ফিচার্ড বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব কানাডা সাহিত্য ও কবিতা

শব্দগুচ্ছ ।। এপ্রিল সংখ্যা ।।। বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব কানাডা

ব্দগুচ্ছ ।। এপ্রিল সংখ্যা ।।। বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব কানাডা

মুহম্মদ নুরুল হুদা (৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৯) সত্তর দশকের একজন বাংলাদেশী প্রথিতযশা কবি। তিনি জাতিসত্তার কবি হিসেবেও পরিচিত। একই সঙ্গে তিনি একজন ঔপন্যাসিক ও সাহিত্য-সমালোচক। তার জন্ম ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে কক্সবাজার জেলায়। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা অর্ধ শতাধিক। ১৯৮৮ সালে বাংলা কবিতায় উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য তাকে বাংলা একাডেমী পুরস্কার এবং ২০১৫ সালে একুশে পদক প্রদান করা হয়। এছাড়াও তিনি বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১২ জুলাই ২০২১ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে যোগদানের দিন থেকে তিন বছরের জন্য জনাব মুহম্মদ নুরুল হুদাকে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক নিযুক্ত করা হয়।

জয় মানবসময় ||| মুহম্মদ নূরুল হুদা

মুহূর্তের সঙ্গে মুহূর্তের
যে বিরামহীন সংক্রান্তি
তারই নাম কি অনন্ত?
তেমনি এক অনন্ত
সংক্রান্তির লগ্নে
ক্ষুদ্রতম রশ্মিবীজ হয়ে
সূর্য এসে ঠিকরে পড়লো
দুর্বার ডগায়।
অবাক চোখে তাকায়
সম্রাট বিক্রমাদিত্য:
তখন খৃস্টপূর্ব ৫৭ অব্দ।
এই উপমহাদেশের দশদিগন্ত জুড়ে
বেজে উঠলো শঙ্খ-শিঙ্গা- ঢাক।
সেই তো তোমার প্রথম সনাক্তি,
হে বৈশাখ, হে পহেলা বৈশাখ।
অনন্তর ৫৯৩ খৃস্টাব্দ।
তোমাকে নিয়ে তৈরি হলো
এই বঙ্গীয় ভূখণ্ডের অন্য এক মানসাঙ্ক।
সেবার তোমাকে দৃষ্টিবন্দি করলো
রাঢ় বঙ্গ হরিকেল সমতটের গণপতি
মহারাজ শশাঙ্ক।
সেই থেকে অদ্যাবধি
তোমার আনুষ্ঠানিক যাত্রার আর বিরাম নেই।
তোমার অদৃশ্য পা-ডানা চলছে তো চলছেই।
তবে
১৫৫৬ সালে ময়ূরসিংসহাসনে বসেই
কোষাগারের দিকে লুব্ধ চোখে তাকালো
মোগলসম্রাট মহামতি  আকবর।
তার সঙ্গে যুক্ত হলো জ্যোতির্বিদ
আমীর ফতেউল্লাহ খাঁ সিরাজীর
কুশলী অন্তর।
প্রজাহিতৈষণার সঙ্গে
শাসকের খাজনা আদায়।
শুরু হলো বাংলা সনের নতুন দায়।
বর্ষশেষ ও বর্ষশুরুর লগ্নে
হালখাতার পাশে পুণ্যাহ।
আমানি-র ঊর্বরতা আর
গ্রীষ্মের দাবদাহ।
বৈশাখী মেলায় সব সম্প্রদায়ের
নান্দনিক বন্ধনের
সমন্বিত প্রবাহ।
নববর্ষে নবহর্ষে মুখরিত
গণবাঙালির মিলনের গণঢাক।
নীলিমায় পাখপাখালির পরিযায়ী ঝাঁক।
আসে বৈশাখ, এলো বৈশাখ।
অনন্তর
গঙ্গাপদ্মাযমুনার মিলন স্রোতের রেখায় রেখায়
বাংলাদেশে গণবাঙালির বিবর্তনের ডাক শোনা যায়:
”স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়?”
ভাষাসংস্কৃতির স্বাতন্ত্রসন্ধানী ভাষাযোদ্ধা বাঙালি
স্বাধিকারের পথ ধরে প্রমুক্তির স্বাদ পায়।
সময় বদলে যায়,
বদলে যায় হিসেবের পাল্লা।
১৯৬৬ সালে বর্ষপঞ্জির
নবপর্যায়ের সংস্কারক
বহুভাষিক বহুসাংস্কৃতিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।
গণমানুষের গণসময় এ-পথেই যেন ভাগ্যবদল চায় ।
তাই কি ১৯৬৭ সালে বাংলার গণশিল্পীরা তোমাকে
কণ্ঠে নিলো রমনার বটমূলে আর অশ্বত্থতলায়?
সেই থেকে রাজা ও পণ্ডিতের পাঁজিপুঁজি ছেড়ে
বাঙালির লোকজ নববর্ষ যায়
বিশ্বব্যাপী সর্বমানবের মঙ্গলযাত্রায়।
ভাষা, সংস্কৃতি থেকে রাজনীতি,
অনন্তর মুক্তিকামী বাঙালির
অভিন্ন রাষ্ট্রনীতি।
জাতিপিতা মুজিবের ডাকে একাত্তরে
মুক্তিযোদ্ধা বাঙালিজাতি যায়
জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের মূল ঠিকানায়।
সেই থেকে দিয়ে সাতসমুদ্র পাড়ি
পহেলা বৈশাখ স্বাধীনতার প্রমুক্তসোয়ারি
লাল-সবুজের পালের নৌকায়।
হালখাতা, পুণ্যাহ, আমানির সমতলে
তুমি যদিও বাঙালির ইলিশপান্তায়,
তুমি ক্রমে ক্রমে মূ্র্ত ও বিমূর্ত বাংলার অখণ্ড জলেস্থলে,
তার আকাশগঙ্গায়, তার বিশ্বমোহনায়;
তুমি লালন-রবীন্দ্র-নজরুলের একতারায় দোতারায়
তুমি নতুন প্রজন্মের কবিদের বদলপ্রবণ চেতনায়
ক্ষণে ক্ষণে তাকাও অবাক;
তুমি সতত স্বতশ্চল হে বৈশাখ, হে বহতা বৈশাখ।
মূর্ত থেকে বিমূর্তের বাঁকে
বাজাও, বাজাও তোমার অনন্তের ঢাক।
কিংবদন্তিলীন মুক্তবাঙালির সপ্তডিঙা মধুকর
তুমি তার সোনার তরীতে দিগ্বিজয়ী চাঁদসদাগর,
তুমি আজ বিশ্ববাঙালির অনন্তলীন সময়বাড়ি,
দেশে দেশে কালে কালে নও কারো পর,
তুমি জীবাজীবে প্রাণ-বিশ্ব, তুমি তার ঘরচরাচর।
দৈর্ঘ্য নেই প্রস্থ নেই
সময়ের কোনো গতি-যতি নেই
মানববোধের ইন্দ্রজালে
ছুটছে তো ছুটছেই।
যাও ছুটে যাও
মুহূর্ত থেকে মুহূর্তে যাও
বাজাও বাজাও
তোমার বহমানতার ঢাক;
হে বৈশাখ, হে অনন্ত বৈশাখ।
অন্ত থেকে অনন্তে যাও
অঙ্গ থেকে অনঙ্গে
হে বৈশাখ, তুমি খণ্ডকে অখণ্ড করেছো
মহামানবের এ মহাবঙ্গে।
জয় অনঙ্গের জয়
জয় অখণ্ডের জয়
জয় মানবসময়
জয় মানবসময়
জয় মানবসময়

[৩০.১২.১৪২৭-০১.০১.১৪২৮]


মৌ মধুবন্তী :  কানাডার টরন্টোবাসী মৌ মধুবন্তী বর্তমানে বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব কানাডা’র সভাপতির দায়িত্বে আছেন। একজন কবি, আবৃত্তিশিল্পী, সফল সংগঠক ও সঞ্চালক। আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত একজন বাংলা ভাষার নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। ললিতকণ্ঠ আবৃত্তি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ তেরটি,  গল্পগ্রন্থ একটি। তিনি বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও এওয়ার্ড পেয়েছেন তার লেখার জন্য। তার রচিত কবিতার বই আছে তিন ভাষায়। এছাড়াও বহু ভাষায় তার কবিতা নিয়মিত অনুবাদিত হচ্ছে ভিন্ন ভাষার পাঠকের পাঠ সুবিধার জন্য। সম্প্রতি তিনি বারাসত, ভারত থেকে রবীন্দ্র পীচ এওয়ার্ড পেয়েছেন। প্যানোরমা ইন্টারন্যাশনাল লিটারারি ফ্যস্টিভাল তাকে ওম্যান অফ দ্যা ইয়ার এওয়ার্ড দিয়েছে ২০২৩ সালে। বেরুচ্ছে তার কবিতার নতুন বই অক্ষবৃত্তের পদাবলি ও মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা কাব্যগ্রন্থ ‘বিসরিত মন’।

একলা বৈশাখ নট কিশোরের ডাক।।। মৌ মধুবন্তী

এই বৈশাখ! তুই আমাদের ছোটবেলায় ছিলি একলা
কীর্তনডাঙার মাঠে বসত চড়ক সংক্রান্তির মেলা,
চারিদিকে দেখা যেত  বিগ্রহ,আর শিবের গাজন।
নীল পুজোর না-শুকনো শিলা
বসত কত না ঢাকিদের মেলা।
বয়েস বাড়লে বুঝতে পারলাম একলা বৈশাখ
হয়ে গে ছে পহেলা।

মেলার মাঠে ঢাকের বাজনায় ছিল কত ভয় ভালোবাসা
খাজা গজা জিলিপি, মনোহারি দোকানী
চুড়ি মালা ফিতের পসরাঃ আরো  বৈশাখের বাতাসা ।
তখনো আসে না কাল বৈশাখী ঝড়ের তান্ডব নিয়ে
ও পাড়ায় চলছে উলু ধ্বনি সম্ভিকার নাকি বিয়ে ।

সারা দিন ছিল মেলার ভেতর পয়লা বৈশাখ,
শুনেছে চারিদিকে হৈ চৈ  নট কিশোরের ডাক
দেখেছে নট-বালকের বাহিনী,
শুনেছে গোঠের রাখালের কীর্তি কাহিনি।
খোল করতাল যোগে গ্রীবাভঙ্গি করে,
যদি অনন্য -অন্যরকম  বৃষ্টি  নেমে আসে
হারিয়ে যেতাম সবাই সত্যি কাল বৈশাখে।

ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি ঝরতো যদি,
তৃপ্ত হতো  বৈশাখ,
তুষ্ট হতো  শিব ঠাকুরের গদি ।
কীর্তনিয়ার দোলা  খেতো  ভেজা ছোলা
আর আখের গুড়।
কানাই -এর দল ডাকতো শিব ঠাকুর শিব ঠাকুর।
বাড়ির উঠোনে আসত যখন কানাই-এর দল
মা পিসিমারা ঘড়ায় করে  ঢেলে দিতো জল
অবাক বিস্ময়! কি এক উদ্ভট চল।
সেই জলে সিক্ত হত কীর্তনীয়াদের ধূলিমাখা পা,
তাদের জন্য  থাকত
লম্বাপথ পাড়ি দিয়ে আসা  পথিকের জিরানশালা।
মাটির কলসে রাখা                জলসত্র গুড়ের বাতাসা

‘কাল ছিল ডাল খালি / আজ ফুলে যায় ভরে/
বল দেখি তুই মালি/ হয় সে কেমন করে?’-
কে বলেছিল প্রশ্ন করতে করতে
নট কিশোরেরা ধীরে ধীরে মিশে যেতো  মানুষের ভীড়ে ।
একলা বৈশাখও কেমন করে মিশে গেলো আজ
পহেলা বৈশাখে।

(Wednesday, February 12, 2020, 1:15 AM
©®মৌ মধুবন্তী, ২০২০, টরন্টো-কানাডা-পৃথিবী)


ডক্টর আব্দুল হাই সুমন। শানা হক  লেখক নাম। পেশায় কৃষি বিজ্ঞানী এবং বাংলাদেশে সরকারী উর্ধ্বতন ক্যাডার কর্মকর্তা পদে মৃত্তিকা ভবন খামার বাড়ীতে কর্মরত ছিলেন। পেশাভিত্তিক লেখালেখির পাশাপাশি সাহিত্য নিয়েও লিখতেন। বর্তমানে টরেন্টোর বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবি সংগঠনের সাথে কাজ করছেন। তিনি কানাডার প্রোভিন্সিয়াল সরকারের হর্টিকালচারাল গবেষনায় নিয়োজিত।

বৈশাখ বন্দনা ।।। শানা হক

হে প্রলয়ংকরী বৈশাখ, তুমি নিঝুম কেন?
জাগ ঘুম ভাঙ্গো সৃষ্টির প্রসব বেদনায় বজ্র রূপ খোল;
গাছ ভাঙ্গার শব্দে কূল ভাঙ্গার সলিল ফেনায় সুর তোল।
অসীমের গান গেয়ে ঘুমন্ত জাতিকে জাগ্রত কর,
পরাধীন আত্মাকে কর স্বাধীন;
প্রাণে শক্তি দাও সকলকে জয়ের।
প্রলয়ের তাণ্ডব লীলা দেখাও,
গুড়িয়ে দাও যত অন্যায় ব্যভিচার,
বন্দীশালায় হান কঠোর আঘাত ভেঙ্গে কর চুরমার;
ধ্বংস কর যত ভন্ডশালা ভীরুকে দাও আত্মবিশ্বাস।
সত্যের পথে আনো পথভ্রষ্ট মানব দুনিয়ার,
শুদ্ধ কর মানব-সত্ত্বা,  বলে কর বলিয়ান;
বর্ণভেদ ভুলে গিয়ে জাতিকে শিখাও আত্ম-সমালোচনা।
জরাজীর্ণকে মুছে ফেলে আন নতুনের সাজ,
জীবনে ব্যবসায় নববর্ষে হোক তোমার বন্দনা।
কাজে দাও শত উদ্যম জীবন প্রেরণা,
ক্ষমা করতে শিখাও যত ভুল ধারণা,
প্রাণ খুলে শিখাও সকলকে ভালবাসতে;
তবেই আসবে মৃতপ্রায় জাতির প্রাণ।


আলী আজগর খোকন । সঙ্গীতজ্ঞ,লেখক,সমাজসেবক ও সংগঠক আলী আজগর খোকন ১৯৫৭ সালে ১ জানুয়ারী ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। বিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালে নবম শ্রেণিতে প্রথম কবিতা ও দশম শ্রেণিতে প্রথম ছোটগল্প লেখেন। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে অবসরগ্রহণ করেন। ২০১৪ সাল থেকে কানাডার টরন্টোতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। ২০১৮ সাল থেকে ম্যাগাজিন ও বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত কবিতা,ছোটগল্প ও প্রবন্ধ লিখছেন। তিনি বিক্রমপুর এসোসিয়েশন অফ কানাডা’র সভাপতি এবং বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব কানাডা’র সচিব। প্রকাশিত গ্রন্থঃ যৌথ কাব্যগ্রন্থ ‘শত কবির দ্রোহের কবিতা’।

অন্যরকম পহেলা বৈশাক।।। আলী আজগর খোকন

কোথাও কোনো ঢোল বাজলো না
কোনো মঙ্গল শোভাযাত্রা হলোনা
কোথাও কেউ বৈশাখী শাড়ী, পাঞ্জাবী পরে বাইরে বেরুলো না
শহরের কেউ শখ করে গ্রামীন সাজে সাজলো না।

এবার চৈত্র মাসে কেউ ঢাকের শব্দ শুনলো না
বাড়ীর উঠোনে কেউ শিব-গৌরীর নাচন দেখলো না
কোনো বদলি ফসলের মাঠে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটলো না
কারো দেহে চৈত্রের কাঠফাটা রৌদ্রেরঝাঁজ স্পর্শ করলো না।

কোথাও কেউ মাঠে বসে পান্তা-ইলিশ খেলোনা
রাজপথে কেউ কোনো আলপনা
আঁকলো না
কোনো চারুশিল্পীর তুলির আঁচড়ে দেয়ালে ছবি প্রষ্ফুটিত হলোলা
কোথাও কোনো নাচ,গান,আবৃত্তি, মঞ্চনাটক হলোনা।

কোথাও কোন বৈশাখী মেলা বসলো না
কেউ হাডুডু কিংবা দাড়িয়াবান্ধা খেললো না
বিশ্ববাসী করোনার ভয়ে আতংক দরজার খিল এঁটে বসে আছে
মুখোশগুলো অনাদরে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

বিশ্ব বাঙ্গালী আশায় বুক বাঁধে
আবার বাঙ্গালীর মঙ্গল শোভাযাত্রা হবে
আবারও বটতলায় বৈশাখী মেলা বসবে
মাঠ,ঘাট,পথ আবার নাচে-গানে মেতে উঠবে

আবার দলবেঁধে কাস্তে-মাথাল নিয়ে সোনালী ফসল কাটবে
আবার পাখপাখালির কলকাকলীতে গাছে গাছে ফুল-ফলে ভরে উঠবে
আবার রমনার বটমূলে বর্ষবরণে সম্প্রতির সুর বেজে উঠবে।

—————————————————–

১৮ এপ্রিল ২০২৩,নিউমার্কেট, অন্টারিও, কানাডা।


ইউসুফ রেজা । জন্ম ২৮শে মে ,১৯৬২। মাদারীপুর জেলার বহেরাতলা গ্রামে। ১৯৮৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফরাসী সাহিত্যে উচ্চতর ডিপ্লোমা এবং রসায়নে স্নতোকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। অচিরা পাঠচক্র ও বোসব্রাদার্স আয়োজিত সাহিত্য আড্ডার নিয়মিত লেখক সমালোচক ছিলেন। দেশের প্রায় সকল দৈনিক জাতীয় পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশের লিটলম্যাগ ও যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সামাজিক- সংগঠনের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। বর্তমানে জাতীয় কবিতা পরিষদ ও বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্রের সাথে যুক্ত আছেন। বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব বাংলাদেশের তিনি স্বক্রীয় যুগ্ম সচিবের পদে নিযুক্ত আছেন। তিনি বাংলাদেশ, আমেরিকা, কানাডা,তিনদেশেই বসবাস করেন।

জলের দাগ ।।।। ইউসুফ রেজা

আর্ট কলেজের থেকে ভোরের শিশির মেখে মঙ্গল শোভাযাত্রায়
রমনার বটমূলে তিব্বতী থালার মতো যখন এসেছি পায়ে পায়ে
তোমাকে দেখার আগে বস্তুত কোনদিন দম্ভ করিনি
আমি তো শোভাযাত্রা উৎসবের উপযুক্ত পোষাকও পরিনি
জনসমুদ্রের চাপে পূর্ণ মনোযোগ ছিল অবিনাশ শীলের দোতরায়
দুরন্ত বৈশাখী ঝড়ে গ্রীষ্মের লু-হাওয়ায় আমাকে কে পায়।
তারপরও নিয়তির কররেখা ধরে তোমাকে দেখার জন্য আসা
ঘাই হরিণীর মতো মানুষের চোখও হয় এতো ভাসা ভাসা
অড়হর ফুল হয়ে তোমার শরীরে ছিল খয়েরি রঙের এক শাড়ি
কোন দিন ভাবি নাই মেলার মধ্যখানে এরকম সম্মোহিত হয়ে যেতে পারি।
আমরা কি নাগরিক পাথরের অযত্নের থেতলানো ফুলে
এ ভাবেই বিদ্ধ হবো জলের দাগের মতো জীবনের ব্যর্থতম ভুলে।
গ্রীষ্মের খরতাপে পথে পথে ক্লান্তিহীন হেঁটে যেই  সুখ
পহেলা বৈশাখ এলে ইলিশের মতো আমি খুঁজি সেই মুখ।


তাসরীনা শিখা বহুল পরিচিত একজন লেখক,গল্পকার ও সংগঠক।

 

 

কথা ছিলো ।।। তাসরীনা শিখা

কথা ছিলো একসাথে বড় হবো ।
কথা ছিলো দু’জনে একসাথে ঘর বাঁধবো ,
কথা ছিলো দু’জন মিলে সে ঘর সাজাবো ।
ভেবেছিলাম দু’জন মিলে চাকুরী করবো,
ভেবেছিলাম দু’জন মিলে অনেক ঘুরে বেড়াবো ।
ভেবেছিলাম দু’জন একসাথে বুড়ো হবো ,
আর আমরা বুড়ো বুড়ী হাতে হাত রেখে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দেবো ।
কোনো কথাইতো হলো না রাখা।
সে যে বহুদিন আগের তরুন তরুণীর কথা।
বুড়ো হলাম দু’জনে, কিন্তু দু’জন দুই প্রান্তে বসে।
আমাদের আর ঘর বাঁধা হলো না,
সে ঘর  সাজানোই হলো না।
দু’জন দু’জনের মতো চাকুরী করেছি, কিন্তু দু’জনে মিলে হলো না।
জীবনে দু’জনের অনেক কিছুই হলো , কিন্তু এক সাথে কিছুই হলো না।
তরুন বয়েস কোন যুগে হারিয়ে গেলো কিন্তু…
কিন্তু দু’জনের একসাথে হওয়া আর কোন দিন হলো না।
কোন কথাই রাখা হলো না।

-টরন্টো, ক্যানাডা


জালাল কবির  সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলায় জন্ম গ্রহণ করেন। কানাডা এসেছেন ১৯৮৭ খ্রিষ্ট সালে। দেশের  কলেজ   জীবন থেকে ইতস্ত-বিক্ষিপ্ত ভাবে লেখালেখি শুরু করেন। প্রথম যাত্রা  আরম্ব হয় কবিতা দিয়ে তারপর স্বদেশ প্রেমে  উদ্বোদ্ধ হয়ে শুরু করেন দেশের রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে লেখালেখি । পর্যায়ক্রমে  লিখতে শুরু করেন সামাজিক সমস্যা  এবং ধর্মীয় নানা বিষয় নিয়ে।

লেখকের প্রথম প্রবন্ধের বই *বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির রূপরেখা* বইটির পাণ্ডলিপি পাঠ করে চমৎকার মন্তব্য লেখেন জনাব আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী ও জনাব আবেদ খাঁন। তারপর প্রকাশিত হয় *হৃদয়ের একূল ওকূল* নামে একটি কাব্যগ্রন্থ। তারপর প্রকাশিত হয় আরেকটি  বহুমুখি বিষয়ে প্রবন্ধের বই – *বিধ্বস্ত চিন্তাগুচ্ছ *

প্রাকৃতিক এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে মা ও সন্তান ।।। জালাল কবির 

পৃথিবীতে সন্তানের সঙ্গে মাএর সম্পর্ক এবং বাস্তব গুরুত্ব  যে কত অপরিসীম তা বোধ করি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।  চরম বাস্তবতার নিরীখে বিষয়টির কিছু  ব্যাখ্যা আমি দেবার চেষ্টা করবো। আশা করি প্রত্যেক পাঠক নিজ থেকে এর গভীরতাকে অনুধাবন করতে পারবেন। প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে পাখি যখন ডিম থেকে তার ছানা প্রসব করে তখন অধিকাংশ মা-পাখি জানে না, তার সঙ্গী কোথায় ? একটি ছাগল, গাভী, কিংবা মাদী উট  যখন বাচ্চা প্রসব করে তখন সেই বাচ্চাটির দায়িত্ব প্রাকৃতিক ভাবেই মা প্রাণীর উপর বর্তে যায়। কারণ তার বক্ষে থাকে দুধের ভাণ্ডার । এভাবে পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাবো প্রত্যেকটি প্রাণীর  মা প্রাণীটি তার সন্তানের একাই সব দায় দায়িত্ব পালন করছে। বাচ্চার আহার যোগাড়, বাচ্চাকে নিরাপদ রাখা সবকিছুই মা’ কে করতে হয়। অবশ্যই কিছু প্রাণীদের মধ্যে  বাপ প্রাণীটি আংশিক দায়িত্ব পালন করে এবং এসব প্রাণী পৃথিবীতে সংখ্যায় অতি কম।  যেমন বাঘ, সিংহ, হাতি, ভালুক, কুকুর ইত্যাদি।

হাস মুরগির ছানা যখন চিলপাখি ছোঁ মেরে নিয়ে যায় তখন মা’ মুরগি তার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করে। প্রায় সময়ই মা নিজেই আহত হয়। অথচ  বাপ  মোরগ তখন কোথায় থাকে ? তার কোনোও পাত্তাই পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে  বেশ কিছু ব্যতিক্রম দেখতে পাওয়া যায় শিম্পাঞ্জি, গরিলা, ওরাং ওটান, গণ্ডার, হনুমান, এবং বানর জাতীয় প্রাণীদের। আর সমুদ্রের মধ্যে তিমি, ডলফিন, সীল প্রভৃতি বৃহদাকার প্রাণীগুলোর মধ্যে। এই প্রাণীগুলোর মধ্যে যারা বাপ’ প্রাণী হিসেবে নিজেদের মধ্যে চিহ্নিত হয়, তাদের অনেকেই বাচ্চার দায়িত্ব পালন করে। যেমন; মা প্রাণীটি আহার সন্ধান করতে গেলে বাপ-প্রাণীটি বাচ্চা পাহারা দেয় অর্থাৎ সঙ্গে থাকে। বাচ্চাকে বিপদ থেকে বাঁচাবার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। মা ও বাচ্চা যখন উভয়ে বিপদে পতিত হয় তখন বিশেষ ধরণের চিৎকারের ভাষা ব্যবহার করে  বাপ-প্রাণীকে বিপদের সংবাদ জানিয়ে দেয়।  হায়েনা, বানর, ভোঁদড়, নেকড়ে বাঘ, শেয়াল, বন্য গরু, কাক, বাদুর, উড়ো হাস, ইত্যাদি প্রাণীগুলো দলবেধে থাকতে ভালোবাসে। পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে এর প্রধান কারণ হচ্ছে নিজেদের ও বাচ্চাদের নিরাপত্তার জন্যই ওরা দল বেঁধে থাকে। গরিলা, শিম্পাঞ্জি,ওরাং ওটান ও বানর শ্রেণির প্রাণীগুলো মানুষের মতই বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে পারে এবং কোলে কাঁখে বুকে বা কাঁধে বহন করতে পারে। কুকুর বিড়াল হায়েনা ভালুক প্রভৃতি প্রাণীগুলো বাচ্চার ঘাড় কামড়ে ধরে বাচ্চাকে একস্থান থেকে অন্য নিরাপদ স্থানে নিয়ে যায়। এসব বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় আমরা মানুষজাতি হিসেবে আলাদা প্রাণী হলেও অন্যান্য প্রাণীদের আচরণের মধ্যে আমাদের বেশ একটা মিল বা সংযোগ রয়েছে।

মানুষের ভাষা এবং বুদ্ধি এই দুইটি গুণ বিদ্যমান থাকার কারণে আমরা সকল প্রাণী থেকে শ্রেষ্ঠ বা উত্তম হিসেবে নিজেদের বিবেচনা করি। আধুনিক  জীববিজ্ঞানীগণ বাস্তব অভিজ্ঞতা পাওয়ার জন্য মানব শিশুকে জঙ্গলে প্রতিপালন করে দেখেছেন সেই শিশু বিভিন্ন রকম চিৎকার ও বানরের মতো হাত পায়ের ব্যবহার ছাড়া তেমন কিছু আয়ত্ব করতে পারে না। তবে সে যা কিছু দেখে এবং শুনে তার কিছুটা সে স্মরন রাখতে পারে। এই আধুনিক যুগে শিশু এবং উঠতি বয়েসের মানব শিশু যখন হঠাৎ কোনো বিপদে পড়ে তখন তারা যে চিৎকার করে, সেই চিৎকার হুবহু অনেকটা শিম্পাঞ্জি, গরিলা বা বানর প্রাণীদের চিৎকারের মতই।

পাখিদের মধ্যে আমাদের অতি পরিচিত মোরগ, হাঁস, পায়রা প্রাণীগুলো বছর জুড়ে প্রজনন ক্ষমতায় সক্ষম। কিন্তু অধিকাংশ প্রজাতির পাখি এবং স্তন্যপায়ী পশু বছরের কয়েকটি নির্দিষ্টদিন ব্যতীত অন্যান্য সময়ে যৌনানুভূতি অনুভব করে না, কিন্তু মানুষ জাতির পুরুষেরা বছরের ৩৬৫ দিন এবং নারীরা প্রায় ৩০০দিন { ঋতু  স্রাবের দিন বাদ দিয়ে } যৌনাভূতি অনুভব করে। অর্থাৎ তারা ইচ্ছে করলে যৌন মিলনে মিলিত হতে পারে। এটি প্রকৃতির এক বিশাল রহস্য। যে রহস্যের কারণ আজো মানুষ খুঁজে পায়নি। বিজ্ঞানীরা বলছেন হাজার হাজার বছরের   প্রাকৃতিক বিবর্তনের’ কারণে মানুষ জাতি এই শক্তি লাভ করেছে।  প্রাকৃতিক বিবর্তন’ হচ্ছে সৌরজগত এবং মহাবিশ্বের সঙ্গে পৃথিবীর একটি চুম্বক ও আলোকরশ্মির বন্ধন। যে বন্ধন অত্যন্ত রহস্যময়, যা হাজার থেকে লক্ষ লক্ষ বছরে পৃথিবীর তরু ও প্রাণী জগতে কার্যকরি হয়।  এই বন্ধনের প্রভাবে পৃথিবীতে মানুষ ও প্রাণীদের জীনে’ এবং কখনও কখনও  কোশ [কোষ] অণুতেও  মিউটেশান’ বা পরিবর্তন ঘটায়। বিষয়টি অতি ব্যাপক।  মহামতি চার্লস ডারউইন  প্রাকৃতিক নির্বাচন’ মতবাদের মধ্যে এর আংশিক রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন। মানুষ জাতি প্রাকৃতিকভাবে এই যৌনশক্তি লাভ করার কারণে পৃথিবীতে মানুষের সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা অন্যান্য সকল প্রাণীদের থেকে বেশি। তবে কীট পতঙ্গদের এই হিসাবের মধ্যে আনয়ন  করলে পৃথিবীতে পিঁপড়া মশা মাছি ইত্যাদির সংখ্যাই বেশি, আর সমুদ্রে  মা-মাছের গর্ভে ডিম তথা পোনা মাছের সংখ্যাই বেশি।

যাহোক আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল মানব জাতির সন্তানের সঙ্গে মা এর বিষয়টি নিয়ে। সেই বিষয়টি এবারে আলোচনা করবো। উপরের আলোচনা থেকে আমরা বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখতে পাই মা-হচ্ছেন সন্তানের  বেঁচে থাকার শ্রেষ্ঠ আশ্রয়স্থল। আমরা প্রাকৃতিকভাবে আরও দেখতে পাই মা এর সঙ্গে বাচ্চার সম্পর্ক যেমন রক্তের তেমনি অপরিসীম স্নেহের। এই স্নেহ মমতার বন্ধন এতই গভীর, এতই অদৃশ্য চুম্বকময় যে, উহার সীমা পরিসীমা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। আদিমযুগে যখন মানুষের ভাষা ও বুদ্ধির বিকাশ তেমন ঘটেনি, তখন মানব সন্তানের বাপ ছিল অনেকটা দায়িত্বহীন। এযুগের মতো রাষ্ট্রীয় বা ধর্মীয় কোনও আইনের বাধ্য বাধকতায় সে দায়ী  ছিল না। সমাজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা ও নৃতত্ত্ব বিদ্যার ইতিহাস থেকে আমরা এর সত্যতা পাই।  সেযুগে যখন তখন নারী সঙ্গম এবং পশু পাখি শিকার করা ছিল বাপ’ নামে পরিচিত মানুষটির যৌবনের সবচেয়ে বড়ো ব্যস্ততা। যেমন করে ষাড় মোরগা ইত্যাদি প্রাণীগুলো তাদের সন্তানের খবর জানে না।

প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগ, খাদ্যের অভাব এবং অসুখবিসুখে পথ্যের অভাবে অধিকাংশ মানবশিশু তখন মারা যেত। আর এই সন্তান উৎপাদনের শুণ্যতা পুরণ করতো পুরুষ। নারী জাতিরাও সন্তানের কামনায় এগিয়ে আসতো পুরুষের সান্নিধ্যে।  কারণ তখনও পৃথিবীর বহুস্থানে বস্ত্র তৈরি করতে মানুষ শিখেনি। অন্যান্য প্রাণীদের মতো যৌনকর্ম তখন পরিবারের বা সমাজের সবাই পাপহীন বিশ্বাসে উপভোগ করতো। যার ফলে যৌন বিষয়টি মানুষ জাতির মধ্যে লজ্জা হিসেবে স্থান পায়নি। বিষয়টি প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিকভাবেই মানুষ গ্রহণ করতো। বিষয়টির সত্যতা জানার জন্য আমাদেরকে আর্কেওলজি কিংবা এনথ্রোপলজির [প্রতœতত্ত্ব ও নৃতত্ত্ব] আওতায়  ব্রোঞ্জের যুগ বা লৌহের যুগে যেতে হবে না। এই বিংশ শতাব্দীর দক্ষিন আমেরিকার আমাজনের গহিন জঙ্গলে এবং পাপুয়া নিউগিনির মতো দেশের  জঙ্গলে  এখনও অনেক উপজাতি লোক বসবাস করছে। এছাড়া আফ্রিকার মালি, তাঞ্জানিয়া এবং এশিয়ার মায়ানমার ও থাইল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলে বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে আদিম সভ্যতার নানাবিধ কালচার এখনও বিদ্যমান। রাষ্ট্রীয় অনুমতি, উপজাতি সর্দারের অনুমতি এবং দোভাষী ও পর্যটক সাংবাদিকের সহায়তায় এসব দেখা এবং জানা আজও সম্ভব।

ধীরে ধীরে  সময়ের সহস্রাব্দির স্রোতে [প্রায় দুই থেকে আড়াই লক্ষ বছর অতিক্রম শেষে] মানুষ আপন আপন বুদ্ধির জোরে ভাষা ও জীবন ধারণের জন্য চাষাবাদ সহ বহুমুখী পণ্যের উৎপাদন শুরু করে। মানুষ সময়ের ধাপে ধাপে অসভ্য থেকে আরও সভ্য হতে লাগলো। আদিম যুগের প্রচলিত বিশ্বাসের ধর্মগুলোর অনেকটাই বিলুপ্ত হতে থাকলো। আর সেই স্থান ধীরে ধীরে দখল করে নিলো নতুন নতুন ধর্ম। এভাবে পৃথিবীর বুক থেকে হাজার হাজার ধর্মের বিলুপ্তি ঘটেছে। ইতিহাসবিদরা নানাবিধ তথ্য যোগাড় করে প্রমান করেছেন যে, মানুষ জাতির সভ্যতার সূচনা হয় নতুন পাথরের’ যুগ থেকে। অর্থাৎ আজকের সময়-সাল থেকে এগারো হাজার পাঁচশত বছর আগে। তারপর সভ্যতার নতুন যুগ হিসাবে আর্বিভাব হয় লৌহ যুগের।

সভ্যতার মাপকাটির গড় হিসাবে কালের পরিপ্রেক্ষিতে সভ্য হিসেবে অধিকাংশ দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের দাবী হলো মানুষজাতির অবিস্মরণীয় উন্নতির শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব তিনহাজার একশত সাল থেকে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার একশত চোদ্দো বছর পূর্বে। [যা লৌহ যুগের অর্ন্তভুক্ত] তা শুরু হয় আজকের মিশর থেকে শুরু করে সিরিয়া,ইরাক ও ইরান পর্যন্ত।  ঐতিহাসিকগণ সময়ের বিবেচনায় এই সাম্রাজ্যকে  আপার ইজিপ্ট ও লোয়ার ইজিপ্ট দুই ভাগে ভাগ করেন। সর্বমোট  বিশটি  ফেরাউন রাজবংশ এই রাজ্য শাসন করে। প্রথম ডাইনাষ্টি বা রাজবংশের রাজার নাম ছিল হরআহা’ আর সর্বশেষ ডাইনাষ্টির খ্যাতিমান রাজা হচ্ছেন রামাসিস-দ্বিতীয়। এরপর যথাক্রমে লিবিয়া, পারস্য [পারসিক] গ্রিক বংশউদ্ভোত ফেরাউনরা মিলে ১১টি রাজবংশ মিশর সাম্রাজ্য শাসন করে। তাদের মধ্যে সর্বশেষ ডাইনাষ্টি হচ্ছে   টলেমি’ এবং তাদের রাজত্ব শেষ হয় খ্রিস্টপূর্ব ত্রিশ সালে। এরপর এই সাম্রাজ্য রোমের অধীনে চলে যায়। এই পৃথিবীর বুকে সভ্যতার এত পরিবর্তন  হয়েছে যে এটা অনুমান করা কিংবা বিশ্বাস করা অত্যন্ত কঠিন।

তা সত্ত্বেও  সন্তানের প্রতি মায়ের স্নেহ মমতার কোনও ঘাটতি আজও হয়নি। তবে দায়িত্ব থেকে পলায়নপর বাবারা পেয়ে গেছেন অধিক দায়িত্ব। আর এই দায়িত্বকে মেনে নেবার জন্য যারা প্রয়োগ ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করেছে তারা হলেন বিভিন্ন সময়ের প্রজা হিতৈষী রাজাগণ আর বিভিন্ন ধর্মের প্রবর্তক ও প্রচারকগণ। তাই আজকের সভ্যতায় এসে আমরা বিয়ের মাধ্যমে মনের আবেগ ও  দৈহিক চাহিদ মেটাই এবং পরিবার গড়ে তুলি। কোনও কোনও সমাজে বন্ধুত্ব¡ ও ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ  হয়ে নিজেদের রুচি মাফিক পরিবার গড়ে তুলি। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা আর রাষ্ট্রীয় সামাজিক অবস্থার উপরে এক এক সমাজে এক এক ধরণের ধর্মীয় বিধি নিষেধ স্থাপিত হওয়াতে নারী ও পুরুষরা তাদের ব্যক্তিস্বাধীতার কিছু কিছু বিষয় হারিয়ে ফেলেছে। তা সত্বেও সবাই নিজ নিজ সন্তানকে পৃথিবীর যেকোনও কিছুর চেয়েও বেশি ভালোবাসে। উপরে সভ্যতার ঐতিহাসিক দিকটি নিয়ে আলোচনার অর্থ হলো পৃথিবীতে সভ্যতার এত পরিবর্তন কিংবা বিবর্তন হওয়া সত্ত্বেও সবযুগে এবং সবকালে  মাতৃস্নেহের কোনও পরিবর্তন তেমন হয় নি। যা হয়েছে তার কারণ শিল্পবিপ্লব ও পুঁজিবাদের ব্যস্ততার কারণেই হয়েছে। তাই বলছি মাতৃস্নেহ যেমন অগাধ বিশ্বস্ত তেমনি তা অতুলনীয়। মায়ের অপরিসীম স্নেহ মমতা সন্তানের জন্য চিরউজ্জ¦লতায় ভাস্বর।

-(টরন্টো, কানাডা)


শেখ জলিল । পারিবারিকভাবে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছেন শেখ জলিল। খুব ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য ও সঙ্গীতের সাথে জড়িয়ে আছেন তিনি। আশির দশকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়াকালীন সময়ে ঘটে সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার পূর্ণ বিকাশ। ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদ, উদীচি শিল্পীগোষ্ঠি, ময়মনসিংহ সঙ্গীত বিদ্যালয়, শিল্পকলা একাডেমি, বৃন্দ আবৃত্তি সংসদসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে নিজেকে জড়ান তিনি। সে সময় থেকেই জাতীয় পত্র-পত্রিকায় কবিতা, গল্প, ছড়া, বিভিন্ন ফিচার এবং রিপোর্ট প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর। লেখালেখির পাশাপাশি টুকরো সাংবাদিকতাও করেন। এরপর নব্বই এর দশকে গানের ক্যাসেটের মাধ্যমে গীতিকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। তখন থেকেই তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার।

বর্তমানে কানাডার এডমন্টন শহরে বসবাসরত  শেখ জলিল পেশার পাশাপাশি নেশা হিসেবে এখনও লিখে চলেছেন গান, কবিতা, গল্প এবং উপন্যাস। তিনি জড়িত আছেন বাংলাদেশ কানাডা এ্যাসোসিয়েশন অব এডমন্টন (বিসিএই)সহ কানাডার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে। সাংবাদিকতা করছেন ক্যালগেরি থেকে প্র্রকাশিত আলবার্টার প্রথম অনলাইন নিউজ ‘প্রবাস বাংলা ভয়েস’ পত্রিকায়

সাঁতার জানি না আমি… ।।।।  শেখ জলিল

তুমি ধন্যি বুনো সহচরি
জলে নেমে হয়ে যাও পরি
আমি ভয় পাই হাঁটু জলে
কখন জানি ডুবি অতলে
সাঁতার জানি না আমি!

কী উন্মত্ত এই দিবাযামী
মন্থনে মন্থনে ভরা ঢেউ
মাতাল চকোরী পিছে ফেউ
স্বপ্নে পরির উত্থান দেখি
সত্যিই জোয়ার নাকি মেকি?

নিকানো সৈকতে লেখালেখি
কবে তার সমাপ্তি জানে না
বেলাভূম সীমানা মানে না
চাঁদ ও চকোরে আনাগোনা
এ কী বাস্তব নাকি কল্পনা!

বুনো সঙ্গীত হয় নি শোনা
দ্বিধার সংকটে বাড়ে ঢেউ
আশেপাশে দেখছে কি কেউ
হাঁটু জলে হাঁটে জলপরি
ভাবছি ভুলে হাতটা ধরি।

—-
শেখ জলিল ১৩.০৫.২০২০


ঋতুশ্রী ঘোষ।
লেখা : কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই : তিনটি – ১.জীবন্ত আতস কাঁচ ২.আকালিক উপাখ্যান ৩.একনিষ্ঠ মৃত্যু।

 

 

নিভিয়ে  দাও  আলো, নিভিয়ে  দাও  আলো  ।।। ঋতুশ্রী ঘোষ

তোমাকে  যা  বলার  অপেক্ষায়  ছিলাম  এতকাল
বলতে  পারিনি  বুকে  সাহস  করে,
অচেনা  এক  আগন্তুক  নারী
বলে  দিলো  তার  একান্ত  অবসরে।
মুখ  ফিরালে  সেই  মুখপানে …….

তার  মুখে  গড়ে  তোলা  সুক্ষ  কারুকাজ
ছদ্মবেশী  পোশাকে  আলোড়িত  সাজ।
আমার  গরদ  শাড়ি  কৃষ্ণচুড়া  পাড়,
তোমায়  ঘিরেই  আমার  আজন্ম  অধিকার।
এ কোন  প্রেমের  কাল- দিগন্ত   অভিমান ,
নিঃসাড় প্রতিবাদে  ঢাকা  দাসত্বের বলিদান।

নিভিয়ে  দাও  আলোদের  ভিড়!
প্রাত্যহিক  কাল্পনিক  অনাবৃত  শরীর।
শরীর  জুড়ে  বেড়ে  উঠুক
ঘৃণা  আর  অবহেলার  বিষাক্ত  শেকড়ের  ভিড়।

ঝর্ণার  মতো  আমার  সুদীর্ঘ  কালো  চুল  বেয়ে  ঝরে  যাক –
তোমার  ক্রূর  অমানবিক  বোধ ,
নিভিয়ে   দাও    আলো , নিভিয়ে   দাও    আলো!
সমাজের  চোখে  দাও  ধুলো , নাও  প্রতিশোধ।

নিভিয়ে   দাও    আলো , প্রত্যহ  প্রতিটি  প্রাণী  ভাবুক –
রাতের  আঁধারে  যুগ্ম  সত্ত্বা  ডুবে  যাচ্ছে  স্বর্গীয়  সুখে ,
তুমি  আজও  চেয়ে  আছ  সেই  কারুকাজময়  মুখে   …..
নিভিয়ে   দাও    আলো , নিভিয়ে   দাও  আলো!
বাহ্যিক  সৌন্দর্যে  সীমাবদ্ধ  জীবন  তোমার
নিভিয়ে  ফেলো  আমার  চিরায়ত  আবেগময়  অধিকার।

নিভিয়ে  দাও    আলো ,নিভিয়ে  দাও  আলো  … … …
রাতের  আঁধারে  সিঙ্গেল  বালিশে  লুকিয়ে  থাক
তোমার  নির্বিকার  বীভৎসতায় – আমার  চোখের  জল।
নিভিয়ে  দাও  আলো, নিভিয়ে  দাও  আলো  … … …


কানাডার কিংস্টনবাসী লেখক মানসী সাহা শিক্ষকতা করছেন লাইমস্টোন ডিসট্রিক স্কুল বোর্ডে। সাহিত্য অনুরাগী মানসী সাহা শুধু একজন লেখক হিসেবেই নয় ছায়ানট সংগীত প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা প্রাপ্ত একজন সঙ্গীতশিল্পী ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে বাংলাভাষা ও সংস্কৃতিকে নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেবার এবং কানাডীয় সাংস্কৃতিক মোজাইকে বাংলাকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। মহান একুশে বইমেলায় সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণালব্ধ গ্রন্থ “হৃদয়ে জাগে একাত্তরঃ ভাটি বাংলায় গণহত্যা। সাহিত্যিক কৃতিত্বের জন্য মানসী সাহা প্যানোরামা আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩ লাভ করেন।

আনন্দ জয়গান ।।।। মানসী সাহা

জাগো, দেখো আলোর রশ্মি
ছুঁয়েছে ভোরের পথ।
আলপনার আঁচল মাড়িয়ে যেতে সংশয় যত,
মুখোশের ভিতর লুকানো আলোয়
আকস্মিক শঙ্কা !
মহেঞ্জোদারোর একশৃঙ্গি শ্বেত অশ্বকে এতো ভয়!
সে তো মঙ্গলের আহবানে ছুটে আসে রক্ষাকবচ হয়ে।

আগুনে লেখা বৈশাখীনামায় এখনো কেন চৈত্রের খরতা?
শান্তি-সংগীতে জাগো,
শোনো!
দিকে-দিগন্তে ভৈরবীতে বাজে আনন্দ জয়গান।

 



এসএস/সিএ

 

 

সংবাদটি শেয়ার করুন