সাম্প্রতিক কোভিড কন্সার্নস |||| ডঃ শোয়েব সাঈদ
কোভিড-১৯ প্রবলভাবে বদলে দিয়েছে আমাদের সামাজিক, রাষ্ট্রীয় আর আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, ব্যবসা বানিজ্যসহ যাবতীয় কর্মযজ্ঞ, সেই সাথে প্রবল নেতিবাচক প্রভাবে বদলে দিয়েছে ব্যক্তিগত আর পেশাগত জীবনের স্টাইল। কোভিড সৃষ্ট প্যানডেমিক সংকট আর মোকাবিলায় অতিক্রান্ত হচ্ছে বছর খানেক সময়।
২০২০ সালের কঠিন সময়টুকু আমরা বয়ে চলেছি এই একুশ সালেও। ভ্যাকসিনের সুখবরের পাশাপাশি বেশ কিছু বাড়তি উপদ্রবের সূচনা হয়েছে ২০২১ সালের শুরুতে পশ্চিমা সভ্যতার উত্তরের দেশগুলোতে। বড়দিন আর ইংরেজি নববর্ষের সময়টুকুতে পশ্চিমা দেশে চলে ইনডোর, আউটডোর নানা উৎসব। করোনা পরিস্থিতির জন্যে এই সময়টুকু ভয়াবহ পরিণতি ঢেকে আনতে পারে বিধায় কর্তৃপক্ষ কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে পরিস্থিতি সামলাতে চেয়েছে। মন্ট্রিয়লে চলছে রাত ৮টা থেকে সকাল ৫টা পর্যন্ত সান্ধ্যআইন সংক্রমণের মাত্রা কমাতে। প্রথম ওয়েভের চাইতে ৫-৬ গুন শক্তিতে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে দ্বিতীয় ওয়েভে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ আর জাপানে। গরম প্রধান দেশগুলোর চিত্র অবশ্য অনেকটাই ভাল।
২০২১ সালের শুরুতে অনেকগুলো ভ্যাকসিনের সুখবরের পাশাপাশি হাজির হয়েছে তিনটি নতুন উপদ্রব। ভ্যাকসিনের প্রাপ্তি/ভ্যাকসিনেশনের ধীর গতি, ভ্যাকসিনের সেফটি নিয়ে কিছু কথা আর মিউটেশন/ভ্যারিয়েন্টের দুশ্চিন্তা।
গত সেপ্টেম্বরে বিডিনিউজ ২৪, আমাদের সময়, সিবিএনএসহ আর অন্যান্য পত্রিকার কলামে বিস্তারিত লিখেছিলাম কোভিড জাতীয়তাবাদ নিয়ে, বৈশ্বিক অভিজ্ঞতায় আশংকা প্রকাশ করেছিলাম ধনী আর ভ্যাকসিন উৎপাদন নিয়ন্ত্রক দেশগুলোর জাতীয়তাবাদের নামে স্বার্থপরতা বিশ্বের বাকী দেশগুলোর জন্যে জন্যে ভোগান্তি আর বিপদ ঢেকে আনতে পারে। আশংকা সত্য, এই ২০২১ সালে ভ্যাকসিন মাঠে আসার একমাসেও ভ্যাকসিনের দেখা মিলছে না বিশ্বের বেশীরভাগ দেশে। সেরামের সাথে চুক্তি আর ভারত সরকারের বারবার আশ্বাস স্বত্বেও বাংলাদেশের ভ্যাকসিন প্রাপ্তিতে অনিশ্চয়তা কাটছে না। ভ্যাকসিন নিয়ে বাংলাদেশের একটি ঝুড়িতে সব ডিম রাখার মত পরিস্থিতি যথেষ্ট ভোগান্তির কারণ হতে পারে বলে সতর্ক করেছিলাম কিছু লেখায় অনেক আগেই। বিশেষজ্ঞরা বার বার সতর্ক করার পরেও একাধিক ঝুড়ির ব্যবস্থা করা যায়নি।
অন্যদিকে বিপুল ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিশ্চিত করা দেশগুলো ভ্যাকসিন মাঠে আসারা সাথে সাথেই ভ্যাকসিনেশন শুরু করে। কিন্তু সমস্যা তাদেরও পিছু ছাড়ছে না। কানাডার গত একমাসে মাত্র ৪ লাখ সিঙ্গেল ডোজ দেবার এই হারে ভ্যাকসিনেশন চললে পুরো ২০৩৫ সাল লেগে যাবে ৩কোটি ৭৬ লক্ষ কানেডিয়ানদের ভ্যাকসিন দিতে। সরকারের লক্ষ্য আগামী সেপ্টেম্বর নাগাদ সবার জন্যে ডাবল ডোজ নিশ্চিত করা। ব্যাপক লজিস্টিকের সহায়তায় টিকা দেবার বর্তমান গতি অনেকগুন বাড়ানোর উপর নির্ভর করছে লক্ষ্য মাত্রা অর্জন আর সরকারের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।
ভ্যাকসিনেশনের গতি ধীর হওয়াতে সমস্যা বাড়ছে অন্য জায়গায়। ডাবল ডোজের সময় যাদের হয়েছে তাঁদের তা দেবার চেয়ে অধিক জনগণের সিঙ্গেল ডোজে সরকারের আগ্রহ বাড়ছে। তিন-চার সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয় ডোজের জায়গার কানাডার ফেডারেল সরকার ভাবছে ৬ সপ্তাহ আর কুবেক ভাবছে ১৩ সপ্তাহ। এতে উৎপাদকদের গাইডলাইনের বিচ্যুতি হবার ফলে ভ্যাকসিনের উপকারিতা কম্প্রোমাইজ হতে পারে। ডাবল ডোজে ৯৫% এফিকেসীর বদলে সিঙ্গেল ডোজে ৫০-৬০% এফিকেসীর দুর্বলতায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে পরিস্থিতি নেতিবাচক হতে পারে। ভ্যাকসিন (সিঙ্গেল ডোজ) নেবার পর মানুষের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার প্রভাবে মাস্ক পরা, সেনিটাইজার ব্যবহার, জনসমাগম এড়িয়ে চলার মত বিষয়ে শিথিলতা আসে এবং দীর্ঘায়িত দ্বিতীয় ডোজ এই পরিস্থিতি উন্নয়নে নেতিবাচক হতে পারে।
ভ্যাকসিন সংক্রমণ ছড়ানো নিয়ন্ত্রণে বিশেষ করে উপসর্গবিহীনদের ক্ষেত্রে কতোটা কাজ করছে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কিছু দুশ্চিন্তা কাজ করছে কিন্তু এখনই কোন উপসংহারে পৌছার সময় হয়নি।
ভ্যাকসিন নেবার পর কিছু মৃত্যুর ঘটনা ভ্যাকসিনের নিরাপত্তা বিষয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে। ফ্লোরিডায় একটি মৃত্যুর ঘটনার পর নরওয়ের ২৩ জন সিনিয়র সিটিজেনের মৃত্যুর ঘটনার বিস্তারিত এবং বহুমুখী তদন্ত চলছে, এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিনের সাথে কোন লিঙ্ক মেলেনি। তবে লিঙ্ক থাকলে সত্য সামনে আসবেই এবং জনস্বাস্থ্যে, জননিরাপত্তায় অনতিবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, এটাই বিজ্ঞান। আমাদের মনে রাখতে হবে ভ্যাকসিন অমরত্বের কোন টিকা নয় যে ভ্যাকসিন নেবার পর অন্য কারণে মৃত্যু হতে পারবেনা। তদন্ত আর বিজ্ঞানের উপর আস্থা রাখাটা জরুরী।
মিউটেশন আর ভ্যারিয়েন্টের ভয়টি শুরু হয় ডিসেম্বরের শেষে প্রকাশিত ইউকে ভ্যারিয়েন্ট B117 কে কেন্দ্র করে। মিউটেশনের ফলে ভাইরাসটির সংক্রমণ সক্ষমতা, ক্ষতি করার মাত্রা আর ভ্যাকসিনে কাবু হওয়া না হওয়ার মত স্পর্শকাতর ইস্যু নিয়ে তৈরি হয়েছে কিছু দুশ্চিন্তার ।
দক্ষিণ আফ্রিকাতে পাওয়া মিউটেশন E484K এবং জাপানে আর ব্রাজিলে পাওয়া মিউটেশন নিয়ে সতর্ক বিজ্ঞানীরা। পিয়ার রিভিউ পাবলিকেশন এখনো আসেনি, তবে গবেষণা তথ্যে জানা গেছে E484K মিউটেশনটির নিউট্রালাইজিং এন্টিবডিকে ফাঁকি দেবার প্রবণতা থাকতে পারে। নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি হচ্ছে সেই এন্টিবডি যা ভাইরাসকে সরাসরি আক্রমণ করে ধ্বংস করে।
ভ্যাকসিন নিয়ে বিশ্বব্যাপী দৌড়-যাপের মধ্যে ভ্যাকসিনকে ফাঁকি দেবার মিউটেশন দুশ্চিন্তার কারণ তো বটেই। এখন পর্যন্ত সংঘটিত মিউটেশনে তেমন ভয় নেই বলে আশ্বস্ত করেছেন বিজ্ঞানীরা। তবে মিউটেশনের অব্যাহত ধারায় কোন বেকায়দা মিউটেশনে ভ্যাকসিন ফাঁকি দেওয়া কিংবা অধিক অসুস্থ করে তোলা ধরণের পরিবর্তন কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
ফাইজার বলেছে B117 ব্রিটিশ ভ্যারিয়েন্টের N501Y মিউটেশন এর ভ্যাকসিন ফাঁকি দেবার সুযোগ নেই। বিজ্ঞানীদের অভিমত দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টটির ক্ষেত্রেও ভ্যাকসিন ফাঁকি দেবার মত পর্যাপ্ত মিউটেশন হয়নি। গবেষকরা ভ্যারিয়েন্টের ভ্যাকসিন ফাঁকি দেবার বিষয়ে বলছেন নিউট্রায়ালাইজিং এন্টিবডিকে ব্যাপকভাবে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব নয়। ব্রিটিশ ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ সক্ষমতা ভাবনার প্রেক্ষিত তৈরি করেছে বটে, এখন পর্যন্ত বিশেষ কোন পরিস্থিতি চোখে পড়ছে না।
২০২০ সালে ড্রাগ, ভ্যাকসিন নিয়ে দাপাদাপির মধ্যে ২০২১ সালের শুরু নাগাদ মাঠে এসেছে পশ্চিমাদের ডাবল ডোজের তিন তিনটি ভ্যাকসিন, ফাইজার, মডার্না আর এসট্রাজেনেকা থেকে। জনসন এন্ড জনসনের সিঙ্গেল ডোজের ভ্যাকসিনটি মাঠে আসার কথা মার্চে।
আগত সমস্যা সমাধান করেই মানব সভ্যতাকে এগুতে হয়, আশা করছি কোভিড-১৯ বিশ সাল পার হয়ে একুশ সালে ক্ষয়ে যাবার পথেই এগুবে। ২০২১ সালের সামারে গত সামারের মতই পরিস্থিতির উন্নতি হবে সেই সাথে ভ্যাকসিনের ক্রমাগত আত্মপ্রকাশ কোভিড লড়াইয়ে শক্তিশালী অবস্থা তৈরি করবে।
লেখকঃ কলামিস্ট এবং মাইক্রোবিয়াল বায়োটেক বিষয়ে বহুজাতিক কর্পোরেটে ডিরেক্টর পদে কর্মরত।
এসএস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন