মুক্তিযুদ্ধ

দুর্জয় বাংলা

দুর্জয় বাংলা
নির্মাণকাল : ১৯৯২ ভাস্কর : আমিনুল করিম দুলাল

দুর্জয় বাংলা

অসীম মণ্ডল, সিরাজগঞ্জ ।। জেলা শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে সিরাজগঞ্জ-বগুড়া মহাসড়ক। পাশে চণ্ডীদাসগাতিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য ‘দুর্জয় বাংলা’। এর উচ্চতা ২৮ ফুট। ত্রিকোণাকার বেদির ওপর মাছ ধরারটেঁটা হাতে দৃঢ় পায়ে দাঁড়িয়ে আছে ১০-১২ বছর বয়সী এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। তার পাশেই শক্ত মুঠিতে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা ধরে দৃপ্ত পদক্ষেপে দাঁড়িয়ে আছেন এক নারী মুক্তিযোদ্ধা। আরেক পাশে মাথায় গামছা, লুঙ্গি পরনের উদোম গায়ে পেশিবহুল এক যুবক মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর উদ্ধত ডান হাতে রাইফেল, বুকে বন্দুকের গুলিবোঝাই কার্তুজ।

নিচের দিকে বেদিতে শোভা পাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিপ্লবী সরকারের তথ্য অধিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত কয়েকটি পোস্টারের প্রতিচ্ছবি। আরেক পাশে রয়েছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ওপর আরো একটি পোস্টারের প্রতিচ্ছবি।

একাত্তরের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘তোমাদের যার কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো।’ তাঁর এই নির্দেশ বাস্তবায়নের পাশাপাশি বাংলার কৃষক-শ্রমিক, কামার, কুমার, তাঁতি, ছাত্র, শিক্ষক, রাজনীতিক আর নারীদের সরাসরি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সম্মিলিত প্রয়াসের চিত্র ফুটে উঠেছে এই ভাস্কর্যে।

চণ্ডিদাসগাতি বাজার সংলগ্ন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের স্কুল মাঠের এক প্রান্তে মহাসড়কের পাশে ১৯৯২ সালে নির্মাণ করা হয় এই ভাস্কর্য। গণস্বাস্থ্যের অর্থায়নে ২৬ জন শ্রমিকের প্রায় তিন মাস পরিশ্রমের ফসল এটি। বগুড়ার বিখ্যাত ভাস্কর্য শিল্পী আমিনুল করিম দুলাল আর তাঁর তিন সহযোগী এই ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন। স্টোন চিপসে সাদা সিমেন্ট দিয়ে নিরেট ঢালাইয়ের মাধ্যমে ভাস্কর্যটি তৈরি করা হয়।

ভাস্কর্যটি নির্মাণের অন্যতম উদ্যোক্তা তৎকালীন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র সিরাজগঞ্জের প্রকল্প উপদেষ্টা সাইফুল ইসলাম শিশির কালের কণ্ঠকে জানান, সে সময় একটি ভাস্কর্য বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়। এতে তৎকালীন সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসক জেড এম শফিকুল ইসলাম, পুলিশ সুপার মোখলেসুর রহমান, জেলা পরিষদ সচিব মশিউর রহমান, উপজেলা ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা ভীম চরণ রায় এবং তিনি নিজে এই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এ ছাড়া উপদেষ্টা কমিটিতে ছিলেন বিএনপি দলীয় তৎকালীন সংসদ সদস্য মির্জা মোরাদুজ্জামান, তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহার হোসেন তালুকদার ও জেলা জাসদের সভাপতি আব্দুল হাই তালুকদার। এর মধ্যে একমাত্র আব্দুল হাই তালুকদার জীবিত রয়েছেন, বাকি দুজন মারা গেছেন।

আব্দুল হাই তালুকদার কালের কণ্ঠকে জানান, এই শিল্পকর্মটির মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম বর্বরতা আর মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীকে রুখতে বাংলার সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার চিত্র ফুটে উঠেছে। ভাস্কর্যটি নতুন প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার প্রকৃত চিত্র জানাতে ভূমিকা রেখে চলেছে।

জানা গেছে, সোয়া ছয় লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই ভাস্কর্যটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই শিল্পকর্মটির স্থপতি আমিনুল করিম দুলাল মারা যান। সে সময়ে ভাস্কর্যের মুখের অবয়ব দেওয়া হয়নি। এরপর শিল্পী আমিনুল করিম দুলালের তিন সহযোগী এই ভাস্কর্যটির মুখের অবয়ব নির্মাণ করেন।

ভাস্করটিকে ঘিরে যে পোস্টারগুলো স্থাপন করা হয়েছে, তাতে রয়েছে বরেণ্য চিত্রশিল্পী পটুয়া কামরুল হাসানের ‘ওরা মানুষ হত্যা করছে, আসুন আমরা পশু হত্যা করি’ আর তাতে রয়েছে রক্তলোলুপ ইয়াহিয়া খানের ছবি। আরেকটি পোস্টারে শোভা পাচ্ছে ‘বাংলার কৃষক বাংলার শ্রমিক আজ সবাই মুক্তিযোদ্ধা’। আরেকটিতে রয়েছে গামছা মাথায় নারী মুক্তিযোদ্ধার শাশ্বত এক ছবি। বাংলার সাধারণ নারীরা শুধু মেডিক্যাল টিমে সেবা দিয়ে নয়, সম্মুখযুদ্ধেও থেকেছেন তৎপর। শুধু মমতা আর সেবা দিয়েই নয়, আটপৌরে শাড়িতে বাংলার গৃহবধূরাও পিছিয়ে ছিল না সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে। ভাষা আন্দোলন ঘিরে আরো একটি পোস্টার শোভা পাচ্ছে বেদির পেছন অংশে। এই পোস্টারটি জানান দিচ্ছে ভাষা আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

সিরাজগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের সভাপতি মামুনুর রশিদ মামুন কালের কণ্ঠকে জানান, প্রায় ৩০ বছর ধরে ভাস্কর্যটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করে চলেছে। তবে দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় তা কিছুটা ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে। তিনি নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানোর পাশাপাশি ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য ভাস্কর্যটি সংরক্ষণের দাবি জানান। সূত্রঃ কালের কন্ঠ


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

 

 

সংবাদটি শেয়ার করুন