দেশের সংবাদ ফিচার্ড

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে চাষাবাদের ঐতিহ্য

কমলগঞ্জের আদমপুর ইউনিয়নের কাটাবিল গ্রামে দেখা মেলে দরিদ্র কৃষক ছলিম মিয়ার (৬২), যিনি এখনও মহিষ দিয়ে হালচাষ করে প্রাচীন সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।

প্রযুক্তিতে হারিয়ে যাচ্ছে চাষাবাদের ঐতিহ্য

প্রযুক্তির কারণে বদলে যাচ্ছে চাষাবাদ পদ্ধতি। প্রত্যন্ত গ্রামেও এখন বিরল হয়ে পড়ছে গরু-মহিষ দিয়ে ধানচাষের চিত্র। প্রাচীন গ্রাম-বাংলার কৃষিকাজের প্রধান উপকরণ ছিল গরু-মহিষ, লাঙল-জোয়াল। কাকডাকা ভোরে কৃষকরা গরু-মহিষ ও লাঙল-জোয়াল কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন মাঠের জমিতে হালচাষ করতে। কিন্তু এ চিত্র এখন হারিয়ে যাচ্ছে। কালের পরিক্রমায় বিলুপ্তির পথে গরু দিয়ে হালচাষ। গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য গরু-লাঙলের সঙ্গে কৃষকের সেই মিতালির দৃশ্য এখন বিরল। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় দিন দিন নতুন যন্ত্র আবিষ্কারের ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে বাঙালির চিরচেনা সেই গরু-লাঙল দিয়ে জমি হালচাষের চিত্র। আর সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে গরু-মহিষ দিয়ে পাকা ধান মাড়াইয়ের চিত্রও।
এখন প্রযুক্তির ছোঁয়ায় হালচাষের পরিবর্তে ট্রাক্টর অথবা পাওয়ার টিলার দিয়ে অল্প সময়ে জমি চাষ করা হয়। কৃষিভিত্তিক প্রযুক্তি বদলে দিতে শুরু করেছে প্রাচীন কৃষি সংস্কৃতিকে।
এমন একটা সময় ছিল মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে গরু, মহিষ ও লাঙল দিয়ে জমি চাষ আর মই দেওয়ার দৃশ্য সবার নজর কাড়ত। বাড়ি থেকে বের হয়ে মাঠের দিকে নজর পড়তেই দেখা যেত কৃষক বাঁশের ফালা দিয়ে তৈরি করা ধারালো লাঙল কাঠের হাতল আর জোয়ালের মাধ্যমে গরুর কাঁধে বেঁধে দিয়ে জমি চাষ করছে। আর এখন গরু-লাঙলের স্থান দখল করে নিয়েছে ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলারসহ বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্রপাতি। এখন আর কৃষক কাকডাকা কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে জমি চাষ করতে মাঠে যায় না। কৃষক এখন তার সুবিধামতো দিনের যেকোনো সময় ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলার নিয়ে মাঠে গিয়ে অল্প সময়ে প্রয়োজনীয় জমি চাষ এবং মই দিয়ে ফসল আবাদ করে। তবে ওই ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলার দিয়ে জমি চাষে পরিশ্রম এবং সময় কমেছে সত্যই কিন্তু ফসলের গুণগত মান এবং স্বাদ আগের মতো নেই বললেই চলে। তা ছাড়া আধুনিক প্রযুক্তির বিভিন্ন ধরনের ধান মাড়াইয়ের যন্ত্র আবিষ্কার হওয়ায় এখন আর গরু-মহিষ দিয়ে ধান মাড়াই করতে হয় না কৃষকদের। এখন আর ধান মাড়াইয়ের সময় গরু-মহিষের পেছন পেছন চলা কিংবা গরু-মহিষকে ধান মাড়াইয়ে ঘোরানোর জন্য কৃষকের মধুর কণ্ঠে ‘হির-হির ও তি-তি’ শব্দও শোনা যায় না।
সম্প্রতি কমলগঞ্জের আদমপুর ইউনিয়নের কাটাবিল গ্রামে দেখা মেলে দরিদ্র কৃষক ছলিম মিয়ার (৬২), যিনি এখনও সেই প্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। একটি বেসরকারি এনজিও সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে কেনা মহিষ দিয়ে হালচাষ ও মাড়াইয়ের কাজ করেন তিনি।
দরিদ্র কৃষক ছলিম মিয়া জানান, যেসব কৃষক গরু দিয়ে হালচাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন কালক্রমে তারা পেশা বদল করে অন্য পেশায় চলে গেছেন। তবে এখনও গ্রামের কয়েকজন কৃষক জমি চাষের জন্য লাঙল-জোয়াল, গরু আর মই দিয়ে চাষ পদ্ধতি টিকিয়ে রেখেছেন।
তিনি বলেন, গ্রামীণ এই ঐতিহ্য ধরে রাখা এখন দুরূহ। কারণ মানুষ এখন সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে।
তিনি বলেন, ‘গরু দিয়ে হালচাষ করলে জমিতে ঘাস কম হতো, হালচাষ করার সময় গরুর গোবর সেই জমিতেই পড়ত। এতে করে জমিতে অনেক জৈব সার হতো, এ জন্য ফসলও ভালো হতো।’
তিনি জানান, এনজিও সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে একটি মহিষ কিনেছেন, সেটি দিয়েই হাল চাষ ও ধান মাড়াই করেন। কৃষক ছলিম মিয়ার দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। দুই ছেলে তাদের ছেড়ে আলাদা বসবাস করেন। ছেলেরা তাকে ভরণপোষণ না করায় বৃদ্ধ বয়সে নিজেই উপার্জন করে টানেন পরিবারের ঘানি। অভাবের সংসারে কষ্ট করে বিয়ে দিয়েছেন তিন মেয়েকেও। স্ত্রী ও এক নাতিকে নিয়ে এখন তার সংসার। বসতভিটার সাত শতক জায়গাটাও সরকারি ডিসি খতিয়ানের। চাষাবাদের জন্যও নিজের কোনো জমি নেই। অন্যের জমি বর্গা চাষ করেই খাদ্যের ব্যবস্থা করেন। তা ছাড়া মহিষ দিয়ে গ্রামের অন্যের জমিতে হালচাষ করে যা পান তা দিয়ে সংসারের অন্যান্য খরচের চাহিদা মেটান।
এসডিআর/বিডি
সংবাদটি শেয়ার করুন