জীবন ও স্বাস্থ্য ফিচার্ড

ডেল্টার দখলে জাপান, কিছু কথা ||| ড.  শোয়েব সাঈদ

ডেল্টার দখলে জাপান, কিছু কথা ||| ড.  শোয়েব সাঈদ

গত সতের মাসের কোভিড ব্যবস্থাপনায় মাস্ক সংস্কৃতির দেশ জাপানের সাফল্য বৈশ্বিক ঈর্ষা জাগাতেই পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে ডেল্টা সন্ত্রাসে জাপানীদের ঈর্ষনীয় সাফল্য খুব বাজেভাবে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ছে।

টোকিও এখন ব্যস্ত দর্শকবিহীন গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক নিয়ে। প্রচুর বিতর্ক  আর  জনমতের প্রবল বিরোধিতার মুখে হচ্ছে এই অলিম্পিক ১ বছর বিলম্বে। অলিম্পিকের বিশাল খরচের বিপরীতে  দর্শকবিহীন আয়োজনের অর্থনৈতিক দখল জাপানের মত ধনী দেশ সহ্য করতে পারলেও বিশ্বের অনেক দেশের পক্ষেই কোভিডাক্রান্ত অলিম্পিক কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক লোকসান সামলানো হয়তো  কঠিন ছিল।

অলিম্পিকের সাথে সাথে এই মুহূর্তে টোকিও দখল করে নিয়েছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট যার জনপ্রিয় পরিচিতি ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট নামে। অলিম্পিকের পর্দা ৮ই আগস্ট নামছে বটে কিন্তু ডেল্টার আগ্রাসন আপাতত থাকছে বলেই ধারণা।

দর্শকবিহীন অলিম্পিকের সাথে এই ডেল্টা আগ্রাসনের সংযোগ নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেকেই মনে করছেন দর্শকবিহীন অলিম্পিকে টোকিওতে জন চলাচলে কোন পরিবর্তন আসেনি এবং বিদেশী খেলোয়াড়, সংগঠক, আয়োজকরা নিরাপত্তার কঠিন স্তর পার হয়ে জাপানে প্রবেশ করায় সংক্রমণে তেমন প্রভাব নেই। এটি মূলত কমিউনিটি সংক্রমণ। কিন্তু কেন এই বিশাল সংক্রমণ ঢেউ?

গত সতের মাসে জাপানের করোনা পরিস্থিতি পর্যালোচনায় রোলার কোস্টারের মত গ্রাফের উঠা-নামায় দেখা যায় ছোট বড় মোট ৫টি ঢেউ আঘাত করেছে জাপানে।

১) ২০২০ সালের এপ্রিল-মেঃ দৈনিক সর্বোচ্চ সংক্রমণ ৭০০, মৃত্যু ৩০ জনের নীচে।

২) ২০২০ সালের জুলাই-আগস্টেঃ দৈনিক সর্বোচ্চ সংক্রমণ ১৬০০, মৃত্যু ২০ জনের নীচে।

৩) ২০২০-২১ সালের ডিসে-জানুঃ দৈনিক সর্বোচ্চ সংক্রমণ প্রায় ৮০০০, মৃত্যু ১২০ জনের মত।

৪) ২০২১ সালের এপ্রিল-মেঃ দৈনিক সর্বোচ্চ সংক্রমণ  প্রায় ৮০০০, মৃত্যু ১২০ জনের মত।

৫) ২০২১ সালের জুলাই-আগস্টেঃ দৈনিক সংক্রমণ ১৪০০০ ছাড়াচ্ছে, মৃত্যু ১৫ জনের মত।

কোভিড আমাদের সদা মানসিক চাপে রাখছে। মন্ট্রিয়ল থেকে খোঁজ রাখতে হচ্ছে ডেল্টার ভয়াবহ সংক্রমণে বাংলাদেশে কি হচ্ছে, আজকাল ফেসবুক যেন মৃত্যু উপত্যকা; শোক সংবাদের মুখপাত্র।

আমার ছেলেটি টোকিওতে চাকুরী করছে। জাপানে সংক্রমণের হঠাৎ ঊর্ধ্বগতি ভাবিত করে জাপানে বসবাসরত বিপুল সংখ্যায় কাছের মানুষদের সুস্থ থাকা নিয়ে।

জাপানে সংক্রমণের বর্তমান প্যাটার্নটি নিয়ে গত সতের মাসের কোভিড নিয়ে চর্চার অভিজ্ঞতায় ভাবছিলাম কেন এমন হচ্ছে? ভাবনাগুলো অনেকটা এরকমঃ

১) জাপানে থেমে থেমে এই ঢেউ নতুন কিছু নয়। মাস্ক সংস্কৃতি আর সরকারি ব্যবস্থাপনা মৌসুমি  প্রকোপের লাগাম বার বারই টেনে ধরতে পেরেছে।

২) উহানের আদি রূপের ভাইরাসটির চেয়ে ডেল্টার সংক্রমণ সক্ষমতা প্রায় দ্বিগুণ, ৩ জনের জায়গায় ৬ জনকে সংক্রমিত করছে। এই হিসেবে বিগত দুটো ঢেউয়ের চাইতে দ্বিগুণ শক্তিকে দৃশ্যমান ডেল্টার এই ঢেউ হয়তো অনিবার্য ছিল। সংক্রমণ, আগ্রাসন আর ভ্যাকসিন ফাঁকি দেবার এই তিনটি বিষয়ে চতুর এই ভ্যারিয়েন্টটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে এ যাবৎ উদ্বিগ্ন হবার মত ভ্যারিয়েন্টদের মধ্যে সবচেয়ে বিপদজনক।

৩) এখন দেখতে হবে জাপানে কোভিড ব্যবস্থাপনা এই ডেল্টার বিরুদ্ধে কতোটা কাজে দেয়। সফল হলে প্রকোপ কমে আসবে, না হলে ভিন্ন ধরণের কঠোর ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি টিকাদানে গতি আনতে হবে।

৪) টিকাদানে সফল পশ্চিমা দেশগুলোতে ডেল্টার এই আগ্রাসনকে বলা হচ্ছে “টিকা দেয় নাই মানুষদের মহামারি”। ডাবল ডোজ বা  সম্পূর্ণ টিকাদান ডেল্টার আগ্রাসনকে বেশ ভালভাবেই এখন পর্যন্ত মোকাবিলা করছে। ডেল্টার ভ্যাকসিন ফাঁকি দেবার প্রবণতা থাকলেও ডাবল ডোজ টিকার সেফটি জালে ব্যাপকভাবে প্রতিহত হচ্ছে।

৫) জাপানে এখন পর্যন্ত টিকা সম্পূর্ণ হয়েছে ৩৩% জনগোষ্ঠীর (সিঙ্গেল ডোজ ৪৬% এর)। অর্থাৎ টিকার বাইরে আছে ৬৭% জনগোষ্ঠী। ফাইজার, মডার্নার টিকায় ডাবল ডোজে ডেল্টায় পুনরায় সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকছে ২০%। ফলে ডেল্টা সংক্রমণে বিশাল হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে।

৬)এতসব মন খারাপের খবরের মাঝেও বিশাল সুখবর হচ্ছে ডাবল ডোজ টিকায় গুরুতর অসুস্থ হবার ঝুঁকি খুবই কম। ডেল্টার হাত থেকে বাঁচতে হলে  অতএব টিকা কর্মসূচির গতি বাড়াতে হবে। মাস্ক পরা আর স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে জাপানিদের সুনাম থাকায় টিকার গতি বাড়ার সাথে  সাথে ডেল্টার সন্ত্রাস কমে আসার কথা। ৭০% জনসংখ্যা ডাবল-ডোজের আওতায় চলে আসলে  পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। ডাবল-ডোজের টিকা স্বাস্থ্য খাতের উপর চাপ কমায় ব্যাপকভাবে।

৭) আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে এই মুহূর্তের ডেল্টা ঢেউয়ে মৃত্যুর সংখ্যা খুবই কম। হতে পারে তরুণরা বেশী সংক্রমিত হচ্ছে বলেই মৃত্যুর হার কম।

৮) বিপুল সংক্রমণের মাঝে গুরুতর অসুস্থ হওয়া বা মৃত্যুর সংখ্যা কম হওয়াতে অনেকেই বিপদের গুরুত্ব বুঝতে চান না। এতে পরিবারের সিনিয়র সদস্যরা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। প্রায় পৌনে চার কোটি মানুষের বৃহত্তর টোকিওতে সংক্রমণ ১০০০ ছাড়ালেই হৈচৈ হত আর এখন নীরবেই ৫০০০ এর কাছাকাছি হয়ে যাচ্ছে। অভ্যস্ততাজনিত নির্লিপ্ততা দিনশেষে ক্ষতিকর।

৮) ডেল্টা মোকাবিলায় বড় দায়িত্ব হচ্ছে বিপদের গুরুত্ব অনুধাবন করে নিজে বাঁচা/সুস্থ থাকা আর চারপাশের সবাইকে সুস্থ থাকতে, বাঁচতে নিজের দায়িত্বটুকু পালন করা। আশা করা যাচ্ছে  সেপ্টেম্বর নাগাদ জাপান পরিস্থিতি সামলাতে পারার তো কথা।

ডেল্টার দখলে জাপান, কিছু কথা ||| ড.  শোয়েব সাঈদ লেখকঃ কলামিস্ট এবং মাইক্রোবিয়াল বায়োটেকনোলজিস্ট। কানাডার একটি বহুজাতিক কর্পোরেটে  ডিরেক্টর পদে কর্মরত। 

 


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

 

সংবাদটি শেয়ার করুন