পূর্ব প্রকাশের পর…
শরনার্থী ক্যাম্প, শৈশবের চোখে মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ |||| সদেরা সুজন || শেষ পর্ব
বাংলাদেশ হানাদার বাহিনী মুক্ত হবার পরপরই অনেক শরনার্থীরা ক্যাম্প থেকে দেশে ফিরা শুরু করলো। সম্ভবত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে বড় ভাই একটি পুরাতন মডেলের ট্রাক নিয়ে গিয়েছিলেন আমাদেরকে ভারতের ক্যাম্প থেকে স্বদেশে ফিরে আনার জন্য। ট্রাকের ড্রাইভিং সীটে বাবা-মা-ঠাকুরমা আর ছোট ভাই সঞ্জয় বসেছিলো। আমরা পাঁচ ভাই-বোন ট্রাকের পিছনে জিনিসপত্রের উপর বসে ছিলাম।
গাড়ীতে বাঁশের মধ্যে লাগানো স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ছিলো। রাস্তা দিয়ে আসতে দেখছিলাম, ঠিক আগের মতো রাস্তা ভরা মানুষের অরন্য। মানুষেরা ফিরে আসছে স্বদেশের দিকে, নিজ বাসভূমে হোক না ক্ষত-বিক্ষত স্বজনহারা শ্মশানভূমি। সবার মুখে আনন্দ উচ্ছ্বাস। বড় ভাই কিছু সময় পর পরই জয় বাংলা শ্লোগান দিচ্ছেন আর আমরা অন্যান্য ভাই বোনরা তার গলায় গলা মিলিয়ে জয় বাংলা বলে চিৎকার করছি। আমাদের চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় থাকা মানুষরাও ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করছে। একে অপরকে হাত নেড়ে স্বাগতম জানাচ্ছে। ইস্ সেদিনের আনন্দ আজো ভুলতে পারছি না।
শরণার্থী ক্যাম্প থেকে ফিরে দেখি শত বছরের স্মৃতিঘেরা সম্পূর্ণ বাড়িটি একটি ধ্বংসস্তুপ। বাড়ির অস্থাবর সম্পত্তি বলতে কিছুই ছিলো না। বাড়ির পাকা ঘর ভেঙ্গে রড ও নিতে ভুল করেনি লুটেরা হায়েনারা। বাড়ির গাছ-বাঁশ কেটে সবই নিয়ে গিয়েছিলো। বাড়িটি ছিল দেখতে একটি শ্মশাানভূমি। তারপরেও সবাই আনন্দিত ছিলো নতুন বাংলাদেশে। জয় বাংলার জয়ে। বড়দের কাছ থেকে শুনেছি দেশে স্বাধীন হবার পূর্বমুহূর্তে চারিদিকে শুধু লাশের গন্ধ। বাংলার আকাশ-বাতাস পচা লাশের গন্ধে ভারি হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু বাংলার বিজয়ের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত কেউ জানত না কত লাখ মানুষকে হত্যা করে খালেবিলে নদীতে জঙ্গলে ফেলে রেখেছে ঘাতক হায়েনা আলবদর আর পাকবাহিনীরা। বিজয়ের পর সারাদেশে এক এক করে আবিস্কৃত হতে থাকে বধ্যভূমি। কমলগঞ্জের আনাচে কানাচে অসংখ্য বধ্যভূমি পাওয়া যায় যেখানে অগনিত মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়েছিল।
ভানুগাছ-শ্রীমঙ্গল সড়কের মধ্যবর্তী বর্তমানে বিদেশী সংস্থা হীড বাংলাদেশের পাশেই ঘন অরণ্যের মধ্যে একটি পাকা ঘর ছিলো। সেই ঘরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্থানীয় রাজাকার নেতা-পাকি আর্মী দিয়ে অসংখ্য মানুষ হত্যার নায়ক নেতৃত্বে মা-বোনদের ওপর অমানষিক বীভৎস নির্যাতন চালাতো। যুদ্ধের অনেক বছর পর যখন সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলাম তখোন এলাকার বয়োবৃদ্ধ মুরব্বীদের মুখে অনেক সত্য মর্মস্পর্শী করুণ কাহিনী শুনেছি। এসব কষ্টের কাহিনী নিয়েই একটি বই লেখা যাবে। সেই ঘরটির মতো অসংখ্য ঘর তৈরী করেছিলো এসব রাজাকার হায়েনারা। কতো শত শত মা-বোনের ইজ্জত হনন করে মেরে ফেলে দেওয়া হতো বলে মুরব্বীরা বলেছেন। বাগানের চা শ্রমিকের যুবতী কন্যা কিংবা হিন্দু পরিবার যারা ভারতে যেতে পারেনি তাদেরকে এনে সেখানে নির্যাতন করা হতো। যৌবনের প্রারম্ভে ভানুগাছ থেকে শ্রীমঙ্গল যতোবার গিয়েছি ততোবারই সেই ঘরটি দেখে মনে পড়ে গেছে ১৯৭১ সালের সেই বর্বরতার ছবি অসংখ্য অসহায় মা-বোনের আর্তনাদ আর কষ্টের আকাশ কাঁপানো চিৎকার যেন আমি শুনতে পেয়েছি। সেই ঘরের সম্মুখ দিয়ে যতোবার গিয়েছি ততোবারই আমার কানে যেন ভেসে উঠেছে পাহাড়ী পোকা পাখির ডাক আর শব্দের মধ্যে ইথারে ভেসে যেতো শত শত নারীর করুণ আর্তনাদ, প্রাণ আর ইজ্জ্বত বাঁচানোর প্রার্থনা। কমলগঞ্জের অসংখ্য স্বাধীনতাকামী মানুষ হত্যা আর নারী ধর্ষনের নায়ক একাত্তরের নর ঘাতক রাজাকার-বাহিনীর প্রধান হানাদার বাহিনীর সহযোগিরা রয়েছে অনেকের নাম শুনলে এখনও মানুষ ভয় পায়। ওরা ভয়ঙ্কর ক্ষমতাধর শক্তিবান আতংক। এদের নেটওয়ার্ক সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে। স্বাধীনতার অনেক বছর পরও এসব একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীরা অর্থ-বিত্ত শক্তি-ক্ষমতায় শীর্ষে। এদের বিচার হয়না বরং দিনের পর দিন ওরা আরো বেশী শক্তিশালী হচ্ছে।
স্মৃতিচারণের অন্যান্য পর্বগুলি পড়তে হলে
শরনার্থী ক্যাম্প, শৈশবের চোখে মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ |||| সদেরা সুজন || পর্ব ৫
শরনার্থী ক্যাম্প, শৈশবের চোখে মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ |||| সদেরা সুজন || পর্ব ৪
শরনার্থী ক্যাম্প, শৈশবের চোখে মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ |||| সদেরা সুজন || পর্ব ৩
শরনার্থী ক্যাম্প, শৈশবের চোখে মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ |||| সদেরা সুজন || পর্ব ২
শরনার্থী ক্যাম্প, শৈশবের চোখে মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ |||| সদেরা সুজন || পর্ব ১
৪৯ বছর পরে বাংলাদেশের দিকে থাকালে আমার শত বছরের ঐতিহ্যবাহি বাড়ির দিকে চাইলে বড্ড কষ্ট হয়। এমন বাংলাদেশ কি আমরা চেয়েছিলাম? কষ্ট হয় যখন দেখি স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার আলবদর খুণি বদমাইশ হায়েনা মৌলবাদি ঘাতকদের জয় জয়কার, মনে হয় যেন দেশটা সৃষ্টি হয়েছিলো এসব ঘাতকদের জন্যই। এমন কষ্ট আর জীবনে কী হতে পারে? ত্রিশ লাখ শহীদ, দু’লাখ মাবোনের সম্ভ্রমে আর রক্ত সাগরের বিনিময়ে ক্ষত-বিক্ষত দেশের যেদিকে থাকাই সেদিকেই দেখি আজ সহস্র সহস্র মৌলবাদি স্বাধীনতা বিরোধী খুণি দানবদের উত্থানে প্রকম্পিত সোনার বাংলাদেশ, এরচেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে, ১৯৭১ সালে নিজ চোখে দেখা যুদ্ধ-বিধ্বস্ত সময়ের শৈশব জীবনে।
যতদিন চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্র মাটি মানুষ পৃথিবী আলো-বাতাস থাকবে ততোদিন বাংলাদেশে বেঁচে থাকবে। রক্তগঙ্গা প্রবাহিত স্বজন হারানোর বেদনার স্রোতে ভাসতে ভাসতে এই প্রিয় বাংলাদেশের জন্ম আমি দেখেছি, এটা আমার জন্মের সবচেয়ে বড় পাওনা সবচেয়ে বেশী গর্বের। আমৃত্যু আমি বলতে পারবো আমি একটি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দেখেছি।
শ্রীনাথপুর শরনার্থী ক্যাম্প থেকে এসে আবারো আশ্রয় নেই বাড়ির পাশেই নবনির্মিত কমলগঞ্জ সরকারী হাসপাতালের ডাক্তারের একটি বাসায়। তখনও হাসপাতাল চালু হয়নি শুধু বিল্ডিং নির্মান হয়েছিলো। সেখানেও আমাদের গ্রামের সবাই আশ্রয় নিয়েছিলো। সেখানে কয়েক মাস থেকে আমাদের বাড়ি মেরামত করে বাড়িতে ফিরি। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমরা বাড়ি ছেড়ে ভারতের উদ্দ্যেশে যাবার আগেই স্বাধীনতা বিরোধীরা বাড়ির শত বান টিন দরোজা-জানালা- চৌকি-পালং-টেবিল-চেয়ারসহ অস্থাবর সব জিনিস নেওয়ার জন্য শকুনের থাবার মতো বাড়ি থেকে সব কিছু লুটতে থাকে। ওরা ভেবেছিলো দেশ আর কখনো স্বাধীন হবে না, আর আমরাও আর কখনো বাড়িতে ফিরবো না। এসব জিনিস নেওয়ার জন্য কি অদ্ভুত প্রতিযোগিতা চলছিলো। যারা আমাদের বাড়িতে দীর্ঘদিন আমাদের জমিতে চাষাবাদ করে জীবন সংসার চালিয়েছে আবার যারা আমাদের বাড়িতে কাজ-কাম করে পরিবার চালিয়েছে কিংবা যারা ভদ্রতার লেবাসে আমাদের সঙ্গে মিশেছে তারাই আমাদের বাড়ির সব কিছু নেওয়ার জন্য হিংস্র হয়ে উঠেছিলো চোখের পলকে রক্তচক্ষু দেখিয়ে সব কিছু লুটে নিয়েছিলো যা পূর্বেও লিখেছি। বাবাও নীরবে অশ্রুপাত ঘটিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হবার পর আমরা দেশে ফিরে এসে সরকারী হাসপাতালে আশ্রয় নিলে এসব হায়েনা লুটেরা আমাদেরকে সহানুভূতি দেখানো জন্য কত সুন্দর সুন্দর কথা বলতে থাকে। যেনো ওরা কোনো কিছুই করেনি। আমরা হাসপাতালে থাকাবস্থায় যখন বাড়ি নির্মানের কাজ চলছিলো তখন আমাদের লুটে নেওয়া অস্থাবর সম্পত্তি চৌকি-টেবিল-চেয়ারগুলো রাতের অন্ধকারে কিন্নীগাঙের পাড়ে নাম লিখে রেখে যেতো। এসব লুটেরা বুঝেছিলো দেশ যখন স্বাধীন হয়ে গেছে আর আমরাও স্বদেশে ফিরে এসেছি ফলে এসব লুটের জিনিস তাদের পক্ষে হজম করা সম্ভব নয়। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা ভানুগাছ বাজারে যুদ্ধাপরাধি রাজাকারদের বিরুদ্ধে এ্যাকশন কমিটি বানিয়েছিলো। সেখানে রাজাকারদেরকে ধরে এনে শাস্তি দেওয়া হতো। তবে রাজাকাররা ছিলো খুব চালাক ওরা পালিয়ে গিয়েছিলো। দেশে ফিরে সারা বাড়ি ধ্বংস্তুপের মাঝেও ফিরে পেয়েছিলাম আমাদের প্রিয় কুকুর টমটমকে। মাসের পর মাস অভুক্ত থেকেও বাড়ি পাহাড়া দিয়েছে। স্বাধীনতার দু বছর পর রাতের আঁধারে কে বা কারা বিষমাখা ভাত খাবার খেয়ে টমটমকে মেরে ফেলেছিলো ।
দেশ স্বাধীন হবার পর অটোপ্রমোশনে ক্লাস থ্রিতে ওঠি। লেখাপড়া দুরন্তপনায় আবার মেথে ওঠি, ধীরে ধীরে যুদ্ধের ক্ষত বিক্ষত বিধ্বস্ত দিনের কথা ভুলতে থাকি। প্রাইমারি স্কুলে পড়াকালীন সময়ে ইউনিসেফ- রেডক্রসসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দেওয়া সাহায্য আমরা স্কুল থেকে পেতাম। খুব সুন্দর সুন্দর খাতা-পেন্সিল, পাউডার দুধ, বিস্কুটসহ বিভিন্ন ধরনের জিনিস। ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ আর ১৬ ডিসেম্বরসহ বিভিন্ন জাতীয় দিবসে বড় ভাই আর বড় বোনদের পিছনে পিছনে রাত ১২-০১ মিনিটে শহীদ বেদিতে খালি পায়ে পুস্পস্তবক অর্পন করে ‘শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেবোনা’ বলে শ্লোগান দিতে দিতে চলে আসে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। তখন সবেমাত্র হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছি।
চলবে…
সদেরা সুজনঃ প্রধান নির্বাহী, কানাডা-বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি সিবিএনএ, কানাডা
শরনার্থী ক্যাম্প, শৈশবের চোখে মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ |||| সদেরা সুজন || শেষ পর্ব ⇒ আ গা মীতে থা ক ছে ভারতের পথে পথে । ভ্রমণ কাহিনী
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন