন মোজা পরছিলাম তখন মিসেস উইনার এল। আমি সবকিছু পরে যখন বের হব, তখন সে বলল, ‘তুমি তোমার স্কার্ফ ভুলে গেছ।’

আমি যখন গাড়ি থেকে নামলাম মিসেস উইনার বলল, ‘মিস্টার পারভিস ঘুমোতে যাবার আগে নিনার সঙ্গে কথা বলবেন। তুমি তাকে কথাটা বোলো।’

কিন্তু এই খবর দেবার জন্য নিনাকে আমি পেলাম না। তার কোট ও বুট উধাও। তার কিছু কাপড় তখনো দেয়ালে ঝুলছিল।

কে ও বেভারলি উভয়েই সাপ্তাহিক ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিল। এ ব্যাপারে বেথ সাহায্য করতে পারবে ভেবে আমি দৌড়ে নিচতলায় গেলাম। কিন্তু বেথ বলল, ‘দুঃখিত , আমি তোমাদের যাওয়া-আসার ব্যাপারে নজরদারি করি না।’ যখন আমি ঘরে ফেরার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছি তখন সে বলল, ‘তোমাকে ইতোপূর্বে বেশ কয়েকবার বলেছি সিঁড়িতে বেশি শব্দ না করতে, আমি এইমাত্র ক্রিস্টোফারকে ঘুম পাড়িয়েছি।’

মিস্টার পারভিসের ওখান থেকে ফেরার সময় আমি ঠিক করিনি আমি বাসায় ফিরে নিনাকে কি বলব? আমি কি তাকে জিজ্ঞাসা করব যে তাকেও ওই বাড়িতে নগ্ন হয়ে থাকতে হয় কি না- তাহলে সে অবশ্যই জানত কী ধরনের সন্ধ্যা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। অথবা আমি নিজে থেকে কিছুই বলব না, ওর জিজ্ঞাসা করার জন্য অপেক্ষা করব। অথবা জিজ্ঞেস করলেও আমি নিরীহভাবে বলব আমরা কর্নিশ হেন এবং হলুদ ভাত খেয়েছি এবং এটা খুব মজার ছিল। তারপর আমি ‘A Shropshire LadÕ’ থেকে পড়েছি।

এখন সে যেহেতু নেই এগুলোর কোনোটিই আর বলা হবে। মিসেস উইনার দশটার পর ফোন করল, যা বেথের আরেকটা নিয়মের লঙ্ঘন। আমি মিসেস উইনারকে যখন বললাম নিনা এখানে নেই, তখন সে আমাকে বলল, ‘আমি কি এ ব্যাপারে নিশ্চিত?’

আমি যখন তাকে আবার বললাম যে আমি জানি না সে কোথায় গেছে সে আবারও বলল, ‘আমি কি সত্যিই নিশ্চিত?’

আমি তাকে সকাল পর্যন্ত আর ফোন না করতে বললাম বেথের নিয়ম ও বাচ্চাদের ঘুমের জন্য। কিন্তু সে বলল, ‘আমি কথা দিতে পারছি না, কারণ ব্যাপারটা সিরিয়াস।’

আমি যখন সকালে ঘুম থেকে উঠলাম রাস্তায় কালো গাড়িটা দাঁড় করানো ছিল। কিছুক্ষণ পর মিসেস উইনার বেল বাজাল এবং বেথকে বলল তাকে পাঠানো হয়েছে নিনার ঘর চেক করার জন্য। বেথও মিসেস উইনারকে দেখে শান্ত হয়ে গিয়েছিল। মিসেস উইনার ঘর, বাথরুম, ক্লোসেট সব তন্ন তন্ন করে খুঁজল। এমনকি ক্লোসেটে রাখা ভাঁজ করা দুটো কম্বল মেলে দেখল।

আমি তখনো পাজামা পরে নেসক্যাফে পান করতে করতে স্যার গাওয়াইন এবং সবুজ নাইটদের ওপর একটা নিবন্ধ লিখছিলাম।

মিসেস উইনার বলল যে সে হাসপাতালে খোঁজ নিয়েছে যদি অসুস্থ অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং মিস্টার পারভিস নিজে বিভিন্ন জায়গায় তার খোঁজ করেছেন, যেসব জায়গায় সে যেতে পারে।

‘যদি তুমি কিছু জানো, তা আমাদের জানালে বেশ ভালো হবে, যেকোনো কিছু’ সে বলল।

তারপর যখন সে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছিল তখন বলল, ‘কলেজে এমন কেউ ছিল, যার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ছিল? এমন কাউকে তুমি চেন?’

আমি বললাম, আমার তেমনটা মনে হয় না।

বিকেলে তুষার পড়তে শুরু করল। যখন আমি বাথরুমে গিয়ে নিনার কিমোনো দেখলাম তখন আমি বুঝতে পারলাম নিনার জন্য কি রকম ভয় আমার মনের মধ্যে পুষে রেখেছি। হঠাৎ আমার মনে হলো বাইরে এই কনকনে ঠান্ডায় সে বরফের মধ্যে কোনো কোট ছাড়া শুধু সাদা অন্তর্বাস পরে বিভ্রান্ত হয়ে ঘুরছে। তার চুলগুলো খোলা আর চোখ ছিল জলে ভরা। যদিও আমি বেশ ভালোভাবেই জানতাম সে তার কোট নিয়ে গেছে।

সোমবার আমি যখন ক্লাস করার জন্য বাইরে বের হব, তখন ফোন এল।

‘আমি নিনা’ নিনার কণ্ঠে ছিল বিজয়ের উল্লাস ‘প্লিজ শোনো। তুমি কি আমাকে সাহায্য করতে পারো?’

‘তুমি কোথায়? ওরা তোমাকে খুঁজছে?’

‘কারা?’

‘মিস্টার পারভিস, মিসেস উইনার।’

‘ভালো কথা। তুমি ওদের কিছুই বলবে না। আমি যে এখানে আছি তুমি এটা ওদের কিছুতেই বোলো না।

‘কোথায় আছ তুমি?’

‘আর্নেস্ট এর কাছে।’

আর্নেস্ট মানে? এরনির ওখানে?

‘হুশ্শ্শ্শ্, কেউ কি ওখানে তোমাকে শুনছে?’

‘না।’

‘শোন, তুমি কী আমার বাকি জিনিসগুলো বাসে করে আমাকে পৌঁছে দিতে পারবে? আমার শ্যাম্পু দরকার, কিমোনোটাও দরকার। এখানে আমি আর্নেস্টের বাথরোব পরে ঘোরাঘুরি করি। তুমি ওর বাথরোবের মধ্যে আমাকে দেখলে ভাববে আমি একটা লোমওয়ালা বুড়ো বাদামি কুকুর। কারটা কি, এখনো বাইরে দাঁড়িয়ে আছে?’

আমি গিয়ে দেখে এলাম। ‘হ্যাঁ’

‘ঠিক আছে। তাহলে তুমি যেমন প্রতিদিন বাসে চেপে কলেজে যাও আজও তেমনটা যাবে। তারপর তুমি বাসে করে শহরের কেন্দ্রস্থলে আসবে। তুমি জানো কোথায় নামতে হবে। ডান্ডাস এন্ড রিচমন্ড। তারপর বাকিটুকু হেঁটে আসবে। ঠিকানাটা তুমি জানো, কার্লাইল স্ট্রিট, ৩৬৩।’

‘এরনি এখন কোথায়?’

‘ও কাজে বের হয়েছে। ওকে তো আমাদের ব্যয়ভার জোগাতে হবে, তাই না?’

নিনা আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল, ‘প্লিজ তুমিই আমার একমাত্র বন্ধু। আমার জন্য এটুকু কর।’

আমি নিনার নির্দেশনা অনুযায়ী মিসেস উইনারকে বোকা বানানোর জন্য নিনার জিনিসপত্র আমার ব্যাগে নিয়ে বাসে করে কলেজে এলাম। তারপর অন্য একটা বাসে করে ডান্ডাস এন্ড রিচমন্ড এবং সেখান থেকে কার্লাইল স্ট্রিট। তুষারপাত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, আকাশ ছিল পরিষ্কার এবং এটা ছিল বাতাসহীন খুব ঠাণ্ডা একটা দিন। উজ্জ্বল আলো আমার চোখে লাগছিল এবং পায়ের নিচে তুষার ক্যাচ ক্যাচ করছিল।

কার্লাইল স্ট্রিটের এক ব্লক উত্তরে ছিল সেই বাড়িটি, যেখানে এরনি তার মা-বাবার সঙ্গে থেকেছে, তারপর শুধু তার মায়ের সঙ্গে, তারপর একা এবং এখন (এটা কীভাবে সম্ভব?) নিনার সঙ্গে ।

এর আগেও আমি এই বাড়িতে একবার-দুবার আমার মায়ের সঙ্গে এসেছি। একচিলতে উঠোনসহ একটা ইটের বাংলো। বাড়িটা ঠিক আগের মতোই ছিল।

নিনা শেভিং ক্রিম ও লাইফবয় সাবানের গন্ধযুক্ত এরনির বাথরোবে মোড়া ছিল। সে আমার দস্তানার মধ্যে প্রায় জমে যাওয়া হাত আঁকড়ে ধরল।

‘জমে গেছে’ ও বলল, ‘এস তোমার হাতগুলো গরম পানিতে ডুবাতে হবে।’

সে আমার কাছ থেকে জিনিসপত্র নিয়ে রেখে আমাকে রান্নাঘরে নিয়ে গেল এবং এক গামলা গরম পানি দিল। খুব যন্ত্রণার সঙ্গে আমার আঙুলগুলোতে যখন আবার রক্ত ফিরে আসছে তখন ও আমাকে বলল, কীভাবে ও এরনির সঙ্গে এখানে এসেছে। আর্নেস্ট শনিবার রাতে আমাদের বাসায় গিয়েছিল। সে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে এসেছিল, যেটাতে ছিল প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ ও দুর্গের ছবি। ও ভেবেছিল এগুলো আমাকে আনন্দ দেবে। নিনা বিছানা ছেড়ে নিচতলায় গিয়েছিল, কারণ এরনি ওপরতলায় আসত না। যখন এরনি দেখল নিনা খুব অসুস্থ, তখন সে নিনাকে তার সঙ্গে তার বাসায় যেতে বলল, যাতে সে তার সেবা করতে পারে। এরনি এত ভালোভাবে নিনার যত্ন নিয়েছে যে ওর গলাব্যথা ও জ্বর সম্পূর্ণ সেরে গেছে। এবং তারপর ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিনা এরনির সঙ্গেই থাকবে এবং আগে যেখানে ছিল আর কখনো সেখানে ফিরে যাবে না।

এমনকি নিনা মিস্টার পারভিসের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করতে চাইছিল না।

‘কিন্তু এটা হবে অনেক গোপনীয় একটা ব্যাপার।’ সে বলল, ‘শুধু তুমিই জানবে, কারণ তুমি আমাদের বন্ধু আর তোমার জন্যই ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে।’

সে কফি বানাচ্ছিল। ‘ওদিকে দেখ’ ও আমাকে কাপবোর্ড দেখিয়ে বলল। ‘দেখ ও জিনিসপত্র কীভাবে রাখে, মগ এখানে, কাপ ওখানে। আসলে তোমার কারণেই আমাদের দেখা হলো’ ও আবারও কথাটা বলল। ‘যদি আমাদের মেয়ে হয় তাহলে তোমার নামে আমরা ওর নাম রাখব।’

‘তুমি কি বিয়ে করতে যাচ্ছ?’

‘বেশ-’

‘তুমি বলছিলে না তোমার যদি বাচ্চা হয়?’

‘বেশ – তুমি জান না, বিয়ে না করেও তো আমরা বাচ্চা নিতে পারি।’ নিনা দুষ্টুমির হাসি হেসে মাথা কাত করে বলল।

‘এরনির সঙ্গে? মিস্টার পারভিসের কী হবে?’

‘তার আবার কী?’

‘ভালো কথা। যদি সত্যি তোমার বাচ্চা হয় তাহলে সেটা মিস্টার পারভিসেরও হতে পারে।’

একথা শুনে নিনার সবকিছু পরিবর্তিত হয়ে গেল। তার মুখ কদর্য হয়ে উঠল। ‘ও?’ নিনা খানিকটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই বলল, ‘ওর সে ক্ষমতাই নেই।’

‘ও- তাহলে জেমার ব্যাপারটা কী?’

‘কেন তুমি অতীতের কথা তুলছ? আমাকে অসুস্থ করে দিয়ো না। অতীত এখন আমার কাছে মৃত। এখন আমার আর আর্নেস্টের কাছে ওসবের কোনো মূল্য নেই। আমরা এখন একত্রে আছি আর এক অপরকে ভালোবাসি।’

‘ঠিক আছে’ আমি বললাম।

‘দুঃখিত, আমি তোমার সঙ্গে উচ্চ স্বরে কথা বলেছি। আমি কি চিৎকার করেছি? আমি সত্যি দুঃখিত। তুমি আমার জিনিসপত্রগুলো নিয়ে এসেছ এবং আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। তুমি আর্নেস্টার আত্মীয় এবং আমাদের পরিবারের একজন।’

এরপর নিনা পরিবেশটা হালকা করার জন্য হঠাৎ আমার পেছনে এসে আমার বগলে আঙুল দিয়ে কাতুকুতু দিতে লাগল। প্রথমে আস্তে আস্তে এবং তারপর ভয়ানকভাবে।

আমি ওর হাত থেকে মুক্ত হতে চেষ্টা করছিলাম কিন্তু পারছিলাম না। হাসতে হাসতে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। এবং আমি ওকে মিনতি করছিলাম থামার জন্য। যখন সে আমাকে নিতান্ত অসহায় অবস্থায় দেখল, সে কাতুকুতু দেয়া বন্ধ করল।

‘তোমার মতো এত বেশি কাতুকুতু পেতে আমি কাউকে দেখিনি’ সে বলল।

ফেরার পথে আমাকে বাসের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল। অবশেষে যখন আমি কলেজে পৌঁছলাম আমার প্রথম ও দ্বিতীয় ক্লাস শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং ক্যাফেটেরিয়ার কাজেও আমি অনেক দেরি করে ফেলেছিলাম। ক্যাফেটেরিয়াতে কাজ করার জন্য আমি দ্রুত সবুজ পোশাক পরে নিলাম।

কে ও বেভারলির সাবধানবাণী সম্পর্কে আমি ভাবছিলাম। ওরা আমাকে বলেছিল আমি কোনো পুরুষের সঙ্গ পাব না যদি এখানে কাজ করি। ওরা আমাকে যখন এ কথা বলেছিল, আমি ওদের তাচ্ছিল্য করেছিলাম। কিন্তু ওরাই হয়তো ঠিক ছিল। মনে হচ্ছিল একমাত্র পড়ালেখা ছাড়া আমি অনেক ক্ষেত্রেই ভুল ছিলাম।

ক্যাফেটেরিয়ায় টেবিল পরিষ্কারের কাজ শেষ হলে আমি কাপড় পাল্টে কলেজ লাইব্রেরির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম আমার নিবন্ধটা নিয়ে কাজ করার জন্য। কলাভবন থেকে লাইব্রেরিতে যাবার জন্য একটা আন্ডারগ্রাউন্ড টানেল ছিল এবং এই টানেলে ঢোকার মুখেই নোটিশ বোর্ডে হোটেল, মুভি, ব্যবহৃত বাইসাইকেল ও টাইপরাইটার এমনকি নাটক ও কনসার্টের বিজ্ঞাপনও দেয়া থাকত। ওখানে মিউজিক ডিপার্টমেন্ট ইংরেজ আঞ্চলিক কবিদের কবিতা থেকে গান পরিবেশন প্রতিযোগিতার যে তারিখ ঘোষণা করেছিল, তা ইতোমধ্যে পার হয়ে গেছে। আমি এই নোটিশটা আগেও দেখেছি এবং এটাতে ছাপা নামগুলোর কথা মনে করার জন্য এটার দিকে আমাকে আর দ্বিতীয়বার তাকাতে হলো না : হেনরিক, হোসম্যান, টেনিসন। টানেলের মধ্যে কয়েক পা এগোতে কবিতার লাইনগুলো আমাকে আঘাত করতে লাগলো:

On Wenlock Edge the wood’s in trouble.

মিস্টার পারভিস কি জানত? সে কি জানত আমি ওই লাইনগুলোর কথা আমার নগ্ন নিতম্বে চেয়ারের কাভারের খোঁচার স্মৃতি ছাড়া আর কখনো ভাবতে পারব না? কী লজ্জা। সে সময়ের চেয়ে শত গুণ লজ্জা আমি এখন অনুভব করছিলাম।

আমি যা করেছিলাম তার জন্য আমাকে সব সময় স্মরণ করা হবে, যা করতে আমি সম্মত হয়েছিলাম। আমাকে জোর করা হয়নি, আদেশ করা হয়নি এমনকি আমাকে এটা করতে কেউ প্ররোচিত করেনি। আমি নিজেই এটা করতে রাজি হয়েছিলাম।

নিনা জানবে। সে এটা নিয়ে হাসাহাসি করবে। নির্দয়ভাবে না বরং সে অন্য আর দশটা ব্যাপারে যেভাবে হাসে, সেভাবেই। সে আমাকে সব সময় মনে রাখবে।

কলেজ লাইব্রেরি ছিল উঁচু সুন্দর একটা জায়গা। যেসব লোকেরা এটার নকশা করেছেন, এটা নির্মাণ করেছেন এবং এটার ব্যয়ভার বহন করেছেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন যারা এখানে লম্বা টেবিলগুলোতে খোলা বইয়ের সামনে বসবে, তাদের মাথার ওপর বিস্তর জায়গা প্রয়োজন, তাদের চারপাশে প্রয়োজন গাঢ় চকচকে কাঠের প্যানেল, আর প্রয়োজন উঁচু জানালা, যার ভেতর দিয়ে আকাশ দেখা যাবে। পেশা হিসেবে স্কুলের শিক্ষক অথবা ব্যবসায়ী অথবা অন্য কিছু অথবা সন্তান পালন করার আগের কয়েক বছর তাদের এই সুবিধাগুলো পাওয়া উচিত। এখন আমার পালা এবং আমি তা পাচ্ছিলাম।

‘স্যার গাওয়াইন এবং সবুজ নাইট’

আমি একটা চমৎকার নিবন্ধ লিখছিলাম। আমি সম্ভবত ‘এ’ পাব। আমি এসব লিখব এবং ‘এ’ পাব, কারণ এটাই আমি পারতাম। যে লোকেরা বৃত্তি দেয়, যারা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাঠাগার নির্মাণ করে তারা টাকা ব্যয় করতেই থাকবে, যাতে আমি এটা করতে পারি।

মিস্টার পারভিসের মতো লোকেরা।

তথাপি এই দানশীলতা আমাকে তাদের চোখে কোনো কিছুর সমান করে তোলেনি। আমি এখানে কী করছি, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমি এটা আগে জানতাম না। নিনা এখন তা জানে এবং সম্ভবত আগে থেকেই জানত। এরনিও। মিস্টার পারভিস এবং মিসেস উইনার। এমনকি বেথ, কে এবং বেভারলিও জানত যে কোথাও না কোথাও পা রাখার ঠাঁই পেতে হবে। এটা ছিল একটা খেলার মতো।

আমি শুধু অন্য রকম ভেবেছিলাম।

যেমন মিস্টার পারভিসের ঘটনাটা আমি একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম এবং আমি এটাতে জিতেছিলাম অথবা সমানে সমান ছিলাম।

‘সমান?’

নিনা এরনির সঙ্গে এক সপ্তাহও থাকেনি। একদিন এরনি বাড়ি ফিরে দেখে নিনা চলে গেছে। তার কোট, বুট, তার সুন্দর সব পোশাক এবং তার কিমোনো সব নিয়ে সে চলে গেছে। তার নরম চুল, তার চামড়ার অতিরিক্ত উষ্ণতা এবং তার সেই ছোট্ট আওয়াজ, যা সে নড়াচড়ার সময় করত- সবকিছু কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই উধাও হয়ে গেছে। সে চলে যাবার সময় কিছু লিখে রেখেও যায়নি।

আমাকে সংবাদটা জানাতে এবং রোববার রাতে ডিনারের জন্য আমাকে পাওয়া যাবে কি না- জানতে এরনি যখন ফোন করেছিল, তখন বলেছিল ও এমন কেউ নয় যে মুখ বুজে শোক করবে । আমরা যখন ওল্ড চেলসি-র সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলাম, তখন এরনি বলল, ক্রিসমাসের ছুটির আগে এটাই ছিল আমাদের শেষ রাতের খাবার। ও আমাকে কোট খুলতে সাহায্য করল আর আমি ঠিক তখনি নিনার শরীরের গন্ধ পেলাম। গন্ধটা কী এখনো এরনির শরীরে লেগে আছে?

না। গন্ধের উৎস জানা গেল যখন এরনি আমাকে একটা কিছু হস্তান্তর করল। বড় রুমালের মতো কিছু একটা।

‘এটা তোমার কোটের পকেটে রাখ’, ও বলল।

এটা কোনো রুমাল ছিল না। এটা ছিল পোশাকের নিচে পরার জন্য জামা।

‘আমি এটা রাখতে চাই না।’ ও বলল। ওর কথা শুনে মনে হতে পারে ও বোধ হয় কোনো অন্তর্বাস ওর কাছে রাখতে চায় না কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার ছিল ভিন্ন। এটার কারণ ছিল জামাটা ছিল নিনার আর ওটাতে নিনার শরীরের গন্ধ ছিল।

ও নিজের জন্য রোস্ট বিফ অর্ডার দিল। খাবার আসার পর ও স্বাভাবিক দক্ষতায় কেটে কেটে খেতে লাগল।

কিছু সময় পর এরনি বলল, ‘আমি লোকটার বাড়িতে গিয়েছিলাম, কিন্তু ওখানে কেউ ছিল না।’

‘কার বাড়ি?’

‘নিনার চাচার বাড়ি’ এরনি বলল। এরনি বাড়িটা চিনত, কারণ ও এবং নিনা অন্ধকারে বাড়িটার পাশ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে গেছিল। ‘এখন আর ওখানে কেউ থাকে না, ওরা সবকিছু গুটিয়ে চলে গেছে।’ আমি এরনির কথা শুনে অবাক হচ্ছিলাম। নিনা কি তবে মিস্টার পারভিসকে এরনির কাছে চাচা হিসেবে পরিচয় দিয়েছে?

এরনি বলল, ‘চলে যাবার ব্যাপারটা ঘটেছে ওর নিজের পছন্দে। মেয়েদের মন পরিবর্তন করাটা তাদের বিশেষ অধিকার।’

আমি যখন এরনির মুখের দিকে তাকালাম দেখলাম তার চোখের চারপাশ কালো এবং তার চোখে দেখলাম শুকনো ক্ষুধার্ত দৃষ্টি। সে মাঝে মাঝে চুপ হয়ে যাচ্ছিল তার ভেতরের কাঁপুনি সামলে নেবার জন্য, তারপর আবার কথা বলছিল।। সে চাইছিল সবদিক যাচাই করে ব্যাপারটা সম্পূর্ণরূপে বুঝতে।

‘টাকার জন্য ও যায়নি। ও গিয়েছে কারণ ওর চাচা বুড়ো এবং খানিকটা খ্যাপাটে এবং ওর মন ছিল খুব নরম। সবচেয়ে বড় ব্যাপার তিনি ওকে সেই ছোটবেলায় ওর বাবা মা মারা যাবার পর থেকে লালনপালন করে বড় করেছেন। আমি ওর চাচাকে এখানে আনলে আপত্তি করতাম না। এরনি বলল, ‘আমি যখন বাসায় ফিরলাম আর দেখলাম ও নেই- এটা ছিল আমার কাছে একটা আঘাতের মতো। আসলে বেশি কিছু আশা করা ঠিক নয়। আর সবকিছু নিজের ইচ্ছামতো ঘটেও না।’

আমি হোটেলেই নিনার জামাটা আমার কোটের পকেট থেকে বের করে ব্যবহার করা তোয়ালের মধ্যে মুড়িয়ে রাখলাম।

ওই দিন লাইব্রেরিতে আমি স্যার গাওয়াইনের ওপর নিবন্ধটা লেখার কাজে মনোযোগ দিতে পারলাম না। আমি আমার নোটবুক থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে কলমটা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। লাইব্রেরির বাইরে একটা পে ফোন ছিল এবং তার পাশে একটা ফোনবুক ঝুলছিল। আমি ফোনবুক দেখলাম এবং পাতাটাতে দুটি ঠিকানা লিখলাম।

১৬৪৮, হেনফ্রিন স্ট্রিট। অন্য ঠিকানাটা ছিল ৩৬৩, কার্লাইল স্ট্রিট।

আমি আবার টানেলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে কলাভবনের দিকে গেলাম এবং কমনরুমের পাশের ছোট দোকানটাতে ঢুকলাম। খাম এবং ডাকটিকিট কেনার মতো যথেষ্ট খুচরা পয়সা আমার পকেটে ছিল। আমি কার্লাইল স্ট্রিটের ঠিকানা লেখা অংশটা ছিঁড়ে সেটা খামের ভেতর ঢুকিয়ে দিলাম। আমি খামটা বন্ধ করে এর ওপর মিস্টার পারভিসের নাম ও হেনফ্রিন স্ট্রিট-এর ঠিকানাটা লিখলাম। তারপর লালা দিয়ে ডাকটিকিটটা খামের ওপর আটকে দিলাম।

ঠিক দোকানের বাইরেই ছিল একটা ডাকবাক্স। আমি ওটার ভেতর খামটা ফেলে দিলাম এবং আমি কলাভবনের সেই প্রশস্ত বারান্দাটাতে দাঁড়িয়ে ছিলাম, আমার পাশ দিয়ে যাওয়া ছাত্রছাত্রীরা কেউবা তাদের ক্লাসে যাচ্ছিল, কেউ ধূমপান করতে যাচ্ছিল আবার কেউ হয়তো কমনরুমে তাস খেলতে যাচ্ছিল।

এদের অধিকাংশই আমার মতো কোনো না কোনো কোর্সে ছিল।

আমি শিখতেই থাকলাম। আমি শিখলাম যে রোমান ক্যাম্প ইউরিকন  আসলে ইংল্যান্ডের সেভার্ন নদীর তীরে অবস্থিত রক্সিটার শহর।

ভাষান্তর: নুর উজ জামান

[ইংরেজিভাষী কানাডীয় কথাশিল্পী অ্যালিস অ্যান মানরো ২০১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। তিনি ১০ জুলাই, ১৯৩১ সালে কানাডার ওন্টারিও-তে জন্মগ্রহণ করেন। খুব অল্প বয়সে মানরোর লেখার হাতেখড়ি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তাঁর প্রথম গল্প ‘ডাইমেনশন অব শ্যাডো’ প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রথম গল্প সংগ্রহ প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে, যার জন্য তিনি গভর্নর জেনারেল পুরস্কার জেতেন। মানরোর লেখার ধরন ছোটগল্পের কাঠামোর ক্ষেত্রে একটা বিপ্লবের মতো। তিনি সাহিত্যে তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনবার কানাডার গভর্নর জেনারেল পুরস্কার পান। এ ছাড়া ২০০৯ সালে তিনি ম্যান বুকার পুরস্কারে ভূষিত হন। এখানে তার ‘Wenlock Edge’ গল্পটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হলো]

-সূত্রঃ সারাক্ষণ

এসএস/সিএ



সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন