ফিচার্ড লেখালেখি

দীর্ঘশ্বাস – ২  । সুশীল কুমার পোদ্দার

দীর্ঘশ্বাস – ২ সুশীল কুমার পোদ্দার

আমি তাপস তাপস করে ফিসফিস করে ডাক দেই। ঘরের দরজায় মৃদু আঘাত করি। দরজা খোলে না। চারিদিকে নিঃস্পদ্ধতা। অরক্ষিত ভাবে লাউয়ের মাচায় ঝুলে থাকে লাউ, বাঁশের বেড়া বেয়ে শসা গাছে ঝুলে থাকে বড় বড় শসা । তুলশীর বেদীতে কা-কা করে অবিরাম কাক ডেকে যায়। অন্য সময় হলে কর্তামা ধেয়ে আসতো লাঠি নিয়ে। রাম রাম, রাম রাম বলে। শসা গাছের আসে পাশে কারোর ছায়া দেখলেই রা-রা করে ছুটে আসতেন। আজ কেমন যেন সবকিছু অন্যরকম। আমি কর্তা কর্তা করে ডেকে যাই। এই প্রাতঃকালে কর্তার ঘর থেকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ধূপশলার এক সূক্ষ্ম ধুম্রজাল চারিদিক ছড়িয়ে পড়ত, সেই ধূপের পরিচিত গন্ধ পেতে আমি উকি ঝুঁকি দেই এখানে সেখানে। না, কেউ কোথাও নেই। ওরা কোথায় যেন চলে গেছে। অথচ কাল বিকেলেও তাপসের সাথে ডাংগুলি খেলেছি। ও তো আমায় কিছুই বলেনি। নাকি ও জানত না কিছু। আমার মনে অনেক প্রশ্ন – কেন ওর কৃপণ কর্তামা কাল আমায় স্নেহ ভরে তাপসের প্রিয় তীর ধনুক আমার হাতে তুলে দিয়ে বলল তাপসকে বলবি না। আমি ভগ্ন হ্রদয় নিয়ে ফিরে আসি ঘরে। মাকে বলি মা তাপসরা কোথায় গেছে? মা নীরব থাকে। মার নীরবতা জানিয়ে দেয় ওরা আর ফিরে আসবে না।

এমনি করে রাতের অন্ধকারে আমার অনেক পরিচিত বন্ধু, আপনজন চলে গেছে দেশ ছেড়ে। স্কুলে আমার বন্ধু ছিল গোপাল। ওরা ব্রাক্ষ্মন। যুগল কিশোর আখড়ার সেবায়েত। ক্লাসে ওর সাথে ছিল আমার চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতা। পরীক্ষায় ও একটা অতিরিক্ত কাগজ নিলে আমি নিতাম দুটো। পড়াশুনার বাইরে ওর সাথে ছিল আমার মধুর সম্পর্ক। ওর চেহারাটা ছিল লোক চোখে প্রতিষ্ঠিত গোপালের মতো। ভক্তেরা ভালবেসে সন্দেশ, ছানা, আম্রিতি কতো সব মিষ্টান্ন দিত। ও আমায় স্কুল টিফিনে ভাগ করে দিত। একদিন ওকে না দেখলে আমি ভীষণ দুখী হতাম। সেই বন্ধু আমাকে সহ অনেককে দুখী করে রাতের অন্ধকারে নীরবে চলে গেল।

ছোটবেলা থেকে এমনি করে দেখে এসেছি নীরব চলে যাওয়া। এ চলে যাবার প্রস্তুতি চলে সন্তর্পণে, লোক চক্ষুর অন্তরালে। সাড়া জীবনের আগলে রাখা জিনিসগুলো আত্মীয় স্বজনের মাঝে বিক্রি হয় নাম মাত্র মূল্যে। খাঁচার মায়ায় বেঁধে পড়া ছেড়ে দেওয়া কবুতরগুলো বসে থাকে খাঁচার উপর। চোখ ভরা জল নিয়ে আপনজনদের খুয়ারে বেধে রেখে আসতে হয় সন্তান সম গরু ছাগলগুলোকে। প্রতিমুহূর্তে দীর্ঘশ্বাস ও পিছুটানে ক্ষতবিক্ষত হয় হ্রদয়মন। অবিশ্বাস করতে মন চায় না, তবু অবিশ্বাস করতে হয় নিজের বন্ধু, প্রতিবেশীকে। অবিশ্বাস ভরা জীবনের ভার বইতে যেয়ে নিজের উপর বিশ্বাস যায় কমে। অবশেষে ভগ্ন হ্রদয়, ভগ্ন মন, ভগ্ন মনোবল নিয়ে যখন কেউ দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয় তখন সে কোন ক্রমে তার দেহটা টেনে নিয়ে যায়, বাদ বাকী সবটুকু পড়ে থাকে এই দেশের মাটিতে। হায়রে দেশের মাটি। জন্মের ঋণ। এ ঋণ তো শোধ হবার নয়। তাই জীবন সায়াহ্নে মন কেঁদে ওঠে ঐ শ্যাওলা পরা কলতলা, দামে ভরা পুকুর, দেওয়ালের ফাটল বেয়ে বেড়ে ওঠা বটের ঝুড়িটির জন্য। দেশ থেকে কেউ বেড়াতে গেলে অকাতরে প্রশ্ন করে আজও কি স্কুলের গা ঘেঁসে বড় নীম গাছটায় টিয়ে পাখী নিমফল খেতে আসে? বড় পুলের নীচ দিয়ে আজও নৌকা চলে, হাজী সাহেবের বড় ছেলে, আমার সাথে পড়তো, আমার কথা কি বলে? এমনি কতো হেলা ফেলা কথায় কথায় মনের কোনে জমানো স্মৃতিগুলোকে সামনে এনে চোখের জলে হালকা করে হৃদয়।

আমার এ ক্ষুদ্র জীবনে এমনি শুনেছি কতো ভগ্ন হ্রদয়ের দীর্ঘশ্বাস। দেখেছি সেই হিলি স্থল বন্দরের অপর সীমান্তে দাড়িয়ে থাকা এক অশীতিপর সংগতিহীন বৃদ্ধার শেষ আকুতি ভরা চোখ। তার স্মৃতি জুড়ে ৪৬ এর রায়ট, বাস্তুচ্যুত হয়ে দেশত্যাগী হবার স্মৃতি। সেদিনের সে নিগ্রহও ওকে ভুলতে দেয়নি প্রিয় জন্মভূমির মাটিকে। ও শুধু এসেছে তার মাতৃভূমিকে দেখতে, একটু ছুঁয়ে দেখতে। পাসপোর্ট বিহীন বৃদ্ধাকে আমার বড় ভাই সেদিন সুযোগ করে দিয়েছিলেন স্বল্প-সময়ের জন্য আমার দেশে প্রবেশ করার। অসহায় হয়ে দেখেছিলেম তাকে রেললাইন পার হোয়ে আপন মাটিকে মাথায় নিয়ে অঝোর ধারায় কাঁদতে।


দীর্ঘশ্বাস – ২  । সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন