ফিচার্ড মত-মতান্তর

শ্রমজীবি মানুষেরা যেন তাঁর ঘাম ঝরানের ন্যায্য মূল্য পায় ||| অভ্র বড়ুয়া

শ্রমজীবি মানুষেরা যেন তাঁর ঘাম ঝরানের ন্যায্য মূল্য পায় ||| অভ্র বড়ুয়া

সময়ের পরিক্রমায় আবারও মহান মে দিবস হাজির। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের অধিকার ও দাবি আদায়ের দিন। বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষদের।১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের যে মার্কেটের শ্রমিকরা উপযুক্ত মজুরি ও দৈনিক আট ঘন্টা কাজের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন ও প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিলেন, কলকারখানার অসহ্য পরিবেশ শ্রমিকদের ন্যায্য আদায়, চাপা কষ্ট ও অধিকারের কথা। অসহনীয়, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দীর্ঘ ১৬ ঘন্টা কাজ করতেন শ্রমিকরা, বিরামহীন কাজ করা শ্রমিকদের ছিল না কোন ছুটি কিংবা বিশ্রামের ফুসরত। ওই বছরই শ্রমিকরা ৮ ঘন্টা কাজ ও তাঁদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে ব্যাপক প্রতিবাদী সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন, সেই সাথে ধর্মঘটের ডাক দেয় মেহনতি মানুষেরা। তিন লাখ মানুষ অংশ নেয় আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান ১১ জন শ্রমিক। পরবর্তীতে প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে মেহনতি মানুষদের মিথ্যা বিচারের নামে বন্দি করে ছয়জনকে আন্দোলনে অংশ নেওয়ার অপরাধে ফাঁসি দেওয়া হয়।
মে দিবস আসলে একটা দিন শ্রমিকরা নিজেরা, নিজেদের মতো করে খুঁজে পায়। দিনটি তেমন কিছু না মালিকপক্ষের সাথে বৈঠক ও ভালো-মন্দ খাওয়া দাওয়া করে কেটে যায়, আর ছোটখাট মিছিল। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সমূহে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের কথা ওঠে। তাঁদের অধিকার নিয়ে আলোচনা হলেও কতটুকুই তার বাস্তবায়ন হয়? মে দিবস ও তার যথার্থতা ধারণের মূল উদ্দেশ্য হলো শ্রমিকের ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ, যুক্তিসঙ্গত কর্মসময় নির্ধারণ, তাঁদের স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার, নিপীড়ন থেকে মুক্ত করা, তাঁদেরও সমাজে মানুষ হিসেবে দেখা।
মূলত তিন ধরনের শ্রম রয়েছে শারীরিক, শৈল্পিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক।
শারীরিক শ্রমের অন্তর্ভুক্ত হলো রিক্সাচালক, ঠেলাগাড়িচালক, দিনমজুর ইত্যাদি শ্রেণি পেশার মানুষ। এঁরা সমাজ থেকে যতটুকু না সম্মান পায় তার থেকে বেশি অবহেলা, অসম্মান ও উপরন্তু চপেটাঘাত পায়। তাদের এই সমাজ মানুষ হিসেবেই গণ্য করে না। একজন রিক্সাচালক ১০-১৫ টাকা ভাড়া বেশি আপনার কাছ থেকে চাইতেই পারে। সে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আপনাকে আপনার গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছে, তার বিনিময়ে হাসিমুখে আপনার কাছে আবদার করে চায়। অভাব আছে বলেই তাঁরা আবদারের হাত পাতে, নাহলে চাইতো না। তাঁদের বাড়তি টাকা দিলে আপনি গরীব কিংবা ছোট হয়ে যাবেন না, বরং আপনার মহানুভবতা প্রকাশ পাবে। সারাদিন পরিশ্রম করে মেহনতি মানুষদের ২০০-৩০০ টাকা থাকে। এতে কী হয় তাঁদের? আমরা তো বিলাসিতার জন্য একদিনে হাজার খানেক টাকা উড়িয়ে দিই। তাঁদেরও পরিবার রয়েছে। দিনের পর দিন না খেয়ে থাকে তাঁরা।আসলে তাঁরা গরীব এটাই তার অপরাধ।আমাদের সমাজে গরীব মানেই দুর্বল।সুতরাং,তাঁদের অধিকার বলতে কী আছে বলুন?সমাজের বাঁকা দৃষ্টি ও অন্যায়ের কাছে হার তাঁদের মানতেই হয়।তবে আমি মনে করি তাঁদের চোখের জল আত্মসম্মানের আঘাতের ব্যাথা বৃথা যাবে না কোনদিনই।
এবার আসি শৈল্পিক শ্রমের কথায়,সংগীতশিল্পী,নৃত্যশিল্পী,অভিনয়শিল্পী, চিত্রশিল্পী, যন্ত্রশিল্পী প্রভৃতি।একটি দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক তাঁরাই,কিন্তু তাঁদের মেধা ও গুণে তাঁরাও যোগ্য সম্মান ও অধিকার থেকে বঞ্চিত।আমরা শিল্পী ও শিল্প  দুটোকেই সম্মান দিই না।এইজন্যই বলছি শিল্পীরা তাঁদের যর্থাথ পারিশ্রমিক বা শিল্পী সম্মানী পায় না।শেষজীবনে বেশিরভাগ শিল্পকে অসহনীয় জীবনযাপন করতে হয় অর্থসংকটে।একজন শিল্পীকে আমরা ততক্ষণ মনে রাখি যতক্ষণ তিনি মেধা ও গুণে নিজেকে আমাদের সামনে উপস্থিত করতে পারেন।কিন্তু তাঁর দুর্দিনে তিনি কাউকে পাশে পাবেন না।
বুদ্ধিবৃত্তিক পেশার অন্তর্ভুক্ত মানুষরা হলেন-কবি,লেখক,আইনজীবি,গৃহ শিক্ষক গীতিকার প্রভৃতি।
তাঁদের পেশাও এক অর্থে কষ্টকর । শেষজীবনে গীতিকার,সুরকার কারও জীবন কাটে রেলস্টেশনে কারও বা পথের ধারে,এতটাই নির্মম। তাঁরাও যথাযথ পারিশ্রমিক পান না।
একটু সুন্দর সমাজ বির্নিমানে প্রতিটি পেশারই সমান গুরত্ব থাকে।কিন্তু প্রতিটি পেশা কোন না কোনভাবে তাঁদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। প্রতিটি পেশা ও মানুষের অধিকার আদায়ে আমাদের সচেষ্ট হতে হবে।আসুন এই মে দিবসে আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক আমাদের সমাজ যেন গরীব অসহায়,খেটে খাওয়া মানুষদের সমান অধিকার দেয়,মেহনতি মানুষের হাতে হাত রাখে,তাঁদের দু:খের সারথি হয়।সর্বপোরি, সকল শ্রমপেশার মানুষ সে শারীরিক, শৈল্পিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক যাই হোক তাঁরা যেন তাঁদের যর্থাথ সম্মান ও ন্যায্য অধিকার পায়।সেখানেই রাষ্ট্র ও সমাজের স্বার্থকতা এবং মহান মে দিবসের মাহাত্ম্য গুরত্ব পাবে।

 



এসএস/সিএ
সংবাদটি শেয়ার করুন