পূর্ব প্রকাশের পর… ধা রা বা হি ক
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৯ | সুশীল কুমার পোদ্দার
হিলির স্থল বন্দরে পাক সেনাদের সাথে তুমুল যুদ্ধের খবর আসে। খবর আসে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তি সেনাদের অগ্রযাত্রার খবর। মানুষের মুখে মুখে রটে যায় বিজয় আর বেশী দূরে নয়। একদিন অপরাহ্নে মহাসড়ক ধরে ফিরতে থাকে সাজোয়া বহর। ট্রাংকের ডালা খুলে উচ্ছ্বসিত সেনারা হাত নাড়িয়ে চলেছে । মুখে স্লোগান । সে স্লোগানের ভাষা আমি বুঝি না কিন্তু অর্থ কিছুটা বুঝতে পারি। ট্রাক থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের ছোট ছোট পতাকা বিতরণ করা হচ্ছে। রাস্তার দুধারে দাড়িয়ে সবার দেখাদেখি আনন্দে উদ্বেলিত হই। কুড়িয়ে পাওয়া পতাকা গুলো সজোরে নাড়াতে থাকি। সন্ধ্যা গড়িয়ে যায় পতাকা নাড়াতে নাড়াতে। ক্লান্ত হয়ে ঘরে আসি ফিরে।
তখনো ভোরের আলো ফোটেনি। দরজায় কে যেন আওয়াজ করে চলেছে। আমাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমরা ভীত সন্ত্রস্ত। বিজাতীয় ভাষায় কে যেন দরজা খুলতে বলছে। বাবা সাবধানে দরজা খুলে দেন। আমাদের সামনে দাড়িয়ে এক বিশাল দেহী শিখ সেনা। ওদের খাবার জল ফুরিয়ে গেছে। হাতে একটা ড্রাম। বাবা জলে ভরে দেন। সেনাটা কুর্নিশ করে বিদায় নেয়। আস্তে আস্তে ভোর হয়। বেড়ার ফাঁক গলিয়ে দেখতে পাই অনেকগুলো মিলিটারি কনভয় থেমে আছে মহাসড়কের পাশে আমাদের শীর্ণকায়া নয়নঝুলির গা ঘেঁষে। দেখতে পাই শিখ সেনাটা আবারো এগিয়ে আসছে বাঁশের সাকো পার হয়ে আমাদের বাড়ীর দিকে। ওর আচরণে আমাদের আর ভয় করে না। বাবা–দাদা হিন্দি মোটামুটি বুঝতে পারে। ও ঘরের বারান্দায় জলচৌকির উপর বসে থাকে। একটা খবরের কাগজে অনেকগুলো পরোটা এনেছে আমাদের জন্য । মা কিছুটা আপত্তি করেন কিন্তু মানুষটার বেদনাহত মুখটার দিকে তাকিয়ে না বলতে পারেন না। ও হিন্দিতে বলে যায় ওর বাড়ীর কথা, ছোট ছোট ভাই বোনের কথা। কতদিন ওদের দেখিনি সেসব কথা। আমরা ভাষা না বুঝেও তার সব কথা বুঝতে পারি। মনে হয় সে যেন কতো দিনের চেনা আপন জন। আমরা সবাই মিলে ওকে বিদায় জানাই। যতদূর দেখা যায় ও নিরন্তর হাত নাড়িয়ে চলে।
দেশ স্বাধীন। আমাদের আশ্রয়দাতা পরম আত্মীয় বাবাকে আরো কটা দিন অপেক্ষা করতে বলেন। কিন্তু বাবা আর এক মুহূর্ত থাকতে রাজি নন। আমাদের নিস্তরঙ্গ সংসারে একটা উত্তেজনা ছড়িয়ে পরে। একটা মাত্র ইংলিশ প্যান্ট, ছিঁড়ে গেছে অনেক জায়গাতেই। নতুন জিনিষের আবদার করতে ভুলে গেছি কতকাল। মা রিপু করে দেন। বাবা বলেন দেশে যেয়ে নতুন জামা আর প্যান্ট কিনে দেবেন, দেবেন জুতো আর স্কুল ব্যাগ। আমি কবে দেশে ফিরবো, কবে আবার স্কুলে যাবো সেই স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকি।
এক কুয়াশা ভরা ভোরে আমরা বিদায় জানালেম আমাদের আশ্রয়দাতা মাটিকে, অসময়ে যারা সাহায্য করেছে সেই সব পরম আত্মীয়কে। আমি অধির আগ্রহ নিয়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকি আমার দেশের মাটিকে দেখার জন্য, বৃক্ষলতা ও জনপদ দেখার জন্য । মনে মনে ভাবি কেমন করে বুঝবো এটা আমার দেশের মাটি। প্রকৃতি কি ভিন্ন গন্ধ, ভিন্ন বর্ণ দিয়ে জানিয়ে দেবে এই আমার দেশ। ভাবতে ভাবতে কতো অজানা জনপদ পার হয়ে আসি। আধো ঘুম আধো জাগরণের মাঝে বাস পৌঁছে যায় তার শেষ গন্তব্যে। মাথায় পুটুলি নিয়ে বাবা–দাদার পিছু পিছু হেটে চলি। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই দেখা হয় রেললাইনের সাথে। আমি দাদাকে বলি কোথায় বাংলাদেশ? দাদা হেসে বলেন আমরা তো বাংলাদেশে চলে এসেছি। আমি মনে মনে খুঁজে বেড়াই সীমান্ত রেখাকে যা ভাগ করে দিয়েছে দুই বাংলাকে। দাদা আমার অনুৎসাহিত চেহারা দেখে বলেন এইযে আমরা রেললাইন দিয়ে হেটে চলেছি এখান থেকে গড়িয়ে পড়লেই ইন্ডিয়া। আমি অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখি বাংলার গাছ নির্ভয়ে বাহু বিস্তার করে ঝুঁকে আছে ভারতের মাটিতে।
আমরা হিলি স্টেশনে পৌঁছে যাই। স্টেশনে বসার জায়গা নেই। ট্রেন আসতে অনেকটা সময় বাকি। আমরা চিড়ে গুর ও জল খেয়ে বসে থাকি ট্রেনের প্রতীক্ষায়। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর এক সময় ট্রেন আসে। ঠাই নাই, ঠাই নাই। দাদা আমাদের ছোটদের জানালা দিয়ে ঢুকিয়ে দেন। ট্রেনটা বিরাট দেহ নিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে চলে আর থামে। সদ্য স্বাধীন দেশ। অবকাঠামো ভেঙ্গে পড়েছে। ট্রেনটা ধুকতে ধুকতে এক একটা স্টেশনে থেমে আর যেন নড়তেই চায় না। সকাল হয়ে গেছে। ট্রেনটা কালিয়া হরিপুর পার হয়। বাবা নীরবে প্রণাম করে জন্মযুক্তা মাটিকে। আমরা সবাই পড়িমরি করে দেখতে চেষ্টা করি আমাদের স্মৃতি বিজড়িত ঝাঐল গ্রামটিকে। গোষ্ঠর মেলায় কতো বার ট্রেন থেকে নেমে হেঁটে গেছি ঐ গ্রামীণ পথ ধরে।
অবশেষে আমরা পৌছি সিরাজগঞ্জ বাজার স্টেশনে। প্রচন্ড উত্তেজনা নিয়ে প্রায় ছুটে চলেছি বাড়ির দিকে। পথের দুধারে ধ্বংসস্তূপ। বড় বিবর্ণ হোয়ে গেছে আমাদের সেই চিরপরিচিত রাস্তা ঘাট। আমরা ত্রস্ত গতিতে এগিয়ে চলি। ঐ তো আমাদের বাড়ী। বড় ঘরটা আমাদের অপেক্ষায় একদিকে কাঁত হোয়ে পড়ে আছে। মেঝেতে এখানে সেখানে বিরাট বিরাট গর্ত। ঘর ছাড়ার আগে বাবা মা অনেককিছু মাটি গর্ত করে রেখে গিয়েছিলেন। দুর্বৃত্তরা সব খুড়ে নিয়ে গেছে। ঘরের টিন খুলে নিয়ে গেছে। আমি দৌড়ে যাই আমার পিয়ারা গাছের কাছে, বরই গাছের কাছে, কলা বাগানের কাছে। কলা গাছগুলো বাতাসে দুলে উঠে। আমাদের নেড়ে কুকুরটা কোথা থেকে দৌড়ে এসে গা ঘেঁসে দাঁড়ায়। আমি বুক ভরে নিঃশ্বাস নেই। সে নিঃশ্বাসে বিশ্বাস খুঁজে পাই।
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ১ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ২ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৩ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৪ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৫ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৬ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৭ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৮ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৯ | সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী । ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স, মাস্টার্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।
এস এস/সিএ
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন