সুফিবাদ ও সিলেট
আয়শা হায়দার চৌধুরী
‘সিলেট’ নামটির সঙ্গে জড়িত এমন বিষয় বা ধারণাগুলোর কথা একবার ভেবে দেখুন। সম্ভাবনা আছে যে, ‘সুফিবাদ’ শব্দটি আপনার মনে পড়বে। সিলেটের জরাজীর্ণ দালানের ইটগুলো হয়ত একসময় মাটি হয়ে যাবে, তবে সুফিবাদের যে পরিবেশ সেটি এখানকার মানুষের মনে থেকে মুছে যাওয়ার সম্ভাবনা কম।
বাংলাদেশে মুসলমানদের ইতিহাস ও বিশ্বাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সুফিবাদ সবসময়ই চিরন্তন। বরং এটি বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও চর্চা করা হয়, সুফিবাদ তাদের বিশ্বাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
নবম শতাব্দীতে প্রচলিত ইসলামী ধর্মতত্ত্বের তুলনায় সুফিবাদকে একটি মুসলিম দর্শন হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এর একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট আছে। এর প্রাথমিক প্রচার হয়েছিল পার্থিব বিষয়বস্তুকে আঁকড়ে থাকার পরিবর্তে সর্বশক্তিমানের সঙ্গে এক অনন্য আধ্যাত্মিক সম্পর্ক তৈরির ধারণা থেকে। সুফিবাদের এক ধরনের রহস্য আছে এবং এটা আসলে যে কাউকেই তার ধর্মের আসল মর্ম বুঝতে উৎসাহিত করে।
বাংলায় সুফিবাদের আবির্ভাব একাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়েছিল। তখন থেকেই ধারণাটি এই অঞ্চলে বসবাসরত মানুষের জীবনযাত্রার একটি বিশাল অংশে ঢুকে পড়তে শুরু করে। সুফিরা উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে প্রসন্ন ছিলেন। মানবিক মূল্যবোধ সম্পর্কে জনগণকে আলোকিত করতে তারা সচেষ্ট ছিলেন।
সময়ের সঙ্গে প্রচুর সংখ্যক সুফির আগমনের কারণে সিলেট সুফিবাদের এক ধরনের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। সুফিরা প্রতিনিয়ত ইসলাম ও মানবতার প্রচারের মাধ্যমে মানুষের মনস্তত্ত্ব গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সুফিবাদ কখনো অন্য ধর্মকে কম সম্মানজনক হিসেবে উপস্থাপন করেনি; সুফিরা সবসময় জ্ঞানচর্চা করতেন মূলত মানুষের ঐক্যবদ্ধ জীবনযাপনকে জোর দিয়ে।
হযরত শাহজালাল (র.) সহ মহান সুফি বিদ্বানদের আগমনের পর শক্রবাহিনীকে কিছু সময় ঠেকিয়ে রাখার জন্য সুরমা নদীতে নৌকা চলাচল নিষিদ্ধ হয়। হযরত শাহজালাল (র.) তৎকালীন শাসকের বিধিনিষেধ বিলোপ করেছিলেন। ইসলামের দানশীল প্রচারক হিসেবে তিনি জনগণের অন্তরে জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন।
হযরত শাহজালাল (র.) দরগার বর্তমান মুতাওয়ালির (সুপারভাইজার) সঙ্গে কথা বলার সময় কয়েকটি আকর্ষণীয় গল্প শুনতে পেলাম। দরগার বর্তমান মুতাওয়ালি ফতেহ উল্লাহ আল আমান শোনালেন, কিভাবে হজরত শাহজালাল (র.) দুর্নীতিগ্রস্ত কর-ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে জনগণকে আপোষহীন রাজস্ব প্রদানের বোঝা থেকে উদ্ধার করেছিলেন।
বিশ্বাস করা হয় যে, হযরত শাহজালাল (র.) একটি অলৌকিক কাজ করেছিলেন যা অবিস্মরণীয়ভাবে ইসলাম গ্রহণে স্থানীয়দের আকৃষ্ট করেছিল। দরগা-ই-হযরত শাহজালাল (র.) সম্প্রীতির এক অনুকরণীয় মূর্ত প্রতীক ছিলেন। বিভিন্ন ধর্মের লোকেরা সারা বছরই এই জায়গাটিতে আসেন।
সাধারণত প্রতি বৃহস্পতিবার সিলেটের রাস্তাগুলো অস্বাভাবিক যানজটে ভরে যায়। কারণ প্রচুর সংখ্যক সুফি-ভক্ত জুমার নামাজের জন্য দরগায় ভিড় করেন। পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত থেকে নামাজ আদায় করার পাশাপাশি মানুষ এখানে আধ্যাত্মিক প্রশান্তি খুঁজতে আসেন।
ইনসোমনিয়া বা অনিদ্রায় ভুগছেন এমন অনেক দর্শনার্থীও এখানে এসে মানসিক প্রশান্তি খুঁজে পাওয়ার কথা জানিয়েছেন, যা কখনোই কোনো ঘুমের ওষুধ তাদেরকে দিতে পারেনি।
সুফিবাদ সব ধর্মের মানুষের বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গিকে ধারণ করে। সিলেটবাসীরা বেশিরভাগই ধর্মের আধ্যাত্মিক দিকটিকে ধারণ করেন এবং আধ্যাত্মিক প্রশান্তির জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকেন।
সিলেটে অনেক মাজার আছে। এমনকি, শহরের উপকণ্ঠেও কয়েকটি মাজার দেখতে পাওয়া যায়। হযরত শাহজালাল (র.) এর দরগা দেখতে আসা লোকেরা সাধারণত হযরত শাহ পরান (র.) এর মাজারও জিয়ারত করেন।
বিশ্বাস করা হয়, হযরত শাহ পরান (র.) ছিলেন হযরত শাহজালাল (র.) এর ভাগ্নে। মাজারগুলোতে উরশ (মিলনমেলা) শুরু হওয়ার সময়ে সিলেটের চেহারা একেবারেই পাল্টে যায়।
দুই দিনের কর্মসূচিতে ওয়াজ মাহফিল ও খাবার বিতরণসহ নানান আয়োজন থাকে। এই দিনগুলোতে স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কারণ এটা বাস্তব যে, এই দিনগুলোতে রাস্তাজুড়ে দীর্ঘ যানজট থাকে। ফলে শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠানে পৌঁছাতে ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
সুফিবাদের রাজ্যে বাস করা সিলেটবাসীর ধারণা ও চিন্তাধারা নিয়ে আলাপ করা যাক। সিলেটের অধিবাসীরা সুফিবাদে নিবেদিত প্রাণ। তারা ব্যাপকভাবে সুফিবাদের প্রচারকে সম্মান জানান। কারণ, তারা বিশ্বাস করেন যে এটি সর্বশক্তিমানের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের একটি পথ তৈরি করে। তাদের অনেকেই আর্থিক সহযোগিতার মাধ্যমে মাজারগুলোর সামগ্রিক রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকেন। কেউ কেউ তাদের মাসিক আয়ের একটি অংশ মাজারের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যই তুলে রাখে।
তবে, এখানে এমন মানুষও আছেন যারা সুফিবাদ সম্পর্কে আলাদাভাবে চিন্তা করেন। কারো বিশ্বাস, এই দর্শনে কোনো ত্রুটি না থাকলেও এটি অনুমান করা ভুল যে সুফিবাদের নামে করা সমস্ত আচার ও অনুশীলন বৈধ।
এমনকি, কিভাবে লোকেরা ইসলামের মূল ধারণা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে সে সম্পর্কেও অনেকে সোচ্চার হন। তাদের সন্দেহ, একমাত্র মাজারগুলোই তাদের সমস্যা নিরসনে সহায়তা করতে পারে এমন বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরার অর্থ হলো ইসলামের মূল ধারণা থেকে দূরে সরে যাওয়া। মাজারগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অর্থায়ন তা নিয়েও তারা অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
তবুও সুফিবাদ একটি আকর্ষণীয় দর্শন। এর ভুল ব্যাখ্যা মারাত্মক বিভ্রান্তির কারণ হতে পারে। যেমন, সামান্য একাডেমিক পড়াশোনা করা অনেকেই জরুরি চিকিৎসা উপেক্ষা করে মাজারে পড়ে থাকেন। তাদের ধারণা, কেবল মাজার জিয়ারত করলেই তাদের সমস্ত সমস্যার সমাধান হবে।
প্রার্থনা আমাদের আত্মিকভাবে প্রশান্তি দিলেও তা নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে থাকা উচিত নয়। সুফিবাদের জগতে ডুবে যাওয়ার আগে মানুষকে অবশ্যই কিছু বিষয় অবলম্বন করতে হবে। সুফিবাদ প্রশান্তি অর্জনের মূল বিষয় হওয়া উচিত। একে অতিরঞ্জিতভাবে ব্যাখ্যা করা ঠিক না।
সামগ্রিকভাবে, সুফিবাদ বিশ্বকে উপলব্ধি করার একটি চমৎকার উপায়। এর ক্যালিডোস্কোপিক প্রচার অবশ্যই একটি প্রশান্ত মনকে উৎসাহিত করে। এর শিক্ষাগুলো আমাদের স্থির হতে ও সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। তবে সুফিবাদের সঠিক ও ভুল ব্যাখ্যার মধ্যে কারোই লাইনচ্যুত হওয়া উচিত নয়। অযৌক্তিক ব্যাখ্যা কেবল মিথ্যা বা বিকৃত উপস্থাপনার দিকেই আমাদেরকে নিয়ে যেতে পারে। এটি সুফিবাদ বলতে যা বোঝায় তার ঠিক বিপরীত।
সিলেটের মায়াবী মানুষদের উচিত এই সমস্যাগুলোকে সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সমাধান করা। যাতে সুফিবাদের মর্ম সবার কাছে স্পষ্ট হয় ও এটি সমৃদ্ধ হতে থাকে। সুফিবাদ ও সিলেট সত্যিই অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত।
সূত্রঃ ডেইলি স্টার
এস এস/সিএ