লেখালেখি

“তোর কত বড় সাহস!! দেখে নেব কে বড়! পুলিশ না ডাক্তার!!”

“তোর কত বড় সাহস!! দেখে নেব কে বড়! পুলিশ না ডাক্তার!!”

মোঃ মাহমুদ হাসান | মূল্যবোধের অবক্ষয় কোন স্তরে পৌছালে এমন ভাষায় হুংকার ছাড়তে পারেন একজন পেশাজীবি চিকিৎসক! তিনি নাকি আবার একটি মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ও বটে!! শুধু তাই নয়, কোন এক মন্ত্রী মহোদয়েরও ঘনিষ্ঠজন!! ঘটনাটি ঘটেছে ঢাকার রাজপথে। লকডাউন কার্যকরে নিয়োজিত পুলিশ এক ভদ্র মহিলার গাড়ি থামিয়ে, দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেট পরিচয়পত্র অথবা মুভমেন্ট পাস দেখতে চাইলে যে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, সেই ভিডিও চিত্র আমাদের সামাজিক দৈন্যতা আর মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়েরই এক নগ্ন বহিঃপ্রকাশ।

ক্ষমতা প্রদর্শনের বিষয় নয়, দায়িত্বের অংশ মাত্র। তবুও আমরা ক্ষমতার দাপট দেখাই। কারণে- অকারণে- এ যেন আমাদের সংস্কৃতির ই অংশ হয়ে গেছে। আর এই ক্ষমতা যারা প্রদর্শন করতে পারে আইন আদালত যেন তাদের কাছে নস্যি!! ১৮ এপ্রিল দুপুরে ঢাকার রাজপথে দেশ-মাতৃকার গর্ব বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা যে দৃশ্য দেখালেন, আইনের শাসন বাস্তবায়নে এমন দৃশ্য কতটা মানানসই!!

বিগত ১৪ এপ্রিল ২০২১ তারিখে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এক পত্রে কর্মকর্তা, কর্মচারীদের জরুরি চলাচলের প্রয়োজনে প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় পত্র সংগে রাখার নির্দেশনা দিয়েছিল। লকডাউনের সময় বিশেষ প্রয়োজনে জনসাধারণকে পাস সংগ্রহ করে চলাচলের নির্দেশনা দিয়েছিল বাংলাদেশ পুলিশ। দু’টো নির্দেশনার কোনটিই জনস্বার্থের পরিপন্থী ছিল না। কাউকে হয়রানি আর অপদস্ত নয়, কোভিড-১৯ এর ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলায় জীবন রক্ষার প্রয়োজনে সরকারের সামনে অন্য কোনো বিকল্প না থাকায় এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে সদাসয় সরকার। দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে আমাদের সবার ই উচিৎ সরকার গৃহীত পদক্ষেপ বাস্তবায়নে সহযোগিতা করা। সারা পৃথিবী ই আজ এক ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। এ পরিস্থিতি কোনভাবেই যুদ্ধাবস্থা থেকে কম নয়। যুদ্ধাবস্থায় একটি জাতি যেমন সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকে, অদৃশ্য শক্তির মোকাবেলায় আজকের এই যুদ্ধেও জাতির সর্বোচ্চ সংযমই ভয়াবহতা প্রতিরোধে একমাত্র কৌশল। এ সত্য টি মেনে নিতে ক্ষুধার্ত দিন মজুরের অসুবিধা হলেও, সমাজের শিক্ষিত বিলাসী শ্রেণীর অসংযত আচরণ ও বিধি-বিধান অমান্য করার প্রবণতা তো কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

বাংলাদেশের বিস্ময়কর অর্থনৈতিক সাফল্য আজ সর্বজন বিদিত। একদা ঝড়, বন্যা, জ্জ্বলোচ্ছাস আর দুর্ভিক্ষের দেশটিকে আজ পৃথিবীর অনেক দেশই সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে। অর্থনৈতিক সক্ষমতার পাশাপাশি চারিত্রিক দৃঢ়তা, নৈতিক সামাজিক মূল্যবোধ আর শিষ্টাচারেও আমাদের এগিয়ে যাওয়ার কথা!! যতদূর জানি বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রে চাকুরি জীবনের শুরু থেকেই নৈতিকতা, শিষ্টাচার, ব্যক্তিত্বের বিকাশ, রাষ্ট্রীয় ও আইনের বিধিবিধান নিয়ে নানা রকম প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এসব প্রশিক্ষণ থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে যেমন আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখানোর কথা, পাশাপাশি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ব্যক্তিটি বিনয় আর শিষ্টাচারেও সমৃদ্ধ হওয়ার কথা। ১৮ই এপ্রিল ২০২১ ঢাকার রাজপথে ডাক্তার, পুলিশ আর ম্যাজিস্ট্রেট মিলে জাতিকে যে ভিডিও চিত্র উপহার দিলেন, তাতে কি আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি রাষ্ট্র ও পরিবার আপনাদেরকে শিষ্টাচরের শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে? অথবা যাচ্ছেতাই উপায়ে ক্ষমতা ব্যবহার করে আপনারা এতোটাই অভ্যস্ত হয়েছেন- রাষ্ট্রীয় কোন বিধি-বিধানই আর আপনাদের জন্য প্রযোজ্য নয়!!

আজকাল কোন লিখায় বিদেশের উদাহরণ টানলে অনেক পাঠকই খুবই ক্ষিপ্ত হয়ে যান। কোন কোন সময় চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধারেও কার্পণ্য করেন না। তবুও বিষয়ের সংগে মিল থাকায় একটি উদাহরণ টানতেই হচ্ছে। গেল সপ্তাহে কানাডার দুইবারের প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার শপারস ড্রাগমারট নামক একটি ঔষধের দোকান তথা ফার্মেসিতে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে কোভিডের ভ্যাক্সিন নিলেন। লাইনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো অনেকেই উনাকে চিনলেও কেউই তাঁকে সিরিয়ালের ব্যাঘাত ঘটিয়ে সামনে যেতে উৎসাহিত করেননি। যখন তার সিরিয়াল আসলো দায়িত্বে নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মি তার আইডি সংগ্রহ করলেন,খুটিয়ে খুটিয়ে প্রশ্ন করে নিশ্চিত হলেন তিনিই পরিচয় পত্র বহনকারী হারপার। সাবেক প্রধানমন্ত্রী কে চিনতে না পারার অপরাধে দায়িত্ব পালন করা স্বাস্থ্যকর্মি তো কোন ক্ষোভ বা বিক্ষোভের শিকার হননি?

ঢাকার রাজপথে বীর বিক্রম শওকত আলীর কন্যা সহযোগী অধ্যাপক ডাক্তার মহোদয়ের কাছে পরিচয় পত্র চেয়ে, কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ করলেন পুলিশ আর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট? কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, ভদ্র মহিলার গায়ে এপ্রোন আর গাড়িতে মনোগ্রাম ছিলো। পতাকা আর মনোগ্রাম খচিত গাড়িতে ফেন্সিডিল আর ইয়াবা পাচারের ইতিহাস কি খুবই পুরনো? যে দেশে ডিবি পুলিশের পোষাকে ডাকাতি করার ইতিহাস ও খুবই প্রাচীন নয়, সেখানে মনোগ্রাম খচিত গাড়ি থামিয়ে পুলিশ কি সত্যিই অমার্জিত কোন অপরাধ করেছে?

১৪ এপ্রিল ২০২১ তারিখে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ( প্রশাসন) কর্তৃক কর্মকর্তা কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে ইস্যুকৃত পত্রে চলাচলের সময় দাপ্তরিক পরিচয়পত্র সংগে রাখার স্পষ্ট নির্দেশনা আছে। এই পরিপত্রের কোথাও তো মনোগ্রাম খচিত গাড়ি বিশেষ পাস হিসেবে ব্যবহৃত হবে- এমন কোন নির্দেশনা নেই। ভূলক্রমে পরিচয় পত্র সংগে না থাকায় বিনয়ের সংগে দুঃখ প্রকাশের পরিবর্তে বীর বিক্রমের কন্যা দাম্ভিকতার সাথে যে অসংযত আচরণ প্রদর্শন করলেন, আন্দোলন গড়ে তোলার হুমকি দিলেন তা কি কোন ভাবেই তার পেশা আর পারিবারিক মর্যাদার সাথে মানানসই? কোভিডকালে একটি ব্যক্তিগত ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার পরিবর্তে বিএমএ, স্বাচিপ কে নিয়ে নানাবিধ প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েও দায়িত্ব পালনকারী পুলিশের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার হুমকি দিয়ে কোন রাষ্ট্রীয় শিষ্টাচার আর দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত তিনি জাতির সামনে উপস্থাপন করলেন? ডাক্তার মহোদয় বীর বিক্রম বাবার পরিচয় দিয়ে নিজের নীচতাকে তুলে ধরলেও পুলিশ আর ম্যাজিস্ট্রেট ই বা কেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধা বাবাদের নিয়ে বিতর্কে জড়ালেন?

অবাক বিস্ময়ে জাতি আজ লক্ষ্য করেছে বিএমএ, স্বাচিপ সহ চিকিৎসকদের তিনটি সংগঠন পুলিশ আর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের বিচার দাবি করে ঘটনার প্রতিকার চেয়েছে। নিজেদের পেশার একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত ধৃষ্টতাপূর্ণ চরম অসৌজনমূলক আচরণকে বিবেচনায় না নিয়ে পেশাজীবি চিকিৎসকদের সংগঠন কি সরকারের নির্দেশিত বিধি বিধানের প্রতি বৃদ্ধাঙুলি প্রদর্শন করেছে? এসব সংগঠন কি তার সদস্যদের কাছ থেকে বিনয়, শিষ্টাচারের পরিবর্তে অতি দাম্ভিকতা পূর্ণ ক্ষমতাকেই প্রশ্রয় দেয়? বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিসেস এসোসিয়েশন ও ঘটনার নিন্দা করে প্রতিকার চেয়েছে। এরাও অপরাধী প্রমাণিত না হওয়া অবধি সকল নাগরিকের প্রতি সহনশীল সম্মানজনক আচরণ করার জন্য নিজ পেশার সদস্যদের প্রতি আহবান জানাতে পারেনি! তাহলে সমাজ আর রাষ্ট্রে বিনয়, সহমর্মিতা, সহানুভূতি ও শিষ্টাচার প্রতিষ্ঠায় তাদের কি কোন দায়বদ্ধতা ই নেই!!

প্রিয় বাংলাদেশ আজ এক ভীষণ দুঃসময়ের মুখোমুখি। জীবন-জীবিকা নিয়ে সারা পৃথিবীর মতো বাংলার মানুষ ও আজ এক কঠিন সংগ্রামে নিয়োজিত। জীবনের ভয়ে সন্তান যখন বাবার মুখাগ্নি করতে অস্বীকৃতি জানায়, সন্তান যখন তার মা-বাবাকে হাসপাতালে রেখে পালিয়ে যায়, পরম আত্নীয়রাও যখন শেষ বিদায়ে শ্রদ্ধা জানাতে অনীহা প্রকাশ করে সেই চরম দুঃসময়ে ও পুলিশ, সিভিল প্রশাসন, চিকিৎসক আর স্বাস্থ্য কর্মিরা ই তো অন্তিম যাত্রার একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠে।

দূর্যোগে-দূর্বিপাকে রাজনৈতিক, সামাজিক নেতারা জনগনের পাশে থাকাটা ই যখন প্রত্যাশিত ছিলো, কোভিড পেনডেমিকে কিছু ব্যতিক্রম বাদে এর বিপরীত চিত্র টি ই তো অামাদের সামনে ফুটে উঠেছে। শাসক,অার বিরোধী দলের জীবন ভয়ে অাতংকিত নেতারা ঘরবন্দী হয়েছে, বাকপটু সমাজপতিরা ঘরমুখো বিলাসী জীবনে মুখ লুকিয়েছে। এমন কঠিন সময়ে ও স্বাস্থ্য, সিভিল অার পুলিশ প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের অামলারা নিজের জীবন কে তুচ্ছ করে, পরিবার-পরিজনকে জীবন-মরনের হুমকিতে ফেলে জনগনের পাশে থেকেছে, দেশপ্রেমের সঞ্জিবনী শক্তি ছাড়া এমন কাজ কে করতে পারে বলুন!

বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত এক তথ্য থেকে জানা যায় কোভিড-১৯ আমার দেশের শতাধিক মেধাবী চিকিৎসকের জীবন কে কেড়ে নিয়েছে। প্রায় দু’শতাধিক পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মৃত্যুবরন করেছেন। প্রশাসনের ২৫ জন মেধাবী কর্মকর্তার অকাল প্রয়ানে দেশ জাতির পাশাপাশি তাদের পরিবার সমুহ অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। যে দেশের পুলিশ পরিবার-পরিজনের বেঁচে থাকার দাবিকে উপেক্ষা রাতের আঁধারে ক্ষুদার্ত মানুষের ঘরে খাবার যোগান দেয়, রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে আমাদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকে, যে দেশের চিকিৎসক আর স্বাস্থ্য কর্মীরা নিজ জীবন কে হুমকিতে ফেলে সন্তান সন্ততি আর আপনজনদের ফেলে যাওয়া কোভিড রোগীর নিয়মিত সেবা দিয়ে বেড়ায় সে দেশে কে বড়? পুলিশ না ডাক্তার – এমন হুংকারকে দেশের জনগণ শিষ্টাচারের চরম লংঘন হিসেবে বিবেচনা করলে খুবই অন্যায় হবে কি? অকুতোভয় বীর বীর বিক্রমের কন্যা প্রিয় চিকিৎসক- সংযম আর ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত রমজানের পবিত্র মাসে আপনার ঔদ্ধত্যের সাথে সহানুভূতিশীল হতে না পেরে আমরা যেমন দুঃখিত, তেমনি রাজপথে মহান মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের বাহাস দেখেও আমরা চরম বিব্রত। সামাজিক আর রাষ্ট্রীয় শিষ্টাচার রক্ষায় আপনাদের মতো দায়িত্বশীলরা আরও যত্নবান না হলে জাতি হিসেবে আমাদের দূর্দশার কালটি যে আরও দীর্ঘায়িত হবে তাতে সন্দেহের অবকাশ ই বা কোথায়?

লেখক ঃ কলামিস্ট, উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক , কানাডা।

এস এস/সিএ

সর্বশেষ সংবাদ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান
সংবাদটি শেয়ার করুন