লেখালেখি

দুঃসহ সেই ২৪ ঘণ্টা ! ২১ আগস্ট যেভাবে সামলেছিলেন শেখ হাসিনা


দুঃসহ সেই ২৪ ঘণ্টা ! ২১ আগস্ট যেভাবে সামলেছিলেন শেখ হাসিনা | আবুল কালাম আজাদ

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট নৃশংস গ্রেনেড হামলার কথা মনে পড়লেই শরীর-মনজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কী ভয়াবহ দিনটাই না ছিল! চারদিকে রক্ত, বাঁচার জন্য আর্তচিৎকার, বীভৎস লাশের ছবি। আর সেই অবস্থার মধ্যে পরম করুণাময় মহান আল্লাহর মেহেরবানিতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রাণ রক্ষা। সেদিন নিজের জন্য একটুও চিন্তা না করে শুধুই নেতাকর্মীদের রক্ষায় বঙ্গবন্ধুকন্যার সে কী যে প্রাণান্তকর চেষ্টা, তা-ও মনে পড়ে। এখন নানা সংকটের মধ্যেও তাঁর সেই ভূমিকা থেকে প্রেরণা পাই দুঃসময়কে জয় করার। সুধা সদনে বসে নেত্রীর একটাই কথা ছিল, ‘তোমরা আমার কথা ভেবো না। আগে আমার আহত নেতাকর্মীদের বাঁচাও।’ দলের সুস্থ নেতাকর্মী, শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে এই একটাই ছিল তাঁর আর্তি।

সব সময় আমি সুধা সদনে সকাল ১০টা থেকে সোয়া ১০টার মধ্যে পৌঁছতাম। সেদিনও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সেখানে গিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করি। তারপর জাতীয় প্রেস ক্লাবে এসে দুপুরের খাবার খাই। হেঁটে ওসমানী উদ্যান হয়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে পৌঁঁছি পৌনে ৩টার দিকে। এখানে বিকেল ৪টায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার একটি সন্ত্রাসবিরোধী মিছিলের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা। সিলেটে বোমা হামলা, সারা দেশে মানুষ হত্যাসহ দলীয় কর্মীদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে এই মিছিলের আয়োজন করা হয়েছিল। ওই দিনের আবহাওয়া ছিল প্রচণ্ড গরম। সাংবাদিকদের সঙ্গে আমি ট্রাকের কাছেই ছিলাম। ওই ট্রাকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ জাতীয় নেতারা অবস্থান করছিলেন। ভিড়ের কারণে কিছুক্ষণ পর জায়গা পরিবর্তন করে সাংবাদিকদের সঙ্গে নিয়ে দোতলায় রমনা ভবনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। সেখান থেকে ট্রাকের অবস্থান ছিল খুব কাছে।

নেত্রী মিছিলপূর্ব সমাবেশে বক্তৃতা দিচ্ছেন। হঠাৎ বিস্ফোরণ। তারপর যে যার মতো ছোটাছুটি। এদিকে নেত্রীর চিন্তায় দৌড়ে নিচে নামতে গিয়ে দেখলাম ভবনের কলাপসিবল গেট বন্ধ। মোবাইল ফোনও কাজ করছে না। বের হতেও পারছি না। শেষ পর্যন্ত তালা খুললে রমনা ভবনের একটি দোকান থেকে সুধা সদনে ফোন করে জানলাম, নেত্রীকে বহনকারী গাড়িটি গুলিতে ক্ষতবিক্ষত হলেও শেষ পর্যন্ত তিনি নিরাপদে পৌঁছেছেন।

রমনা ভবন থেকে বের হয়ে দলীয় কার্যালয়ের সামনে যখন আসলাম, দেখলাম আহতদের আর্তচিৎকার। যে যেভাবে পারছে তাঁদের নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে ছুটছে। আমি কয়েকজন সাংবাদিককে সঙ্গে করে আহতদের নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দিকে ছুটলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম বিএনপিপন্থী সরকারি ডাক্তার ও নার্সরা চিকিৎসা না দিয়ে সব হাওয়া। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা রিকশা-ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহনে আহত নেতাকর্মীদের নিয়ে ছুটে আসছেন। খবর পেলাম, নেত্রী সুধা সদন থেকে সবার খোঁজখবর নিচ্ছেন। সবাইকে ফোন করে, আবার যাঁরা সুধা সদনে গিয়েছিলেন তাঁদের ঠেলে আহত নেতাকর্মী ও সাংবাদিকদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য পাঠাচ্ছেন।

এখানে (ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে) চুল ছোট একজনকে দেখে আমার সন্দেহ হলো। আমি তার ছবি তোলার জন্য একজন ফটো সাংবাদিককে ডেকে আনতে গেলাম। এক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এসে দেখলাম সে নেই। এখনো আমার মনে হয়, সেই ব্যক্তি হামলাকারীদের একজন। সেদিন যদি তার ছবি তুলতে পারতাম, তাহলে তার পরিচয়ও বের করা যেত। তাহলে হয়তো নৃশংস ওই গ্রেনেড হামলার গুরুত্বপূর্ণ আরো তথ্য পাওয়া যেত। কিন্তু তাকে না পেয়ে আবার নেত্রীর কথা মনে হওয়ায় দ্রুত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ত্যাগ করে সুধা সদনের পথে রওনা দিলাম।

সুধা সদনে পৌঁছে সোজা দোতলায় গিয়ে দেখলাম বিষণ্ন নেত্রীকে। তিনি নেতাকর্মীদের বারবার একটাই নির্দেশ দিচ্ছেন। ‘তোমরা আমার কথা ভেবো না। আগে আমার আহত নেতাকর্মীদের বাঁচাও। তাঁদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করো।’ তাঁর এই নির্দেশ পেয়ে সেখানে যাঁরাই যাচ্ছেন, আবার ফিরে আসছেন এবং ছুটছেন বিভিন্ন হাসপাতালে। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, সাংবাদিকদের কী অবস্থা? আমি যুগান্তরের ফটো সাংবাদিক এস এম গোর্কি ও চ্যানেল আইয়ের সাংবাদিক আশরাফুল আলম খোকনসহ আরো অনেকের আহত হওয়ার সংবাদ জানালাম। তিনি আর কোন কোন সাংবাদিক আহত হয়েছেন তার বিস্তারিত খোঁজখবর নিয়ে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বললেন। আরো বললেন, নেতাকর্মী ও সাংবাদিকদের উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন হলে বিদেশে পাঠাতে হবে। বিভিন্নজনের কাছ থেকে সংগ্রহ করে আহতদের চিকিৎসার জন্য টাকাও দিচ্ছিলেন তিনি। দেখলাম সেখানে তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা টিমের প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা) দাঁড়িয়ে। তাঁর পায়ে রক্ত। বঙ্গবন্ধুকন্যা বললেন, যাও আগে তুমি চিকিৎসা নাও। ওই দিন গভীর রাত পর্যন্ত আমি সুধা সদনে নেত্রীর পাশে থেকে তাঁর নির্দেশ মতো কখনো আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী আবার কখনো সাংবাদিকদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করছিলাম।

গভীর রাতে বাসায় ফিরে কিছুতেই ঘুম আসছিল না। একটা দুঃস্বপ্নের মতো কোনো রকম রাতটা কাটিয়ে পরের দিন খুব সকালে ছুটলাম সুধা সদনে। সেখানে গিয়ে আবার দেখলাম একই চিত্র। শুধুই নেতাকর্মীদের চিন্তা। কে কোথায় আছেন, ঠিকমতো চিকিৎসা হচ্ছে কি না সেই খোঁজ নিচ্ছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। আমার কাছে মনে হলো—নেত্রীর রাতটি কেটেছে নির্ঘুম। এদিকে ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা বলে গেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার শরীরের অবস্থা ভালো না। বিশেষ করে কানের। কিন্তু এ ধরনের শারীরিক অবস্থা সত্ত্বেও তিনি শুভাকাঙ্ক্ষী, দলের নেতাকর্মী, সাংবাদিক, আত্মীয়-স্বজন এবং ঢাকায় অবস্থানরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা দেখা করতে এলে তাঁদের সঙ্গে কথা বলছেন। নিজের কথা না ভেবে এভাবেই কাটল তাঁর পরের দিনটা। আমি নতুন করে দেখলাম আওয়ামী লীগ সভাপতিকে, মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন অসামান্য এক নারীকে। তিনিই আমাদের এই জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা। সূত্রঃ কালের কন্ঠ

লেখক : তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার প্রেস সচিব, বর্তমানে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

সংবাদটি শেয়ার করুন