ফিচার্ড লেখালেখি

প্রস্তুতি ।। নৈশব্দের পংক্তিমালা ।। ধারাবাহিক ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

প্রস্তুতি ।। নৈশব্দের পংক্তিমালা ।। ধারাবাহিক ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

দুলাভাই, আপনার জন্য এক সপ্তাহ আর ও তো মেয়ে মানুষ তাই ওর জন্য দুই সপ্তাহ, একেবারে বিশ্ব রোডে উঠাইয়ে দেব। আমি বিস্ময় আর আতংক নিয়ে তাকিয়ে থাকি গাট্টাগুট্টা সরল মানুষটার দিকে। ও আমার সহধর্মিণীর বাল্যকালের বন্ধু। একসাথে প্রাইমারী পাস করে ঝরে গেছে; এখন ট্রাক চালায় দিনাজপুর থেকে ঢাকা। ও কোথা থেকে জেনে গেছে আমরা কানাডার পথ যাত্রী। তাই অতি উৎসাহ নিয়ে আমাদের গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ নিতে উপদেশ দিয়ে যায়। আমি ওর সারল্যে ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ হই। মনে মনে ভাবি গাড়ি চালানোটা শিখে নেওয়াই ভালো। তবে ওর কাছে নয়।

আজ থেকে প্রায় দুদশক আগে যখন কানাডাতে স্থায়ী অভিবাসন নেব বলে মনস্থির করেছি, তখন আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব, শুভানুধ্যায়ী অনেক অনেক উপদেশ দিয়ে যায়। কেউ বলে শীতের দেশ, তাই কিছু জ্যাকেট নিলে অনেক অর্থের সাশ্রয় হবে। কেউ বলে এক ব্যাগ ভর্তি করে সেভিং ব্লেড নিতে, কেউ বলে মিলিটারি সাঁচে চুল কাটতে যাতে আগামী তিনমাস অনায়াসে চলে যায়, কেউ বলে চোখ দেখিয়ে চশমা নিতে, কেউ বলে ভাঙ্গাচুরা দাঁত থাকলে তা মেরামত করে নিতে। আমি কারোর কথাই ফেলতে পারি না। দাদাকে নিয়ে বংগ বাজার ঘুরে ঘুরে জ্যাকেট কিনি। ছোট করে চুল কাটি, চোখ দেখিয়ে দুজোড়া করে চশমা নেই। হন্যে হয়ে দাঁতের ডাক্তার খুঁজি। পেয়ে যাই এক পরিচিত ডাক্তারকে। ওর নাকি যথেষ্ট সুনাম। কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই কিন্তু ভালো ডাক্তার। বিশ্বাস রেখে আমরা প্রবেশ করি ওর ডাক্তারিখানায়। বাইরে বেশ বড় সাইনবোর্ড। সেখানে বেশ বড় এক মুখের ছবি। মুখের এক অংশ ব্যবচ্ছাদিত। বেড়িয়ে রয়েছে দুপাটি দাঁত। আনাড়ি শিল্পীর হাতে আকা ছবি। তাই ছবির দিকে তাকালে একটা সূক্ষ্ম আতংক বোধ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। ভেতরে ঢুকেই বুঝতে পারি আমরা ভুল জায়গায় এসেছি। এককালে এখানেই ছিল এক সাইকেল মেরামতের দোকান। বর্তমান ডাক্তার ওর বাবার সাথে সাইকেল মেরামত করতো। কালের পরিক্রমায় ও ডাক্তার হয়েছে কিন্তু ভুলতে পারেনি সাইকেলকে। সাইকেলের ভগ্ন যন্ত্রাংশ দিয়ে ও তৈরি করেছে দাঁত পলিস করার যন্ত্র। ও যখন প্যাডেল করে একটা ঘূর্ণায়মান পাথরের চাকতি দিয়ে আমার দাঁত পরিষ্কার করে তখন আমি বুঝতে পারি কেন আমার কানে ও তুলো ঢুকিয়ে রেখেছে। আমি আমার বদ্ধ কানেও দূরাগত ধাতব শব্দ শুনে শিহরিত হই। ঘণ্টা খানেক ধ্বস্তাধস্তির পর যখন বাসায় ফিরি তখন মাড়ি ফুলে উঠতে শুরু করেছে। পরদিন সকালে মুখ ফুলে কথা বলা বন্ধ। দিন সাতেক অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে ফকফকা দাঁত নিয়ে আবারো বেড়িয়ে পড়ি বাদবাকি উপদেশ বাস্তবায়ন করতে।

এবার মার উপদেশ। বিদেশ বিভূঁইয়ে কি খাব এ কথা চিন্তা করে মা আমার ডালের বড়ি, কাসুন্দি, খাটি সরিষার তেল, গাওয়া ঘি সব ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করেছেন। একটা ব্যাগ ভর্তি হয়েছে মাস কালাই, মসুর ডাল, জিরা ধনিয়া সহ হরেক রকম রন্ধন উপকরণে। ব্যাগে ব্যাগে ভর্তি হয় আমাদের ড্রইং রুম। দেশ ত্যাগের প্রস্তুতির এই মহা যজ্ঞে শুধু তখন শুধু গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ নেওয়া বাকী। চাকুরী জীবনে গাড়ীতে চড়েছি কিন্তু চালানোর কোন অধিকার ছিল না। বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ শেষ করে যখন বিএমএতে প্রশিক্ষণের ডাক পাই তখন এই ভেবে উচ্ছ্বসিত হই এবার বুঝি গাড়ি চালনার প্রশিক্ষণ পাবো । কিন্তু সেখানে পাই ঘোড়ায় চড়ার প্রশিক্ষণ। সুউচ্চ ঐ মিলিটারি মেজাজের ঘোড়া গুলোকে দেখে অন্তরাত্মা কেপে উঠত। কোন মতে ঘোড়ায় চেপে প্রার্থনা করতেম বাবা ফেলে দিস না। তাই এবার শিখবই শিখবই করে মন স্থির করে ফেলি। পেয়ে যাই স্থানীয় একজন প্রশিক্ষক । ফাকা মাঠে সাই সাই করে গাড়ি চালাই। কিন্তু শহরের রাস্তায় আমি শুধু বসে থাকি, স্টিয়ারিং ব্রেক উনিই নিয়ন্ত্রণ করেন। যতো দিন যায় রাস্তায় রিক্সা দেখলে, কুকুর বা মানুষ দেখলে নড়বড়ে হয়ে যাই। সবার দ্বারা সবকিছু হয় না এই ভেবে আমি বেশ কিছু টাকা ও সময় নষ্ট করে অসম্ভবকে সম্ভব করার প্রচেষ্টায় ক্ষান্ত দেই।

দিন ঘনিয়ে আসে দেশ ত্যাগের। অতিরিক্ত মালামালের সাথে গাড়ী না চালাতে পারার ব্যর্থতার এক বিরাট বোঝা হৃদয়ে নিয়ে কানাডার মাটিতে পা রাখি। কিছু দিন যেতেই সে বেদনা ভার আস্তে আস্তে লঘু হয়ে যায়। জীবনে এই প্রথম অপ্রাপ্তির মাঝে বিরাট প্রাপ্তি খুঁজে পাই। মনে বড় প্রশান্তি দেশে গাড়ি চালনা না শিখে জিতে গেছি বলে। এখানে নতুন করে গোঁড়া থেকে শুরু করি। বাম দিকে না চালিয়ে ডান দিকে কেন চালাচ্ছি এ নিয়ে মনে কোন সংশয় হয় না। মাঝে মাঝে ভাবি, ইস! ইংলিশটাও যদি না শিখে আসতাম? তা হলে উচ্চারণের এই বিভ্রাটে পড়তে হতো না। গোঁড়া থেকে শুরু করলে এতদিন কানাডিয়ান উচ্চারনে ঠা ঠা করে ইংরেজি বলতে পারতেম। না বুঝে বোকার মতো না হেসে, বুঝে হাসতে পারতেম। এখন নতুন কোন উচ্চারণ, নতুন কোন শিক্ষা নিতে গেলে পুরানো শিক্ষা বিদ্রোহ করে বসে। মনে আসলেও মুখে আসে না, মুখে আসলেও মন সায় দেয় না।


প্রস্তুতি ।। নৈশব্দের পংক্তিমালা ।। ধারাবাহিক ।। সুশীল কুমার পোদ্দার, ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন