জানা অজানা

সেই বিউটি বোর্ডিং এখন

ঐতিহ্যের স্মৃতিবিজড়িত বিউটি বোর্ডিং

সেই বিউটি বোর্ডিং এখন

মোস্তফা মতিহার

‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখানে এসে বাবাকে বলতেন, প্রহ্লাদ কী খবর? কেমন আছ? আজকে কী খাবার রান্না হয়েছে? বঙ্গবন্ধু বাবাকে খুব স্নেহ করতেন। তিনি এখানে প্রায়ই আসতেন, সময় কাটাতেন এবং আড্ডা দিতেন।’ বিউটি বোর্ডিং ও এর প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত প্রহ্লাদ সাহা ও বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক নিয়ে এমন স্মৃতিচারণাই করলেন বিউটি বোর্ডিংয়ের বর্তমান কর্ণধার সমর সাহা। শুধু বঙ্গবন্ধুই নয়, জন্মলগ্ন থেকেই এখানে আড্ডা দিতেন প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাংবাদিক, চিত্রপরিচালক, নৃত্যশিল্পী, গায়ক, অভিনেতাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

একসময় প্রমত্তা বুড়িগঙ্গার ভরা যৌবনের মতোই বর্ণাঢ্য ছিল বিউটি বোর্ডিংয়ের সেই দিনগুলো। আসতেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, পল্লীকবি জসীম উদ্্দীনসহ ওই সময়কার প্রখ্যাত কবি, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা। এখানে বসেই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধিকার আন্দোলন নিয়ে নানা পরিকল্পনা হয়। আগে পর্যটক, শিক্ষার্থী, শিল্পানুরাগীরা এখানে এলেও করোনার কারণে এখন তা শূন্যের কোঠায়। করোনার ক্ষতিকর প্রভাবে বিউটি বোর্ডিংয়ের অবস্থা এখন খুবই করুণ। ২৫টি কক্ষের বেশির ভাগই থাকে খালি। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাটাও এখন কষ্টকর। নানা প্রতিকূলতা ও সমস্যার কারণে বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত এই বিউটি বোর্ডিং বর্তমানে সংকটময় দিন কাটাচ্ছে। বর্তমান কর্ণধার সমর সাহা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া প্রাচীন এই ঐতিহ্যটি রক্ষা করা কঠিন। সরকার সুদৃষ্টি দিলে বাণিজ্যিকভাবে না হলেও অন্তত ঐতিহ্য নিয়ে টিকে থাকতে পারবে এই বিউটি বোর্ডিং। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিউটি বোর্ডিংয়ের ইতিহাস আর ঐতিহ্য এখন কেবলই সোনালি অতীত। আমরা শুধু ট্রাডিশনকে ধরে রাখতে ও বাংলাদেশের ইতিহাস, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির কথা বলার জন্যই এখনো মন্থরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের অবস্থা নিভু নিভু। জানি না কতদিন এই ঐতিহ্যটি ধরে রাখতে পারব। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আমরা নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে পারব বলে আশা রাখি। সরকার যদি আমাদের বিদ্যুৎ বিল, ভ্যাট, ট্যাক্স ইত্যাদি মওকুফ করে দেয় এবং আর্থিক প্রণোদনা বা অনুদান দেয়, তাহলে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই সূতিকাগারটি আমরা টিকিয়ে রাখতে পারব। আর সরকার যদি আমাদের অস্তিত্ব রক্ষায় এগিয়ে আসে, তাহলে আমরা আজীবন সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।’ শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির ইতিহাসের কালের সাক্ষী, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, অভিনেতা, রাজনীতিবিদ, চলচ্চিত্রকারদের অবাধ বিচরণ ও আড্ডার প্রাণকেন্দ্র বিউটি বোর্ডিং রক্ষায় সরকারের প্রতি এমন করুণ আবেদনই জানালেন প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত প্রহ্লাদ সাহার ছেলে বর্তমান স্বত্বাধিকারী সমর সাহা। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়। কিন্তু সেই শহীদদের পরিবারগুলো এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি বলেও আক্ষেপ প্রকাশ করেন সমর সাহা। করোনার কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর এর ক্ষতিকর প্রভাব এখনো রয়ে গেছে। এ ছাড়া স্থানীয় প্রভাবশালীদের কুনজরে বিউটি বোর্ডিং বর্তমানে হুমকির মুখে রয়েছে বলেও জানান তিনি। শুধু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়ই দেশের এই ঐতিহ্য টিকে থাকতে পারবে বলে মনে করেন সমর সাহা। ১৯৭৫ সাল থেকে বিউটি বোর্ডিংয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন এর ম্যানেজার বিজয় পোদ্দার। ৪৪ বছর ধরে কাছ থেকে দেখছেন প্রতিষ্ঠানটি। তিনি বলেন, ‘এমনিতেই আমাদের অবস্থা আগের মতো নেই, এর ওপর করোনার প্রভাবে আমাদের অস্তিত্ব এখন বিপন্নের পথে। সারা বিশ্বের অর্থনীতি যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত, সেখানে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব এটাই স্বাভাবিক। তবে সরকারের সহযোগিতা পেলে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারব বলেই আশা করি।’ কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সেই ছাত্রাবস্থা থেকেই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে জড়িত আছি। অনেক কিছুই দেখেছি। অনেক ভালো সময় পার করেছি।’ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে বেশিদিন টিকে থাকা যাবে না বলেও জানান তিনি।

ফিরে দেখা : পুরান ঢাকার বাংলাবাজারের বুড়িগঙ্গার তীরের ১ নম্বর শ্রীশচন্দ্র লেনের বাড়িতে অবস্থিত বিউটি বোর্ডিং। প্রবেশদ্বার পেরিয়ে হলুদ রঙের দোতলা বাড়িটির আঙিনায় প্রবেশ করার পর যে কোনো সৌন্দর্যপিয়াসী মানুষের নয়ন জুড়িয়ে যাবে এর অবারিত সৌন্দর্যে। প্রাচীন আমলের গাঁথুনি মুহূর্তেই যে-কাউকে নিয়ে যাবে ১০০ বছর পেছনে। মাঝখানে প্রশস্ত উঠান। ফুলের বাগান দিয়ে ঘেরা। পাশে খাবারঘরের দেয়ালে টাঙানো আছে প্রাচীন আড্ডার কয়েকটি ছবি। এরপর শোয়ার ঘর, পেছনে সিঁড়িঘর- সবই গল্পের বইয়ে লেখা প্রাচীন জমিদারবাড়ির বর্ণনার মতো। একটু সামনে এগোলেই দেখা যাবে মুক্তিযুদ্ধের ১৭ জন শহীদের নামফলক। এতে আনন্দের উদ্বেলতায় মুহূর্তেই নীরবতা নেমে আসবে। শোকের পরিবেশে শ্রদ্ধা আর আবেগে মুক্তিযুদ্ধের ক্যানভাস চিত্রিত হবে আগতদের মানসপটে। শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির একসময়ের মিলনক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে হারিয়ে যাবেন দর্শনার্থীরা। কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, অভিনেতা, চলচ্চিত্রকার, রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের পদভারে একসময় মুখরিত ছিল এই বিউটি বোর্ডিং। এটি শুধু একটি প্রতিষ্ঠানই নয়, প্রযুক্তির এই সময় বুড়িগঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে থাকা এ এক ঐতিহাসিক স্থাপনা। নান্দনিক সৌন্দর্যের স্থাপনা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে এর জৌলুস। বুড়িগঙ্গার তীরে জাহাজের হুইসেলের ধ্বনি আর নদীর কলকল শব্দে কবি-সাহিত্যিকদের কলম থেকে বের হতো সৃজনশীলতা।

আজ বুড়িগঙ্গা হারিয়েছে তার স্রোত আর বিউটি বোর্ডিং হারিয়েছে এর জৌলুস। নতুন প্রজন্মের নাগরিকদের কাছে খুব চেনাজানা না হলেও বোদ্ধামহল ও সুধীজনদের কাছে এর কদর একটুও কমেনি। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আবদুল জব্বার খান এখানে বসেই লিখেছিলেন বাংলার প্রথম সবাক ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’-এর পা ুলিপি। এরপর ‘কাঁচের দেয়াল’ চলচ্চিত্রের পান্ডুলিপিও এখান থেকেই তৈরি হয়। ১৯৫৭ সালে কবি ফজল শাহাবুদ্দিন এখান থেকেই প্রকাশ করেন সাহিত্য পত্রিকা ‘কবিকণ্ঠ’। ১৯৫৯ সালে আহমদ ছফার সাহিত্য পত্রিকা ‘স্বদেশ’-এর উত্থানও এই বিউটি বোর্ডিং থেকেই। সুরকার সমর দাস বহু গানের সুর তৈরি করেছেন এখানে বসে। এই বিউটি বোর্ডিং নিয়েই শামসুর রাহমান লিখেছেন, ‘মনে পড়ে একদা যেতাম প্রত্যহ দুবেলা বাংলাবাজারের শীর্ণ গলির ভেতরে সেই বিউটি বোর্ডিংয়ে পরস্পর মুখ দেখার আশায় আমরা কজন।’ ১৯৫৭ সাল থেকে ’৬২ সাল পর্যন্ত এখানে বসেই লেখালেখি করতেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। ঐতিহ্য ঠিকই আছে, এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে জানান দিচ্ছে নিজের উপস্থিতি। কালের বিবর্তনে স্বর্ণালি সময়গুলো এখন কেবলই ইতিহাস। ১৯৪৯ সালে দুই ভাই প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা ও নলিনীমোহন সাহা এই বাড়িতে গড়ে তোলেন আবাসিক ও খাবারের হোটেল বিউটি বোর্ডিং। ১১ কাঠা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত বিউটি বোর্ডিংয়ের নামকরণ করা হয় নলিনী সাহার বড় মেয়ে বিউটির নামে। একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে এই বিউটি বোর্ডিং হয়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের মিলনস্থল। আর সেই বিষয়টি জানতে পেরে ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ বিউটি বোর্ডিংয়ে হামলা চালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। নারকীয় সেই হামলায় শহীদ হন এর অন্যতম কর্ণধার প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহাসহ ১৭ জন। এরপরই বিউটি বোর্ডিংয়ের আড্ডা হারিয়ে যেতে বসে। পরবর্তীতে প্রহ্লাদ চন্দ্রের পরিবার ভারত চলে যায়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রহ্লাদ চন্দ্রের স্ত্রী প্রতিভা সাহা দুই ছেলে সমর সাহা ও তারক সাহাকে নিয়ে বিউটি বোর্ডিং পুনরায় চালু করেন। বিউটি বোর্ডিংয়ের আড্ডা আগের মতো না থাকলেও খাবারঘরে এখনো ভোজনরসিকদের ভিড় লেগেই থাকে। নগরের ভোজনরসিকরা এখানে ছুটে আসেন। ঐতিহ্য ধরে রাখতে ভোজনরসিকদের আজও এখানে স্টিলের থালায় ও গ্লাসে খাবার-পানি পরিবেশন করা হয়। সকালে নাশতা, দুপুরে ভাত, বিকালে সুস্বাদু লুচি ও রাতেও রয়েছে খাবারের ব্যবস্থা। বিউটি বোর্ডিংয়ে ছোট-বড় মিলিয়ে কক্ষ রয়েছে ২৫টি। একমাত্র বড় কক্ষের ভাড়া এক হাজার ২০০ টাকা আর সিঙ্গেল কক্ষ ২০০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে।

 

সিএ/এসএস


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন