বিশ্ব

অপেক্ষায় কফিনবন্দি লাশের পাহাড়

ইতালিতে করোনাভাইরাস

 

অপেক্ষায় কফিনবন্দি লাশের পাহাড় …।  চার্চগুলোয় জমা পড়ছে কফিন। দাফনের অপেক্ষায় সারিবদ্ধভাবে সাজানো। যারা বাড়িতে মারা গেছেন তাদের লাশ ঘরেই রেখে দেয়া হয়েছে, সিলগালা করে। কারো লাশ সেখানেই পড়ে থাকছে কয়েকদিন। ইতালির লম্বার্দি অঞ্চলের বর্তমান পরিস্থিতি এমনটাই লাশের পাহাড় । দাফনের অপেক্ষায় সারিবদ্ধভাবে সাজানো। যারা বাড়িতে মারা গেছেন তাদের লাশ ঘরেই রেখে দেয়া হয়েছে, সিলগালা করে। কারো লাশ …। করোনা ভাইরাসে (কভিড-১৯) বর্তমানে সবচেয়ে জর্জরিত দেশের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী সেখানকার বাসিন্দারা। বুধবার পর্যন্ত পুরো দেশে মারা গেছেন ২ হাজার ৯৭৮ জন। এর মাঝে কেবল লম্বার্দিতেই মারা গেছেন ১ হাজার ৬৪০ জন।

সেখানকার বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে মৃত্যুর গন্ধ। মুহূর্তে মুহূর্তে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। জমছে লাশের পাহাড় । কেউ মরছেন হাসপাতালে, প্রিয়জনদের থেকে দূরে, একাকী। কেউ মরছেন নিজ বাড়িতে, একাকী। মৃত্যু যেন তার ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছে।

ভাইরাসের সংক্রমণ থামাতে ইতালি সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা জারি রেখেছে। লকডাউনে রয়েছে পুরো দেশ। কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছে না আবশ্যিক প্রয়োজন ছাড়া। তাতেও থামছে না মৃত্যুর মিছিল। মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৩৫ হাজার ছাড়িয়েছে।

এখন পর্যন্ত মৃতদের সবাইকেই কোনো আয়োজন ছাড়াই শেষ বিদায় জানানো হয়েছে। কাউকে দাফন করা হচ্ছে, কাউকে পোড়ানো হচ্ছে। অনেক লাশ এখনো দাফনের অপেক্ষায় পড়ে আছে। যারা হাসপাতালে পরিবার থেকে দূরে, একাকী অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ছাড়ছেন, তাদের জিনিসপত্রগুলো কফিনের পাশে ব্যাগে ভরে রাখা হচ্ছে। দাফনকর্মীরা এসে কফিন নিয়ে যাচ্ছেন।

দুই সপ্তাহে একটা প্রজন্ম মারা গেছে
লম্বার্দির মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বেরগামো প্রদেশে। সেখানকার মোট বাসিন্দা ১২ লাখ। মঙ্গলবার পর্যন্ত সেখানে আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৯৯৩ জন। পুরো প্রদেশজুড়ে কতজন মারা গেছেন তা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে সংখ্যাটা নিশ্চিতভাবেই বড়। প্রদেশের সবচেয়ে বড় দাফন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সিএফবি। সংস্থাটি জানিয়েছে, চলতি মাসে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০০ লাশ দাফন করতে হয়েছে তাদের। সিএফবি’র প্রেসিডেন্ট অ্যান্তোনিও রিচিয়ার্দি বলেন, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আমরা এক মাসে ১২০ জনের মতো মানুষকে দাফন করতাম। মাত্র দুই সপ্তাহে আস্ত একটা প্রজন্ম মারা গেছে। এর আগে কখনোই এরকম লাশের পাহাড় দেখিনি। এ পরিস্থিতি আপনাকে কেবল কাঁদায়।

বেরগামোতে দাফন সেবা দিয়ে থাকে মোট ৮০টি প্রতিষ্ঠান। এদের প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন প্রতি ঘণ্টায় কয়েক ডজন ফোন পায়। কফিনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে সেখানে। চাহিদার তুলনায় যোগান দিয়ে কুলাতে পারছেন না সরবরাহকারীরা। দাফন করতে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন দাফনকর্মীরাও। দাফনের কাজ পিছিয়ে যাচ্ছে।

হাসপাতালগুলো মৃতদের ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ম মেনে চলছে। মৃতদেহ থেকেও ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। এজন্য তাৎক্ষণিকভাবে লাশকে কাপড়ে পেঁচিয়ে কফিনে ভরে ফেলতে হয়। পরিবারের অনেকেই প্রিয়জনকে শেষ দেখার সুযোগ পান না। সুষ্ঠুভাবে বিদায় জানাতে পারেন না। কোনোরকমে শেষকৃত্য সম্পন্ন করাই প্রধান অগ্রাধিকার। রিচিয়ার্দি বলেন, আমাদের অনেক কর্মীও অসুস্থ হচ্ছেন। লাশগুলো দাফনের জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য ও প্রস্তুত করার জন্য আমাদের কাছে পর্যাপ্ত লোক নেই।

এদিকে, যারা বাড়ির ভেতর মারা যাচ্ছেন, তাদের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হাসপাতালের তুলনায় আরো দীর্ঘমেয়াদি। এধরনের মৃত্যুর ক্ষেত্রে অন্তত দুজন চিকিৎসককে মৃত্যুর কারণ চিহ্নিত করে সার্টিফিকেট দিতে হয়। এর মধ্যে দ্বিতীয় চিকিৎসক একজন বিশেষজ্ঞ। সাধারণ পরিস্থিতিতে তিনি যেকোনো লাশকে সনদ প্রদানে অন্তত ৩০ ঘণ্টা সময় পেতেন। রিচিয়ার্দি বলেন, তো, আপনাকে উভয় চিকিৎসক এসে মৃত্যুর কারণ শনাক্ত করা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু তাদের অনেকেও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।

পলিটিকোর এক প্রতিবেদন অনুসারে, স্বাস্থ্যকর্মীরাও আক্রান্ত হচ্ছেন দলে দলে। চীন থেকে চিকিৎসকরা সেখানে যাচ্ছেন। ঘাটতি মেটাতে মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ছাড়াই ডিগ্রি দেয়ার চিন্তা করছে সরকার। এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন অন্তত ২ হাজার ৩০০ স্বাস্থ্যকর্মী।

মর্মান্তিক এক ঘটনার বর্ণনা
বেরগামোর এক শিক্ষক বাড়িতে লাশ পড়ে থাকার এক ঘটনার কথা গার্ডিয়ানকে বলেছেন। তিনি বলেন, গতকাল (বুধবার), ৮৮ বছরের একজন বৃদ্ধ মারা গেছেন। গত কয়েকদিন ধরেই তার জ্বর ছিল। এম্বুলেন্সের ফোন লাইন সবসময়ই ব্যস্ত দেখাচ্ছিল। কোনো এম্বুলেন্স ডাকা সম্ভব হচ্ছিল না। তিনি নিজের ঘরে একা একা মারা যান। তার মৃত্যুর এক ঘণ্টা পর এম্বুলেন্স আসে। অবশ্যই, তখন আর করার কিছু ছিল না। বেরগামোজুড়ে কোনো কফিন না থাকায়, তারা তাকে সেখানেই নিজের বিছানায় রেখে চলে যায়। তার রুম সিলগালা করে দিয়ে যায়, যাতে আত্মীয়স্বজনরা ঘরে না ঢুকতে পারে। কফিন জোগাড় করে তারপরই সে ঘরে ঢোকার অনুমতি মিলবে।

নির্মমতার উপলব্ধি আরো বাড়ে যখন, আত্মীয়স্বজনরা তাদের প্রিয়জনদের হাসপাতালে দেখতে যেতে পারে না। তাদের সুষ্ঠু বিদায় জানাতে পারে না। লম্বার্দির কোদোগ্নো শহরের বাসিন্দা আলেসান্দ্রোর ৭৬ বছর বয়সী চাচা সম্প্রতি মারা গেছেন। লম্বার্দিতে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে এ শহর থেকেই। আলেসান্দ্রো পরিবারের সদস্যদের দাফন নিয়ে বলেন, সচরাচর আপনি তাদের পোশাক পরাবেন। তারা পরিবারের সঙ্গে বাড়িতে একরাত থাকবে। এখন এসবের কিছুই হচ্ছে না। আপনি তাদের শেষবারের মতো বিদায়ও জানাতে পারবেন না। এটাই সবচেয়ে হাহাকার সৃষ্টিকারী অংশ।

বেরগামোয় করোনা ভাইরাসের হৃদয় চুরমার করে দেয়া প্রভাব টের পাওয়া যায় স্থানীয় পত্রিকাগুলোর অরবিচুয়ারি থেকে। গত শুক্রবার স্থানীয় পত্রিকা এল’ইকো দি বেরগামোর অরবিচুয়ারি পাতার গত ৯ই ফেব্রুয়ারির সংস্করণ ও ১৩ই মার্চের সংস্করণের তুলনা করে একটি ভিডিও ফুটেজ আপলোড করেন জোভানি লোকাতেলি নামের এক পাঠক। তাতে দেখা যায়, ৯ই ফেব্রুয়ারিতে এক পাতার মধ্যেই মৃতদের নাম, পরিচয় স্থান পেয়েছিল। অন্যদিকে ১৩ই মার্চে এসে এমন নাম, পরিচয়ের জন্য লেগেছিল ১০ পৃষ্ঠা। গত রোববার ইল মেসেজেরো নামার একটি পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, এক চার্চের বাইরে সারিবদ্ধ হয়ে পড়ে আছে কফিনের পর কফিন।

এদিকে, দেশের কিছু অংশের পরিস্থিতি আরো মর্মবিদারক। অনেক অংশেই দাফন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো করোনা আক্রান্তদের লাশ নিতে চাইছে না। উদাহরণস্বরূপ নেপলস-এর কথা টানা যায়। সেখানে, ৪৭ বছর বয়সী তেরেসা ফ্রানজেসির লাশ প্রায় দু’দিন তার বাড়িতেই পড়ে ছিল। কেউ তাকে দাফনের জন্য এগিয়ে আসেনি।



সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

seventeen − four =