মুক্তিযুদ্ধ

শরনার্থী ক্যাম্প, শৈশবের চোখে মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ |||| সদেরা সুজন || পর্ব ৫

শরনার্থী-ক্যাম্প-পর্ব-৫

পূর্ব প্রকাশের পর…

শরনার্থী ক্যাম্প, শৈশবের চোখে মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ |||| সদেরা সুজন || পর্ব ৫

শ্রীনাথপুর শরণার্থী ক্যাম্পে বাংলাদেশের মানুষের দুঃসময়েও প্রতি সপ্তাহে দু’দিন সকালে অনুষ্ঠিত হতো শিশু কিশোরদের জন্য অনুষ্ঠান, সেখানে চলতো মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গান, নাটক আর নতুন জাতীয় সঙ্গীতের সুর। সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ সাহায্য করা হত। আমরা শিশু-কিশোররা বড়দের গলার সঙ্গে সুর মিলিয়ে গেয়েছি  “আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালবাসি/চিরদিন তোমার আকাশ ।।/তোমার বাতাস/আমার প্রানে/….   মা তোর বদন খানি মলিন হলে/আমি নয়ন/ওমা আমি নয়ন জ্বলে ভাসি/সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি… ।” খেলনা পিস্তল নিয়ে আমরা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলেছি। আমাদের ক্যাম্পে দুর্গা পূজাসহ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নাটক হতে দেখেছি। দূর্গা পূজা উপলক্ষে বাগান এলাকায় বিশাল মেলা বসেছিলো। এত সুন্দর সুন্দর জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসেছিলো। কিন্তু ঘুরে ঘুরে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিলো না। কিছুই ক্রয় করার মতো সামর্থ ছিলো না। একদিন মা’র কাছ থেকে দু’টাকা নিয়ে খেলনা পিস্তল কিনেছিলাম সঙ্গে লাল বারুদভরা গুলির রীল। তাদিয়েই চললো দু’দিন মেলার আনন্দ।

বাবার সঙ্গে প্রতি সপ্তাহে যেতাম রেশন তুলতে। রেশনের মধ্যে থাকতো চাল-ডাল-তৈল- পেঁয়াজ-মশলাপাতির গুঁড়ো, কেরোশিন, দিয়াশলাই, কম্বল, কাপড় ধোয়ার সাবান, ঔষধ, নগদ অর্থসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় আর কত কি! কত সপ্তাহ গেছে মাংসতো চোখে দেখেইনি, মাছও ভাগ্যে জুটতো না। প্রায় প্রতি দিনই হতো খিচুরী অথবা আলু সিদ্ধ নয়তো ডালভাত। কতদিন ক্ষুধার জ্বালায় কষ্ট পেয়েছি। আমি ছিলাম এক পেঠুক শিশু। বাড়িতে মুড়ির লাড্ডু থেকে সন্দেশ, দুধের সর সবই আমি খেয়ে ফেলতাম ফলে ক্যাম্পের সেই ক্ষুধার জ্বালায় রাগ হতো ভীষণ, কিন্তু করার কিছুই ছিলো না। বাবা-মার বিধ্বস্ত বিষন্ন ভরা করুণ দৃষ্টিই বুঝে নিতাম, তাঁরা অসহায়।

আমাদের ক্যাম্পের পাশেই ছোট একটি গ্রাম্য বাজার ছিল। বলতে গেলে শ্রীনাথপুর ক্যাম্পের মধ্যখানে। হাজার হাজার শরণার্থী ভরপুর এই ক্যাম্পের প্রতিদিন বাজার লোকসমাগমে গরম হয়ে উঠতো। সেখানে আমি প্রায়ই যেতাম। কখনো বাবার সঙ্গে আবার কখনো বন্ধুদের সঙ্গে। আমার মনে হয় সেই বাজারের সব দোকানেই রেডিও ছিলো আর সবাই রেডিওগুলো হাই ভলিয়মে চালাতো। প্রথমে বুঝতে পারিনি কী জন্যে ওরা এরকম করছে আর প্রতিটি দোকানেই একই স্টেশনের অনুষ্ঠান চলতো। একদিন বাবাকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, সবাই বাংলাদেশের যুদ্ধের খবর জানতে চায় ফলে সবাই আকাশ বাণী কোলকতা কিংবা কখনো বিবিসির সংবাদ বাজায়। সে সময়ে আকাশ বাণীর সংবাদ ও সংবাদ পর্যালোচনা পড়তেন নীলীমা সন্যাল ও দেবদুলাল বন্ধ্যোপধ্যায়। কী অদ্ভুত সুন্দর হৃদয় নিংরানো প্রাণের স্পর্শে সংবাদ পর্যালোচনা পড়তেন ।


স্মৃতিচারণের অন্যান্য পর্বগুলি পড়তে হলে

শরনার্থী ক্যাম্প, শৈশবের চোখে মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ |||| সদেরা সুজন ||  পর্ব ৪
শরনার্থী ক্যাম্প, শৈশবের চোখে মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ |||| সদেরা সুজন ||  পর্ব ৩
শরনার্থী ক্যাম্প, শৈশবের চোখে মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ |||| সদেরা সুজন ||  পর্ব ২
শরনার্থী ক্যাম্প, শৈশবের চোখে মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ |||| সদেরা সুজন ||  পর্ব ১

এমন সংবাদ পর্যালোচনা শুনে বড়দের চোখ দিয়ে অপ্রতিরোধ্য অশ্রু ঝরে পড়তে দেখতাম। তাঁর সংবাদ পর্যালোচনার কথা আমি আমৃত্যু ভুলতে পারবো না। সেই শৈশবের শোনা বাংলাদেশের যুদ্ধের ওপর মর্মস্পর্শী সংবাদ পর্যালোচনা আজ ৪৯ বছর পরও একটু ভুলতে পারিনি, বরং আমাকে বার বার নিয়ে যায় একাত্তরের সেই দুঃসহ দিনগুলোর মাঝে।

না আমি মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম না, একাত্তরের ভয়াবহ দিনগুলো ছিলো আমার একান্তই শৈশব। তারপরে দেখেছি যুদ্ধের বীভৎসতা, শুনেছি নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের দীর্ঘাহিত সারি, দেখেছি মানবতার পদপৃষ্টতা, দেখেছি ধ্বংসযজ্ঞের নির্মমতা। ক্ষত-বিক্ষত রক্তের বন্যায় প্রবাহিত শোকার্ত জনপদের খবর ছেলো সেদিন বিশ্বের সবচেয়ে প্রধান এবং আলোচিত সংবাদ। মানুষের প্রিয় জীবন্ত শহর গ্রামগুলো মৃত্যুপুরী আর ধ্বংসস্তুপে সংবাদ প্রতিদিন আমাদের শুনতে হতো।

শরনার্থী ক্যাম্পে বন্ধু-বান্ধবদেরকে নিয়ে বেশ ভালোই ছিলাম। লেখাপড়া করার জন্য তাড়া নেই, মারামারি-হানাহানির জন্য বাবার মার খাওয়া নেই। সারা দিন সকাল-সন্ধ্যা ক্যাম্পের এ মাথা থেকে অন্য মাথা ঘুরতাম, মারবেল, ডাংগুলি খেলতাম। বড় ভাই ক্যাম্পে ফিরেন নি অনেক দিন, তিনি বাংলাদেশের ভিতরে যুদ্ধ করছেন। বাবা মা তাকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। হঠাৎ করেই একদিন শোনা গেল দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। সেদিন কি আনন্দ। সারা ক্যাম্পের আবালবৃদ্ধবনিতা রাস্তায় বের হয়ে জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে আনন্দ আর উল্লাসে ফেটে পড়েছিলো। ক্যাম্পের পার্শ্বেও বাজার থেকে মাইক দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা (১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের খবর) লাভের খবর, ভারতীয় মিত্র বাহিনীর কাছে পাকিস্তানী আর্মীর আত্মসমর্পণ করার সংবাদ প্রচার করছিলো। ক্যাম্পের পার্শ্বে বাগানের মন্ডপে আয়োজন করা হয়েছিলো বিশাল আনন্দ উৎসব। সবাই আনন্দ করলেও আমরা বন্ধুরা আনন্দের মধ্যেও ভীষণ দুঃখ ও কষ্টে খারাপ লেগেছিলো কারণ আমরা বন্ধুরা একে অপরকে ছেড়ে চলে যেতে হবে বলে। ১৬ ডিসেম্বর পাকি বাহিনী আত্মসমর্পণের পর ক’দিন পর বড় ভাই বিজয়ের বেশে ক্যাম্পে ফিরলেও তার বন্ধু সহযোদ্ধা সম্ভবত টাঙ্গাইল বাড়ি তিনি ফিরেননি। তিনি সিলেটের কোনো এক এলাকায় সম্মুখ যুদ্ধে প্রাণ হারান। তার মৃত্যু সংবাদ শুনে মা ভীষণ কেঁদেছিলেন, কারণ বড় ভাই মুক্তিযুদ্ধে যাবার পর যতবার শ্রীনাথপুর শরনার্থী ক্যাম্পে এসেছিলেন আমাদের খোঁজখবর নেওয়ার জন্য ততোবারই তার সেই বন্ধুকে নিয়ে এসেছিলেন আর মাকে মা বলে ডাকতেন বড় ভাই’র বন্ধুটি। মা তাকে সন্তানের মতোই স্নেহ করতেন। স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধের ৪৯ বছর অতিক্রম করতে চলছে ফলে অনেক কিছুই ভুলে গেছি, বড় ভাই বেঁচে থাকলে তার সেই মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে (নিহত) যাওয়া বন্ধুটির নাম পাওয়া যেত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় বড় ভাই’র বন্ধুটি জানতেন না তার মা-বাবা-ছোট ছোট ভাই-বোনরা কোথায় আছে কেমন আছে। মাকে বলতেন একবার তাদের খোঁজ পেলে সে দেখে আসতেন তাদেরকে, বিশেষ করে তার ছোট বোনের কথা বার বার বার গল্প করতেন।  মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার আগে তার বাবা সিলেটের রেলওয়েতে চাকুরী করতেন আর তিনি সিলেটের একটি কলেজে পড়তেন। ৫/৬ বছরের বোনটি ছিলো খুব আদরের, সারাক্ষণ তার সঙ্গেই থাকতো, বড় ভাইয়া ছাড়া কিছুই বুঝতো না, নাওয়া-খাওয়া ঘুমনো সবই বড় ভাই’র সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার আগে তার বোনটি তার গলায় ধরে বলেছিলো ‘বড় ভাইয়া তুমি আমাকে রেখে কোথাও যাবে না, যদি যাও আমাকে নিয়ে যাও’। সেদিন তাকে ঘুমে রেখে বড় ভাই’র বন্ধুটি মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং-এ যোগ দিয়েছিলেন। কয়েকদিন পর ট্রেনিং চলাকালেই সিলেটে গিয়ে তার পরিবারের কেউকে পাননি, কারণ সেখানে পাকি আর্মিরা আক্রমন করেছিলো, ফলে অনেক খোঁজাখুঁজির পরও কোন সন্ধান লাভ করতে পারেননি এবং তারা বেঁচে আছেন কি-না তাও জানতেন না। তিনি যতবার বড় ভাই’র সঙ্গে ক্যাম্পে এসেছিলেন ততোবারই তার প্রিয় বোনের কথা গল্প করতেন আর কাঁদতেন।

বড় ভাই আর তার বন্ধুকে ঘিরে আমরা সবাই যুদ্ধের গল্প শোনতাম।  কী ভয়ানক ভয়ানক যুদ্ধের গল্প। কিভাবে তারা গ্রেনেড মারা শিখছে, কিভাবে বন্দুক চালাতে হয় কমান্ডাররা পথে যেতে যেতে কতটা লাশ দেখেছেন এসব কত কি গল্প। মা তাদের জন্য রকমারী রান্নার আয়োজন করতেন যদিও ঘরে আলো ডাল পিঁয়াজ ছাড়া তেমন কিছু থাকতো না, বাবা পার্শ্ববর্তী চা বাগানের বাজার থেকে মাছ ও শুটকি আনার চেষ্টা করতেন। মা যা রানতেন তাই ওরা পেট ভরে খেত, দেখলে মনে হতো কতদিন যে ওরা খায়নি। ওরা দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে সন্ধ্যার আগেই চলে যেতো। এভাবে ২/৩ বার  ক্যাম্পে আসার পর বেশ ক’মাস আর আসেনি। বড়ভাইরা শরনার্থী ক্যাম্প ছেড়ে মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্প আর পরবর্তীতে যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার সময় মা কি যে কান্না করতেন, যতক্ষণ তাদেরকে দেখা যেতো ততোক্ষন রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। চলবে…..


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন