বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী লেখালেখি

মুজিববর্ষে আমাদের প্রত্যাশা

মুজিববর্ষে আমাদের প্রত্যাশা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মেছিলেন ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন ফরিপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। তার পিতা শেখ লুৎফর রহমান, মাতা সায়েরা খাতুন। তিনি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাগ্রহণ করেন টুঙ্গিপাড়া, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জে। ছোট সময়ে চাচাতো বোন রেণুর সঙ্গে তার বিয়ে দেন অভিভাবকেরা। বঙ্গবন্ধুর বাল্যকাল সম্পর্কে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন, ‘ছোটবেলায় আমি খুব দুষ্টু প্রকৃতির ছিলাম। খেলাধুলা করতাম, গান গাইতাম এবং খুব ভালো ব্রতচারী করতাম।’ কিন্তু ১৯৩৪ সালে যখন তিনি সপ্তম শ্রেণিতে পড়েন, তখন তার বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তার পিতা তাকে কলকাতায় নিয়ে চিকিৎসা করান। তাদের পরিবার অর্থবিত্তে বেশ সঙ্গতিপূর্ণ ছিল।

এ কারণে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা না করে কলকাতা নিয়ে তার চিকিৎসা করান। তার চিকিৎসক ছিলেন ডা. শিবুপদ ভট্টাচার্য, ডা. এ কে রায় চৌধুরী। দুজনই ছিলেন কলকাতার বিখ্যাত চিকিৎসক। এ থেকেই বোঝা যায়, তার পিতা তাকে কতটুকু ভালোবাসতেন। বাল্যকাল থেকে তার স্বাস্থ্যের প্রতিও যে যত্ববান ছিলেন, তার পরিচয় পাওয়া যায়। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, ১৯৩৬ সালে তার পিতা শেখ লুৎফর রহমান যখন মাদারীপুর মহকুমায় সেরেস্তাদার হিসেবে বদলি হয়ে যান, তখন অসুস্থ শেখ মুজিবকেও সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। শেখ লুৎফর রহমান গোপালগঞ্জে চাকরি করতেন। এই প্রথম তিনি বদলি হন এবং শেখ মুজিব অসুস্থ থাকায় তার মাকেও সেখানে নিয়ে যান। এর আগে কখনো তার মাকে কর্মস্থলে নিয়ে যাননি। সায়েরা খাতুন বাড়িতেই থাকতেন। পরিবার দেখাশোনা করতেন।

১৯৩৬ সালে মুজিবের দুচোখে গ্লুকোমা ধরা পড়ায় দ্বিতীয়বার তাকে আবার কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। তখন সেখানকার বিখ্যাত চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ ছিলেন ডা. টি আহমেদ। তিনি চোখ পরীক্ষা করে বলেন, এই ছেলের দুটো চোখ জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন করানো দরকার। নইলে আজীবনের জন্য অন্ধ হয়ে যেতে পারে। অপারেশনের কথা শুনে শেখ মুজিব পালাতে চেয়েছিলেন। বাল্যকাল থেকে একটু দুরন্ত ছিলেন বলে অপারেশন না করেই পালাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পালাতে পারেননি। তাকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করানো হয় এবং দশ দিনের মধ্যে তার দুচোখই অপারেশন করা। সফল অপারেশনের পর তাকে চশমা দেওয়া হয়। সেই থেকে তিনি চোখে চশমা পরেন। চোখের চিকিৎসার পর আবার তিনি ফিরে এলেন মাদারীপুর। মাদারীপুর তখন স্বদেশী আন্দোলনের একটি শক্তিশালী কেন্দ্র।

শেখ মুজিব বাল্যকাল থেকেই ছিলেন রাজনীতি-মনস্ক। তার পিতা বাড়িতে সংবাদপত্রই শুধুু নয়, সাহিত্য পত্রিকাও রাখতেন। একদিকে বাল্যকাল থেকেই তিনি রাজনীতি মনস্ক, সেই কারণে মাদারীপুর যে স্বদেশী আন্দোলনের শক্তিশালী কেন্দ্র, মাঝে মধ্যে সেখানে যাতায়াত করতেন। ফলে এ কথা বলা যায়, ১৯৩৬ সাল থেকেই বঙ্গবন্ধু রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং কলকাতার আনন্দবাজার, বসুমতি, আজাদ, সওগাত, মোহাম্মদী এই পত্রিকাগুলোর পাঠক। পিতা বাসায় রাখতেন, যাতে বালকপুত্র শেখ মুজিব পাঠ করতে পারেন। তা হলে আমরা লক্ষ করছি, একই সঙ্গে রাজনীতি ও সংস্কৃতি এবং বিশ্ব সম্পর্কে ধ্যান-ধারণা বাল্যকাল থেকেই লাভ করেছিলেন আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

তার রাজনীতি-মনস্কতা প্রথমে গড়ে ওঠে সংবাদপত্র পাঠের মধ্য দিয়ে। এই রাজনীতি অনুরাগ প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়, তৎকালীন বাংলার এবং ঔপনিবেশিক রাজনীতির সঙ্গে। ইংরেজ ঔপনিবেশিকবিরোধী আন্দোলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা যোগ করেছিল স্বদেশী আন্দোলন। সেই স্বদেশী আন্দোলনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন মাদারীপুরের। বঙ্গবন্ধু যখন সেখানে পড়াশোনা করতেন, তখনই তাদের সঙ্গে একটা সংযোগ ঘটে। চোখের চিকিৎসার পর তিনি যখন সম্পূর্ণ সুস্থ, তখন তাদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়। মাদারীপুরে তখন সুভাষ বোসের শক্তিশালী সমর্থক গোষ্ঠী ছিল। তাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। অর্থাৎ আমরা দেখতে পাই, ১৯৩৬ সাল থেকেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন।

আমরা যদি তার রাজনীতির সূচনা পর্ব উল্লেখ করি, তা হলে বলা যায়- ১৯৩৬ সাল থেকেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। সেই সঙ্গে যে ঘটনাটি ঘটল, তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠার পর পিতা আবার গোপালগঞ্জ বদলি হয়ে ফিরে আসার পরও বালক বয়সে স্বদেশী আন্দোলন বা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সমর্থকদের মিটিংয়ে বা জনসভায় যোগ দিতেন। এ থেকে বোঝা যায়, রাজনীতির প্রতি বালক বয়স থেকেই তিনি কতটা নিষ্ঠাবান ছিলেন এবং এ রাজনীতি ছিল জীবন-ঘনিষ্ঠ, মানুষের রাজনীতি, মুক্তির রাজনীতি, স্বাধীনতার রাজনীতি। যেহেতু উপনিবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে বাংলার মানুষ, স্বদেশী আন্দোলনকারীরা বা সুভাষ বসুর নেতৃত্বে গোটা ভারতবর্ষের জনগোষ্ঠী- তিনি তাদের সঙ্গে সেই তখন থেকেই যুক্ত। এতেই তার জীবনকে বোঝার জন্য এবং পরবর্তীকালে আধুনিক, গণতান্ত্রিক, মানবিক, একই সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কামনা করলেন, সেটি কিন্তু এই জায়গা না বুঝলে বোঝা যাবে না।

হঠাৎ করে একজন জাতীয়তাবাদী, গণতান্ত্রিক নেতা কি সমাজতন্ত্রের কথা বলেন বা বললেও মুখে একটু বলেন মাত্র। ভারতেও তো সমাজতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে। সেখানে তো সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ছয়-সাতজন বিশাল পুঁজিপতি আর ৯৫ শতাংশ বা তারও বেশি সাধারণ জনগোষ্ঠী। আমাদের বাংলাদেশেও বৈষম্য ঠিক সে রকমই রয়ে গেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যদি আজ বেঁচে থাকতেন, নিশ্চয় তিনি সমাজতন্ত্রের নীতি ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার করার চেষ্টা করতেন। সংবাদপত্রপাঠের মাধ্যমে যেমন তিনি নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন, তেমনি রাজনৈতিক সংযোগ, স্বদেশী আন্দোলন ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে সম্পর্কের মাধ্যমে এক ধরনের রাজনৈতিক চেতনা গড়ে উঠেছিল। আরেকটি বিষয় যুক্ত হয়েছিল আর তা হলো, ১৯৩৯ সালে প্রথম কলকাতায় পড়াশোনার জন্য যাওয়া। সেখানে গিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে। অবশ্য ১৯৩৮ সালেই অবিভক্ত বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও কুমুদ বিহারী মল্লিক- এ তিন মন্ত্রী গোপালগঞ্জ গিয়েছিলেন। গোপালগঞ্জে তাদের সভা-সমিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অংশগ্রহণ করলেন। ওই সময় তিনি গ্রেফতারও হয়েছিলেন।

হিন্দু মহাসভার সঙ্গে সংঘর্ষ হলে তিনি তাদের একজনকে ওদের কাছ থেকে ছিনিয়ে এনেছিলেন। এতে তারা মামলা করলে শেখ মুজিবকে সাত দিন কারাবরণ করতে হয়। ১৯৩৮ সাল মানে, মাত্র ১৮ বছর বয়সেই তার প্রথম জেল খাটার অভিজ্ঞতা হয়। অর্থাৎ ১৯৩৬ সালে তার রাজনীতিতে প্রবেশের মাত্র দুবছরের মাথায় তাকে জেল খাটতে হয়। এর দুবছর পর আবার অন্য রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে। প্রথম রাজনীতির যোগাযোগ স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে এবং নেতাজি সুভাষ বসুর রাজনীতির সঙ্গে ইংরেজ উপনিবেশ বিরোধী, যা স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত এবং পরবর্তীকালে শেরেবাংলা ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও কুমুদ বিহারী মল্লিক এলে তাদের সঙ্গে অন্যভাবে যুক্ত হয়ে গেলেন। শেরেবাংলা অনুষ্ঠান শেষে চলে গেলেন মিশন স্কুল দেখতে। বঙ্গবন্ধু এ স্কুলেই পড়েন। অনুষ্ঠানের আয়োজনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনি একটু রোগা-পাতলা ছিলেন। অনেক লম্বা। দৃঢচেতা মনোভাব। সোহরাওয়ার্দীর নজরে পড়লেন। বললেন কলকাতায় গেলে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলকাতায় ফিরে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই শেখ মুজিবুর রহমান স্কুলে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের চিঠি পেলেন। এরই সূত্র ধরে ১৯৩৯ সালে তিনি কলকাতায় গেলেন এবং সোহরাওয়ার্দী সাহেবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। এর পর ১৯৪১ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি পড়াশোনার জন্য কলকাতা যান এবং ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন।

শৈশবে বঙ্গবন্ধুর জীবনে তিন শিক্ষক, বিশেষ করে কাজী আবদুল হামিদ এমএসসি তার ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। একদিকে স্বদেশী আন্দোলনের প্রভাব, আরেকদিকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর প্রভাব, অন্যদিকে হামিদ মাস্টারের মতো অন্য শিক্ষকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েন। ওই সময় তার পিতা ভালো শিক্ষক বাড়িতে রেখে ছেলেকে ভালোভাবে পড়ানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। বিশেষ করে ইংরেজি ও অংকের জন্য। তাই বলা যায় শিক্ষার ক্ষেত্রে তার শিক্ষকদের যেমন প্রভাব রয়েছে, তেমনি আধুনিক সচেতন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারেও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

যা-হোক, কলকাতায় যাওয়ার পর ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হওয়ার পর স্বল্পসময়ের মধ্যেই তিনি কলকাতার মুসলিম সমাজের বিখ্যাত ছাত্রনেতা হয়ে উঠলেন। ছাত্রনেতা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা জিনিস ঘটল। তিনি ১৯৪৩ সালে মুসলিম লীগের কাউন্সিলর হিসেবে দিল্লিতে মুসলিম লীগের কাউন্সিলে গিয়েছিলেন। এটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি আবুল হাশিম যখন বাংলার মুসলিম লীগ নেতা হলেন, তখন মুসলিম লীগকে আধুনিক মুসলিম লীগ দৃষ্টিভঙ্গিতে গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা করলেন। শেখ মুজিব তখন ছাত্রনেতা। তিনিও তার সঙ্গে যুক্ত হলেন। আবুল হাশিম সাহেব বললেন, শুধু সেøাগান দিলে হবে না, পড়াশোনাও করতে হবে। সেমিনার, সিম্পজিয়াম করতে হবে। রাজনীতির মর্ডানিটি বুঝতে হবে এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা মুসলিম লীগ গড়ে তুলব। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, মুসলিম লীগ গঠন করার ক্ষেত্রে মওলানা আকরম খাঁ ও তার আজাদ পত্রিকা আমাদের বিরোধিতা করছেন। এ অবস্থায় আমাদের এগোনো কঠিন। তাই আমি ঠিক করেছি, আমরা একটি পত্রিকা বের করব আর তরুণ রাজনৈতিক কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করব। এ দুটি ব্যবস্থা মুসলিম লীগকে আধুনিক করতে সহায়তা করবে। বঙ্গবন্ধু রাজি হলেন এবং বললেন, আপনার যে কোনো প্রচেষ্টার সঙ্গেই আমি থাকব। কিন্তু খুব সিরিয়াসলি ওখানে বসে তাদের কথা আমি শুনতে পারব না। আমি তো অর্গানাইজার। আমাকে অর্গানাইজ করতে হবে। আমি অর্গানাইজ করব এবং রাতে যখন সময় পাব, তখন থাকব। এই চিন্তার ফলে তারা বললেন যে, আমাদের একটি পত্রিকা বের করতে হবে। পত্রিকা ছাড়া একটি দলের মতামত প্রচার করা কঠিন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অর্থায়নে প্রকাশ শুরু হলো ‘মিল্লাত’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। মুসলিম লীগ অফিসের নিচতলায় আবুল হাশিম সাহেবের সম্পাদনায় বের হলো কাগজ। এর সঙ্গে যুক্ত হলেন সাংবাদিক কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিসসহ অনেক তরুণ সাংবাদিক।

এ পত্রিকাটি আধুনিক প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির জন্য বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও আলোড়ন সৃষ্টি করল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পত্রিকাটির সঙ্গে যুক্ত হলেন শুধু প্রকাশের আয়োজনের ব্যাপারে নয়, লেখা সংগ্রহ, এমনকি হকার হিসেবেও পত্রিকাটি বিক্রির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। এ থেকে বোঝা যায়, একজন মানুষ বাল্যকাল থেকে সাধারণ মানুষের সঙ্গে, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে, স্বদেশী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মেশা, সুভাষ বসুর নেতৃত্বের প্রতি আস্থা, মুসলিম লীগকে অর্গানাইজ করা- এত বিষয় নিজের মধ্যে ধারণ করে ধাপে ধাপে পর্যায়ক্রমে একজন বড় রাজনৈতিক নেতা কিন্তু কলকাতা থেকেই হয়ে গেলেন। ইসলামিয়া কলেজে যখন পড়েন, তখন তিনি কিন্তু বিখ্যাত নেতা। বিশেষ করে ১৯৪৩ সালের পর। এ সময় বাংলায় দুর্ভিক্ষ হয়। সেই দুর্ভিক্ষে কর্মী হিসেবে ভূমিকা রেখেছিলেন। বিহারে তিনি কমিটি নিয়ে গিয়ে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। এ সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।

আবার কলকাতায় যখন দাঙ্গা লেগে গেল, তখন ভবতোষ দত্ত নামে একজন বিখ্যাত শিক্ষক ছিলেন তার, তিনি লেখকও। তিনি শেখ মুজিব সম্পর্কে বলেছেন, আমরা যখন জীবনের নিরাপত্তা খুঁজছি, তখন তরুণ শেখ মুজিব আমরা যারা হিন্দু সমাজে ছিলাম, তাদের নিজ নেতৃত্বে আমাদের নিরাপদ এলাকায় পৌঁছে দিয়ে আসে। তার সঙ্গে নারী কর্মীরাও ছিলেন, যারা পরবর্তীকালে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তারাও সেখানে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব একজন অসাম্প্রদায়িক, দাঙ্গাবিরোধী নেতা হিসেবে এবং দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে বাঁচাতে শুধু বাংলা নয়, বিহারে গিয়েও যে কাজ করেছিলেন, তা অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এসব বিষয় নিয়েই তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। এ কারণে তিনি মুসলিম লীগকে যেমন আধুনিকায়ন করেছেন, পরবর্তীকালে পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগ যখন স্বৈরাচারী দল হলো, সেই দল থেকে পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগ গঠন করলেন। গঠন করলেন মানে, সোহরাওয়ার্দী সাহেব, মওলানা ভাসানী, ইয়ার মোহাম্মদ খানরা। শেখ সাহেব তখন জেলে। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি জেলে ছিলেন। জেলে থাকা অবস্থায় তাকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক করা হলো। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ গঠিত হলো। সেই আওয়ামী লীগের একজন নেতা হিসেবে ধাপে ধাপে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলেন। ১৯৫৫ সালে এসে বললেন, আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম হতে পারে না। যেহেতু আমরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই, তাই তিনি মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে দলের নাম রাখলেন আওয়ামী লীগ। এখানে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪৮ সালে যখন ছাত্রলীগ গঠিত হয়, তখন কোনো কোনো নেতা বলেছিলেন যে, আমরা মুসলিম নাম দিয়ে কোনো সংগঠন করব না।

তখন শেখ মুজিব বললেন, সবে পাকিস্তান হয়েছে। মুসলিম লীগের নেতৃত্বে হয়েছে। ইতিহাস বুঝতে হবে। এখনই যদি এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করি, সরকার আমাদের ওপর আগ্রাসী আক্রমণ শুরু করবে এবং জনগণও এ মুহূর্তে মেনে নেবে না। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, সংগ্রাম করতে হবে। এই সংগ্রামটা কখন? ১৯৪৮ সালেই সংগ্রাম শুরু হয়ে গেল, যখন জিন্নাহ ঢাকায় এসে বললেন, ‘উর্দু অ্যান্ড অনলি উর্দু শ্যাল বি দ্য স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান। নো, নো বলে চিৎকার করল ছাত্ররা। তৎকালীন রেসর্কোস ময়দানে, পরে কার্জন হলে। এই অবস্থার মধ্যে বঙ্গবন্ধু একজন অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে থাকলেন। বহু বছর তিনি জেলেই কাটিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি আধুনিক, গণতান্ত্রিক ও শক্তিশালী একটি পার্টি গঠন করতে পারলেন- যে পার্টি ১৯৪৯ সালে গঠিত হয়েছিল, জেলে থাকা অবস্থায় নেতা হয়েছেন, পরবর্তীকালে বিভিন্ন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, যেমন- মার্শাল ল’র বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। ১৯৬৪ সালে দাঙ্গা হলো। তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন যারা, তাদের সেবা-শুশ্রƒষার ব্যবস্থা করেছিলেন। অধ্যাপক অজিত কুমার গুহকে নিরাপদ জায়গায় রেখেছিলেন। এই ভূমিকায় একদিকে গণতান্ত্রিক চেতনা, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে সাধারণ মানুষকে বোঝা ও তাদের মনমানসিকতা বোঝা এবং তাদের জন্য সংগ্রাম করা ও মুসলিম চেতনাবাদ অর্থাৎ ধর্মীয় চেনতাবাদ থেকে ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে তার রাজনৈতিক চেতনাকে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক চেনতায় নিয়ে আসেন। তিনি বলেই গেছেন, বর্তমান বিশ্বে যে পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা, তা কোনোভাবেই মানুষের মঙ্গলের জন্য নয়। এ জন্য আমাদের সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় যে কোনোভাবেই হোক যেতেই হবে। আমরা জাতীয়তাবাদী থাকব। কারণ জাতীয়তাবাদ না থাকলে, বাঙালিত্ব না থাকলে আমরা শেষ পর্যন্ত নিঃশেষ হয়ে যাব। একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক চেতনাও থাকবে। কিন্তু সেই গণতান্ত্রিক চেতনা ও অর্থনৈতিক যে বিকাশ, সেটি পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক বিকাশ হবে না। পরবর্তীকালে বললেন, বর্তমান বিশ্ব দুভাগে বিভক্ত। একদিকে শোষক, অন্যদিকে শোষিত, আমি শোষিতের পক্ষে। আমি শোষিতের গণতন্ত্র চাই। সেই চেষ্টাটা তিনি করতে থাকলেন। আইয়ুব খান যখন ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল’ জারি করলেন, তখনো ভেতরে ভেতরে সংগ্রামটা চলছিল। তিনি জেলে ছিলেন। কিন্তু কর্মীরা জেল কেটে, নির্যাতন সহ্য করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সামনে নিয়ে যাওয়ার জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। একজন গ্রেফতার হয়েছেন তো অন্যজন, এমনকি আমেনা বেগমও আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অথবা মিজানুর রহমান চৌধুরীও আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়ে সংগ্রাম করেছিলেন। এভাবে বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন এবং ১৯৬০ সালের পর তিনি মরিয়া হয়ে উঠলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এ কথা তো আর সরাসরি বলা যায় না। তিনি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রথমেই ছাত্রসমাজকে সংগঠিত করলেন। তাদের দিয়ে যে স্লোগানগুলো ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’, ‘ঢাকা না পি-ি, ঢাকা ঢাকা’, ‘তোমার-আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’র মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী চেতনাকে এবং বাঙালিদের শোষণের ইতিহাসকে তুলে ধরলেন।

ফলে ১৯৬০ সালের পর তিনি ১৯৬১, ১৯৬২, ১৯৬৩ সালের দিকে বাংলাদেশের সর্ববাদী সম্পূর্ণ জাতীয় নেতায় পরিণত হয়েছেন। তার পর ১৯৬৬ সালে অনেক চিন্তাভাবনা করে ছয় ছফা পেশ করলেন এবং ছয় ছফা শুধু স্বায়ত্তশাসন প্রস্তাব ছিল না, এর বাইরে তিনি বলতেনইÑ এটি আমার এক দফা সংগ্রামের কৌশল প্রস্তাবনা মাত্র। ভুট্টোও সে কথা বলেছেন যে, ছয় ছফা দাবি যদি আমরা পাস করে দিই, তা হলে পাকিস্তান ভেঙে ছয়টি রাষ্ট্র হয়ে যাবে। ছয় ছফা প্রস্তাবের পর যখন অত্যাচার, নির্যাতন আরও বেড়ে গেল, আগরতলা ষড়যতন্ত্র মামলা দেওয়া হলো, এই অবস্থা অতিক্রম করে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে, দূরদর্শী চিন্তাচেতনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার স্থির প্রজ্ঞায় এগোলেন। এ১৯৬৯ সালে গণবিদ্রোহ বা গণবিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থান যা-ই বলি না কেন, এ অভ্যুত্থানের পরে ওরাও বুঝে গিয়েছিল, বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করছে। আর কোনো বিকল্প নেই। এর আগে ৭ মার্চে যে অসাধারণ ভাষণ দিলেন, তা কতটা কৌশলময়, কতটা কূটনৈতিক চেতনাসমৃদ্ধ। তিনি ভাষণে সব কথাই বললেন। স্বাধীনতার ঘোষণাই দিলেন। কিন্তু ওদের গোয়েন্দারা বলল, ‘শেখ মুজিব চাতুর্যের সঙ্গে অসাধারণ একটি ভাষণই শুধু দিল না, স্বাধীনতাও ঘোষণা করল।’ কিন্তু আমাদের কিছুই করার থাকল না। কারণ আমাদের তো তখন আকাশে কামানশোভিত হেলিকপ্টার উড়ছিল। বাইরে কামান, বন্দুক’ সব তাক করানোই ছিল। শেখ মুজিব শুধু যদি ঘোষণা করতেন, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন, তা হলেই কামানগুলো গর্জে উঠত। কিন্তু তিনি সে অবস্থার মধ্যে না গিয়েও আমাদের জন্য স্বাধীনতাকে কীভাবে সম্ভব করে তুললেন। তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হলো ২৫ মার্চে রাতে, অপারেশন সার্চ লাইট করে ঢাকা শহরের এত লোককে হত্যা করল, এক রাতে পৃথিবীর কোনো দেশেই বোধয় এত লোককে একসঙ্গে মরতে হয়নি, বাঙালি তখন শেখ মুজিবের নেতৃত্বে এতটাই সুদৃঢ় চেতনার অধিকারী হয়ে উঠল যে, জীবনকে তুচ্ছ করে তারা স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলো। সব নিষ্ঠুরতা কীভাবে গ্রহণ করে স্বাধীনতা শেষ পর্যন্ত ছিনিয়ে আনল।

এভাবে মহান নেতা বাস্তবে যতটা শেখ মুজিব ছিলেন, আরও বড় একটি ইমেজ সৃষ্টি করে পাকিস্তানি কারাগারে আবদ্ধ থাকলেন। সারাবিশ্ব তার মুক্তি কামনা করল। বহির্বিশ্বের ক্রমাগত চাপ আর বাংলাদেশে থাকা তাদের বিশাল সৈন্যবাহিনী, যারা এ দেশের লাখো মানুষকে হত্যা করেছে, নির্যাতন করেছে, মা-বোনের ইজ্জত নিয়েছে, তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কৌশল হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে আর হত্যা করেনি। তার জন্য কবর খুঁড়েছিল। কিন্তু ফাঁসি দেয়নি। ইয়াহিয়া ফাঁসি দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ভুট্টো দেয়নি। কারণ তিনি তো প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। ভবিষ্যতে এসব তাকেই মোকাবিলা করতে হবে।

আমাদের দুর্ভাগ্য যে, পাকিস্তানিরা তাকে হত্যা করতে সাহস না দেখালেও বাঙালিরা, যারা দেশদ্রোহী ছিল, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি যাদের কোনো আস্থাই ছিল না, গণতান্ত্রিক বা মানবিক চেতনা, বাংলাদেশে যার রাষ্ট্রনীতি; গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ এবং এর প্রতি যাদের আস্থা ছিল না, তারাই আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে আমাদের বাংলাদেশকে পঙ্গু করে দিতে চেয়েছিল।

আমাদের সৌভাগ্য, জাতির পিতার কন্যা এত বছর পরে স্বৈরশাসক, সামরিক শাসকদের অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করে বাংলাদেশকে আবার আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরে এনেছেন। তাকেও আরও শক্ত অবস্থানে থাকতে হবে, সাধারণ মানুষের পক্ষে থাকতে হবে এবং সুশাসন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশকে আবার বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় পরিণত করতে হবে। তবেই বাঙালি বিশ্বের একটি অনন্য জাতি ও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।

অর্থনীতির ক্ষেত্রে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যে অর্জন, তা অসাধারণ। আমাদের প্রবৃদ্ধির হার আমাদের অর্থনীতির উন্নতিতে এক রোল মডেল। এ জন্য আমরা আনন্দিত। একই সঙ্গে বাংলাদেশে যে বৈষম্য বেড়ে যাচ্ছে, তার রাশ টেনে ধরতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরও শক্ত অবস্থান নিতে হবে এবং বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক, মানবিক, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তার দলকেও প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সংযোগ করে গড়ে তুলতে হবে। এর ভেতরে যারা পুঁজিবাদী অর্থনীতি বৈষম্যকে সমর্থন করছে, তাদের নির্মূল করে একটি শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হিসেবে মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হবে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে মুজিববর্ষে আমাদের প্রত্যাশা  এটাই হোক ।

আরও পড়ুনঃ ইরানে বিমান বিধ্বস্তে জাস্টিন ট্রুডোর সমবেদনা

আরও পড়ুনঃ ভবঘুরে মজনুর বিকৃত জীবন

আরও পড়ুনঃ ইরানে বিমান বিধ্বস্তে জাস্টিন ট্রুডোর সমবেদনা

আরও পড়ুনঃ মুজিববর্ষ উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে জাস্টিন ট্রুডো

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে cbna24.com 

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four × one =