ধা রা বা হি ক…….পূর্ব প্রকাশের পর
জাপানের যাপিত জীবন – ৩ | সুশীল কুমার পোদ্দার
গভীর রাত্রে হোস্ট ডর্মের উপকণ্ঠে আমাদের নামিয়ে দিয়ে বিদায় নেন। বিদায় নেবার প্রাক্কালে কতোবার করে ক্ষমা চান মাধবকে কষ্ট দেবার জন্য, বাথরুম খুঁজে পেতে সময় ক্ষেপণের জন্য । এদিকে মাধবের চেহারাতে একটা ফুরফুরে আনন্দবোধ, একটা হিরণময় দ্যুতি -যেন সে বিশ্ব জয় করে ঘরে ফিরেছে।
পড়ালেখার ব্যস্ততায় ভুলে যাই সেদিনের কথা। ক্লাসে নতুন নতুন কানজি ( সঙ্কেতের মাধ্যমে জাপানী লেখার একটা পদ্ধতি ) শিখি। রাত জেগে প্রতিটা কানজির মাঝে লুকায়িত ইতিহাস খুঁজে বেড় করতে চেষ্টা করে যাই । যতো জানি ততোই মুগ্ধ হই। প্রতিটা কানজি গুহাগাত্রে আকা একগুচ্ছ রেখায় অঙ্কিত এক একটা জীবন্ত ছবির মতো। সভ্যতার ঊষালগ্নে মানুষ নিজকে প্রকাশ করার জন্য তৈরি করেছিল এমনি হাজার হাজার রেখা চিত্র । সময়ের সাথে সাথে, সংস্কৃতির সাথে সাথে তা বিবর্তিত হয়ে চীন থেকে কোরিয়া হয়ে যখন জাপানে প্রবেশ করেছে তখন কেউ কেউ হারিয়ে ফেলেছে তার মৌলিকত্ব। ক্লাসে সেনসেই (শিক্ষক) সেই বিবর্তনের ইতিহাস বলে যান। দগ্ধ turtle shell এর উপর আঁকাবাঁকা রেখা গুলো থেকে কেমন করে সৃষ্টি হোল এ কানজি- বলে যান তার ইতিহাস। শিল্পী যেমন রেখার টানে ফুটিয়ে তোলে তার অনুভূতি তেমনি সেনসেই আমাদের শিখিয়ে দেন রেখার সমন্বয়ে কেমন করে সৃষ্টি করতে হয় কানজি। আমরা কানজীর অংকন শৈলী দেখে বিস্মিত হই। বিমোহিত হই কানজীর সৌন্দর্যে।
সেনসেই ক্যানভাসে একে ফেলেন তিনটি রেখার টানে এক দৈত্যাকার মূর্তি, 大 (ওওকি- বৃহৎ)। মনে হয় একটা বিরাট দৈত্য হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছে। সেনছি বলেন এই কানজি দিয়েই লেখা হয় Osaka (大阪- বৃহৎ ঢাল)। আমরা রোমাঞ্চিত কানজি ‘ওওকি’ ‘সাকা’ এর সাথে বন্ধুত্ব করে নিজের উচ্চারণ বদলে কেমন করে ‘ওওকি’ থেকে শুধু ‘ও’ হয়ে গেছে । এমনি করে আরও তিনটি রেখা দিয়ে তিনি আঁকেন 女(ওন্না-মহিলা) । দুটো পা ভাঁজ করা নৃত্যরত কানজিটিকে দেখিয়ে তিনি বলেন সেই প্রাচীন কাল থেকে মানুষ নৃত্যকলা কে মেয়েদের শিল্প বলে মনে করতো। তাই এই কানজীর নাম হলো ওন্না। তিনি আরও আঁকলেন একটা ক্ষেত ও একটা তরবারি সমন্বয়ে একটা জটিল কানজী। তিনি বলেন তোমার যদি জমি থাকে ( সম্পদ) আর থাকে তরবারি ( শক্তি ) তাহলে তুমি 男 (ওতোকো – পুরুষ )। মেয়েরা এর তীব্র প্রতিবাদ করে। সেনসেই হেসে বলেন হাজার বছর আগে আদিম মানুষ যা ভেবেছে, আজও কি তার পরিবর্তন ঘটেছে? বিতর্ক জমে উঠে। কিন্তু, বিতর্কের বিষয়বস্তু আমায় স্পর্শ করে না। সেনসেই এর প্রতি সৃষ্টি হয় এক ধরণের মুগ্ধতা। একটা জটিল কানজির সহজ বিশ্লেষণ আমায় অভিভূত করে।
রাতভোর চলে আমাদের পরিশীলন। আমার সতীর্থ অসামান্য মেধার অধিকারী প্রকৌশলী মিজান কানজি প্রাকটিস করার জন্য ওর রুমের সিলিং এ টয়লেট পেপারের রোল লাগিয়েছে। সকালে দেখতে পাই মিজান সেই টয়লেট পেপারের অবিন্যস্ত পাহাড়ের মাঝে ঘুমিয়ে আছে । আস্তে আস্তে কানজি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেকটা জায়গাই দখল করে নেয়। আমরা পথে যেতে যেতে কুড়ানো কাগজে লেখা কানজির সাথে পরিচিত হই। ডিপার্টমেন্ট স্টোরে যেয়ে বিভিন্ন পণ্যের মাঝে উপাদান গুলো চিনতে চেষ্টা করি ঐ কানজির মাধ্যমে।
আমি মিজান আর মাধব একসাথে বাজারে যাই। বাজারে ঘুরে বেড়াই। যা দেখি সব দামি। দাম দেখার সাথে সাথে মস্তিষ্ক আপনা আপনি বাংলা টাকায় কতো হয় সে হিশেব বেড় করতে ব্যস্ত হোয়ে পড়ে। আমরা সাধারণত সস্তা পণ্য ডিম, দুধ, চিকেন, আর ব্রেড কিনে আনি। ওসাকার অদূরে কোবে নামক এক শহর থেকে ইন্ডিয়ান দোকান থেকে চাল, ডাল, আলু বেশি করে কিনে গুদাম জাত করেছি। হায়রে মধ্যবিত্ত, সারা জীবন হিশেব করতে করতে সূর্য অস্তাচলে! হঠাত করে মাধব উধাও। বাজারে এক কোণে ডিস্কাউন্ট কর্নার। মিজানের কথা মতো ছুটে যাই ওকে খুঁজে পেতে। বেশ বড় বড় আঙুরের প্যাকেট। প্যাকেটের গায়ে লাল রঙে বড় বড় করে কাণজি লেখা – ২০০ ইয়েন হিকি (ডিস্কাউন্ট) । দুটো প্যাকেট মাধব জাপটিয়ে ধরেছে। আমরা অনেক বললেম একটা আমাদের দেবার জন্য যদিও জানি ও কক্ষনো দেবে না। আমরা লাইনে দাঁড়িয়েছি দাম দেবার জন্য। মাধবের কাতর অভিব্যক্তি দেখে আমরা এগিয়ে গেলাম। মাধব শুধু বলছে সুমিমাছেন, ইয়ে (ক্ষমা করবেন, নেব না)। ও যে শুধু ডিস্কাউন্ট দেখেই আঙুরের প্যাকেটগুলো জাপটে ধরেছে বুঝতে বাকী রইলো না। বুঝতে বাকি রইলো না, ওর দাম আমাদের সপ্তাহের খাবার খরচের সমান। পথে এ নিয়ে অনেক হাসা হাসি হয়। ওর তেমন ভাবান্তর হয় না। ও বিমল আনন্দে আমাদের সাথে হেসে হেসে পথ চলে ।
দেখতে দেখতে মাস চলে যায় দেশ ছেড়ে আসার। রাত্রি যখন গভীর হয়ে আসে, যখন জানালা দিয়ে ঘুমন্ত শহরের মিটি মিটি আলো চোখে পড়ে, তখন কোথা থেকে একরাশ শূন্যতা আমায় জড়িয়ে ধরে। আপন জনের কথা খুব মনে পড়ে। প্রিয় জনের একটা চিঠি পেতে খুব মন চায়। একটা চিঠির প্রত্যাশায় প্রতি দিন আরও অনেক ছাত্রের সাথে আমিও হাজির হই আমাদের ডর্মের ডিরেক্টর তানাকার অফিসে।
আজ মাধবের চিঠি এসেছে। মাধব মুখ ভরা হাসি নিয়ে হাজির হয় আমার রুমে। মিজান আর আমি বসে আছি। মাধবের মা চিঠি লিখেছে বাংলায়, আমাদের উপর ভরসা করে। মাধব বলেছিল ওর মা বাঙ্গালী, বাবা হিন্দীভাসী। মাধব বাংলা লিখতে পড়তে পারে না তা আমাদের জানা ছিল না। মাধবের অনুরোধে আমরা মায়ের চিঠি পড়তে শুরু করি। এক চিরন্তন মায়ের চিঠি। ছেলের জন্য আকুতি, স্নেহ-ভালবাসা, উদ্বিগ্নতা চিঠি জুড়ে। হটাৎ থেমে যাই – মা লিখেছে, বাবা সুদূর জাপানে তুমি একটা ঘোষ ফ্যামিলি পেয়েছ জেনে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেম। মাধবের মুখে মৃদু হাসি। মা host family কে ঘোষ family মনে করেছে। মায়ের এমন একটা সহজ সুন্দর চিঠি পড়ে আমাদের মনটা ভালো হোয়ে যায়।
কানজির প্রতি উৎসাহ দেখে আমার সেন্সেই আমাকে জাপান সরকারের অনুমোদিত ১৮৫০ নিত্য প্রয়োজনীয় কানজির একটা বই উপহার দিয়েছেন। আমি চেষ্টা করে যাই মূল ইউনিভার্সিটিতে যাবার আগে এ ছয় মাসের মধ্যে যতটুকু শিখে নেওয়া যায়। আমি অল্প বিদ্যায় বিদ্বান হোয়ে এক বিশাল ভুল করে ফেলি। আমি আমার প্রফেসরকে হিরাগানা, কাতাকানা ও কানজি ( আধুনিক জাপানি লিখন পদ্ধতি ১৮৫০/২১৩৬ কাঞ্জি ও এক জোড়া বর্ণমালা হিরাগানা, এবং কাতাকানার সমন্বয়ে গঠিত।হিরাগানা এবং কাতাকানার প্রতিটিতে ৪৬ টি অক্ষর রয়েছে) ব্যবহার করে অজস্র ভুলে ভরা একটা চিঠি লিখে ফেলি। সপ্তাহান্তে প্রফেসরের জবাব আসে। জড়ানো হাতে লেখা চিঠি। আমি কি লিখেছে কিছুই বুঝতে পারি না। নিয়ে যাই এক সেনসির কাছে। আমার প্রফেসর লিখেছেন – যেহেতু আমি জাপানী ভাষা শেখার এক বিশাল সুযোগ পেয়েছি, তাই আমি যেন এর সদ্ব্যবহার করি। পরে জেনেছি আমার প্রফেসর একজন ভীষণ জাতীয়তাবাদী – যিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন একদিন জাপান জ্ঞান বিজ্ঞানে, এমনকি ভাষায়ও পৃথিবীর শীর্ষ স্থান দখল করে নিবে। আমার মাস্টার্স ও পিএইচডী জীবনে আমার প্রফেসর কখনো আমার সাথে ইংরেজিতে কথা বলেননি। এমনকি কিছু পেপারও আমাকে জাপানিজে লিখতে হয়েছে। অনেক কষ্টে অনেকের সাহায্য নিয়ে সেদিন উত্তর দিয়েছিলেম প্রফেসরের চিঠির।
প্রতিদিন সকালে ক্লাসে যাই, দুপুরে ফিরে আসি ডর্মে খাবার জন্য। ডর্মের ডাইনিং রুমে অনেক ভিড়। আমাদের শ্রীনিভাসন সান দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাক্ষ্মন। নিরামিষ ছাড়া কিছুই খায় না। অনেক ভেবে চিন্তে ও প্রায় প্রতিদিনই কাপ ন্যুডলস খায়। সেদিনও একইভাবে ও কাপ ন্যুডলস প্রেপায়ার করতে ডাইনিং এ উপস্থিত হয়েছে। সেদিন আমরা অনেকগুলো পশু পাখীর কাঞ্জি শিখেছি। হটাৎ করে আমাদের কৌতূহল হয় কাপ ন্যুডলসে কি আছে তা জানার জন্য। আমি উপাদানের তালিকা দেখে রীতিমত অবাক। এইতো শিং অয়ালা উসীর (গরু) কাঞ্জি। মিজানকে ডেকে এনে আবারো নিশ্চিত হই। আমরা একে একে ইলেক্ট্রনিক ডিকশনারি দিয়ে খুঁজে পাই শ্রীনিভাসনের নিরপরাধ কাপ ন্যুডলসের মধ্যে মিশে আছে মাছ, গরু, শুকর, সাগরের পাতা সহ অসংখ্য উপাদান। শ্রীনিভাসন স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রই। মুখে একটা করুন হাসি একে আস্তে করে কাপ ন্যুডলসটা ফেলে দেয় আস্তাকুরে।
সামনে পরীক্ষা। তাই ব্যস্ত। শ্রীনিভাসনের গিটারের সুর আর শুনা যায় না। ভেবেছি নিশ্চয় পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত। দুদিন কেটে গেছে শ্রীনিভাসনের দেখা নেই। দুপুরে খেতে এসে মাধবকে জিজ্ঞেস করি ওর কথা। ও তেমন বলতে পারে না। তৃতীয় দিন। শ্রীনিভাসন আজও ক্লাসে অনুপস্থিত। অফিসে অনেকেই জিগ্যেস করে ওর কথা। বিকেলে তানাকা সান পুলিস নিয়ে উপস্থিত। ওর রুম খোলা হয়। মুমূর্ষু শ্রীনিভাসন বিছানায় শুয়ে আছে। ও কথা বলতে পারে না। মুহূর্তে আতঙ্কভরা শব্দ করে অ্যাম্বুলেন্স চলে আসে। বাইরে বিশাল এক জটলা। কেউ জানে না কি হয়েছে। হঠাৎ করে মাধব বলে শ্রীনিভাসন ওকে সেই রাত্রে বলেছিল – ও নাকি বিরাট পাপ করেছে। ও নাকি গঙ্গার পবিত্র জলে স্নান করে পাপমোচন করতে চায়। ও যে আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হোয়ে নির্জলা উপবাস করে আত্মশুদ্ধি করার ব্রত নিয়েছে আমরা কেউ বুঝতে পারিনি …
চলবে…
লেখকের স্মৃতিচারণের অন্যান্য পর্বগুলি দেখতে হলে
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ১ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ২ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৩ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৪ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৫ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৬ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৭ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৮ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৯ |
স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ১ | স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ২ | স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ৩ | স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ৪ | ,
জাপানের যাপিত জীবন – ১ |জাপানের যাপিত জীবন – ২ |
জাপানের যাপিত জীবন – ৩ | সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী । ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স, মাস্টার্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।
এস এস/সিএ
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন