সেই ছবি ||||হোসেন আবদুল মান্নান
ঘরের সামনে নতুন টাইলস করা উঠোনে দাঁড়িয়ে নারকেল গাছের ঈষৎ আলোছায়ায় একের পর এক ছবি তুলতে শুরু করলাম। বললাম, জেবু এসো কটা ছবি তুলব। সঙ্গে সঙ্গে সে বলে, ‘হঠাৎ তোমার এমন রোমান্টিকতার কারণ কী? কোনো দিন তো এভাবে বল না।’
আমি বলি, কোনো কিছু নয়, তোমার তৈরি করা সুন্দর ঘরটিকে পেছনে রেখে শুধু ছবি তোলা।
জেবু কাছে আসতেই অ্যাপেল আই-প্যাডে বেশ কটা ক্লিক হলো। আমার গা-ঘেঁষে হাত ধরে দাঁড়িয়ে জেবু। পরনে তার সবুজ শাড়ি। যা তাকে সব সময় অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা করে রাখত। অপরাহ্ণের মিষ্টি রোদে ঝলমল করছিল তার গোটা অবয়ব। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি ছবিগুলো যেন জীবন্ত-সতেজতা নিয়ে কথা বলছে।
এবারই গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ছবি তুলতে ইচ্ছা হলো আমার। এর আগে এমনটি হয়নি। নিচ তলা থেকে প্রয়াত বাবা-মায়ের ছবি তুলে ওপরে দোতলায় গিয়ে জেবুর ছবিও তুলি। ছবিগুলো বড় ফ্রেমে বাঁধানো অবস্থায় ড্রয়িংরুম এবং বেডরুমে ছিল। আমার এমন ছেলেমানুষি দেখে জেবু প্রশ্ন করে, এগুলো কেন করছ?
আমি বলি, এবার আমাদের আসন্ন বিবাহবার্ষিকীতে বিয়ের আগের তোমার সেই বিখ্যাত সাদা-কালো ছবিটি ফেসবুকে পোস্ট করে একটি ছোট্ট লেখা দিতে চাই।
এতে সে কিছুতেই রাজি নয়। বলে বাচ্চারা কী ভাববে? বাচ্চারা বড় হয়েছে। প্লিজ, এটা কোরো না কিন্তু। তা ছাড়া এ ছবিটা যে আমার তা এখন তো কেউ বিশ্বাসই করবে না। তুমি বরং বাবা-মায়ের ছবি দিয়ে পোস্ট দাও।
মনে পড়ে, জেবুর এ ছবিটা আশির দশকের শেষ দিকে কিশোরগঞ্জ শহরের একাধিক স্টুডিওতে প্রদর্শিত হতো। সে আমলে তোলার পর যেসব ছবি বেশ আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন হতো মালিকপক্ষ সেগুলো কাস্টমারদের চোখের সামনে প্রদর্শন করে রেখে দিত। যাতে অন্যরাও এমন ছবি তুলতে আগ্রহী হয়। মূলত ব্যবসায়িক ভাবনা থেকে এটা করা হতো। এ ক্ষেত্রে ছবিটা কার তা এদের কাছে মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়।
গৌরাঙ্গবাজার ব্রিজ থেকে একদিন সন্ধ্যাবেলায় আকস্মিকভাবে কালীবাড়ি রোড বরাবর হাঁটতে হাঁটতে গুরুদয়াল কলেজের হোস্টেলের দিকে যাচ্ছি। পথে আলোছায়া স্টুডিওর দরজায় দাঁড়াই। ভিতরে প্রবেশ করলেই জেবুর এ ছবিটা। অন্ধকার নেমে আসছে দেখে দ্রুত সিদ্ধান্ত পাল্টে আবার হাঁটতে থাকি। ’৮৮ সালের বন্যায় পানিতে থইথই সর্বত্র। শহরের অনেক রাস্তা জলমগ্ন। শহরতলি ডোবে ডোবে। কোথাও কোথাও রেললাইন পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় রেল যোগাযোগও সাময়িক বিচ্ছিন্ন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ময়মনসিংহ হয়ে কিশোরগঞ্জ শহরে পৌঁছি। সকালে খানিকটা পানি ভেঙে জেবু আসে। আমরা রিকশা করে উদ্দেশ্যহীন শহর প্রদক্ষিণকালে পুনর্বার ছবিটা দেখি এবং ভীষণ আনন্দিত হই। এদিকে বন্যায় ছোট হয়ে আসছিল শহরের সীমানা। নরসুন্ধার বুক ভরে উপচে পড়ছিল কচুরিপানা-মিশ্রিত ময়লা পানি। তখনকার ছোট্ট নান্দনিক শহর কিশোরগঞ্জ আজ বেশ বিস্তৃত ও সম্প্রসারিত। অনেক উন্নয়ন, সুরম্য অট্টালিকা, টাওয়ার ব্রিজ, ওয়াকওয়ে কত কিছু হয়েছে। তবু মনে হয়, আমাদের সময়ের শহরটাই ঝকমকে, মনোরম, বাসযোগ্য ও পরিপাটি ছিল।
সত্তরের দশকের শেষের দিকে সেই কলেজপড়ুয়া আমি রেলস্টেশন থেকে হেঁটে নিউ টাউন, একরামপুর, পুরান থানা, রথখোলা, আখড়াবাজার ইত্যাদি হয়ে কলেজে যাওয়ার অমøান স্মৃতি তো কখনো ভোলার নয়। শহরের অলিগলি ধরে দুশ্চিন্তাহীনভাবে হাঁটা। কখনো ট্রেন আসতে অনাকাক্সিক্ষতভাবে বিলম্ব হলে ভিন্ন রাস্তা ধরে ঘুরে আসা। আরও কত যে দিন-রাতের কাব্য- তা কে পড়ে, কে জানে। রিকশা নিয়ে ছোট্ট রাস্তায় প্রবেশ করলে জেবু বলত এদিকে বন্ধ; আমি নিশ্চিত হয়ে বলতাম খোলা। অনেক সময় তাই হতো। কেননা এ পথগুলো আমার অনেক পরিচিত, অনেক দিনের চেনা। মাসকয়েক আগেই একদিন আমি প্রস্তাব করলাম- জেবু চল, অবসরের পর আমরা আবার গোটা কিশোরগঞ্জ শহর রিকশায় ঘুরে বেড়াব।
সে বলল, ‘খুব মজা হতো, তবে দুজন যে এখন আর এক রিকশায় বসা সম্ভব নয়।’ আমি বলি, তাই তো! হবে না। নিরাশ হয়ে উচ্চারণ করলাম, আসলে আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই গেছে। ফিরে পাওয়ার সুযোগ নেই!
হতাশায় আবার বললাম, তাহলে গাড়িতেই ঘুরব। কিন্তু হায়! আমার চাকরি থেকে অবসরের আগে আমার রত্নগর্ভা জেবুই পৃথিবী থেকে চির-অবসর গ্রহণ করল। মনে হয়, এই তো সেদিন শুরু হলো। এখনো আমাদের অনেক কিছু দেখা হয়নি। রাতে মাঝেমধ্যে পুরনো দিনের চলচ্চিত্র দেখার ইচ্ছা হতো। দুজন পাশাপাশি বসে উত্তম-সুচিত্রার পঞ্চাশের দশকের বিখ্যাত ছবিগুলো দেখতাম। আমাদের সন্তানরা সেকেলে বললেও কর্ণপাত না করে আরামে বসে দুজনই বিচারক হয়ে যেতাম। কে বড়- উত্তম না সুচিত্রা? শেষ পর্যন্ত মহানায়কই জয়ী হতেন। তাঁর তুলনা ছিলেন নিজেই। সে প্রায়ই একটি কথা বলত, ‘উত্তম কুমার নায়ক থাকাবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ভালোই হয়েছে। বাঙালিরা তাঁকে বৃদ্ধ দেখতে চাইত না।’
আমাদের বিতর্কের অবসান হতো অনেকটা নীরবে। কারণ এতে বাচ্চাদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া বা মন্তব্য যাতে না থাকে। তবে মজা করে আমি প্রায়ই বলতাম, মনে রেখ জেবু, এ উপমহাদেশে মাত্র দুজন স্যানিটারি ইন্সপেক্টর বাবা সুচিত্রার জন্মদাতা হয়েছেন। একজন সিরাজগঞ্জের করুণাময় দাশগুপ্ত (সুচিত্রা সেনের বাবা), অন্যজন কিশোরগঞ্জের আমার মামা সারওয়ার উদ্দিন আহমেদ (জেবুর বাবা)। এসব শুনে সে হঠাৎ খেপে যেত, আবার ভিতরে ভিতরে আনন্দও পেত।
মাঠ পর্যায়ে সরকারি কাজ করার কারণে অনেক সময় আমাকে কর্মস্থলে একাকী থাকতে হয়েছে। বাচ্চাদের লেখাপড়ার প্রয়োজনে তাকে ঢাকায় অবস্থান করতে হতো। ছুটির ফাঁকে বেড়াতে যাওয়ার মতো কদিন থেকে আসা এভাবেই আমাদের চলত। বহুদিন ধরে নিয়ম মেনে একটি দায়িত্ব পালন করে এসেছি। গাড়িতে দূরে কোথাও যাত্রালগ্নে কয়েক সেকেন্ডের একটি ফোন। ‘জেবু রওনা করলাম’। আবার রাত ১২টার পর ‘জেবু ঘুমোতে যাচ্ছি’। এর কোনো ব্যতিক্রম হতো না। আমার কাছে মনে হতো, তাকে বলেছি তো আমি শতভাগ নিরাপদ। আজকাল আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়েও ভাবনা হয়। সারাক্ষণ ভাবী, তার এমন আকস্মিক প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে আমার বেঁচে থাকার রক্ষাকবচকেও কি হারালাম?
জেবুর চলে যাওয়ার পর ইদানীং সর্বদা আমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে রাখে বিচিত্র যতসব এলোমেলো বিক্ষিপ্ত ভাবনা, আমার বেড়ে ওঠা, সুখ-দুঃখের স্মৃতিকাতরতা। যার সবকিছু এত দিন কালের অতল গহ্বরে প্রায় মিলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। ৩২ বছরের নানা ঘটনা-প্রবাহের উথাল-পাথাল তরঙ্গ- মানসপটে কেবল ভেসে আসছে নিরবধি। আজ সজল চোখে পেছন ফিরে দেখি আর ভাবী, কতটুকু আয়ুষ্কাল অতিক্রান্ত হলে একে মহাজীবন বলা যায়? আসলে মানুষের সীমাবদ্ধতা হলো মানুষের অজানা। সামান্য আগেও মানুষ কেন কিছুই আঁচ করতে পারে না। বুঝতে পারে না একটু পরে কী হতে যাচ্ছে। মানুষের পরাজয়, পরাভব মানেই তার জীবনাবসান? সত্যি সত্যিই পৃথিবীতে মানুষ অনন্তপথের এক তীর্থযাত্রী। এখানে তার অবস্থান, তার আসন কোনোক্রমেই নিশ্চিত নয়। অনিবার্য অনিশ্চয়তার মধ্যে তার ত্রস্ত-ব্যস্ততার যাপিত সময়ের নিষ্ঠুর হিসাব-নিকাশ ছাড়া অন্য কিছু নয়। কারণ, মানুষ ভাবে এক হয় অন্য কিছু। এতে কারও সরাসরি কর্তৃত্ব নেই। কখনো ছিল না এবং ভবিষ্যতেও থাকবে না। তথাপি মানুষ নিরন্তর জীবনের তরী বেয়ে বেঁচে থাকতে চায়। এ লেখাটি আমাদের ৩২তম ‘ম্যারেজ ডে’তে জেবুর জন্য উপহার।
লেখক : গবেষক ও গল্পকার।
সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন