ধা রা বা হি ক…….পূর্ব প্রকাশের পর
জাপানের যাপিত জীবন – ৭ | সুশীল কুমার পোদ্দার
সুজুকি সেনসেই এর সেই তথাকথিত নিমন্ত্রণ থেকে ফিরে আসার পর থেকে জাপানী ভাষা তথা জাপানী সংস্কৃতি নিয়ে একটা সংশয় তৈরি হয়েছে। এখন আর আগের মতো স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কথা বলতে পারি না। মনে হয় আমার বুঝার বাহিরেও অনেক অবুঝা জগত রয়েছে, আর ঐ অবুঝা অংশটাই আমায় বোকা বানিয়ে দেবে।
ইতোমধ্যে আবারো ধরা খেয়েছি। জাপানে রাস্তার মোরে মোরে টেলিফোন বুথ। কার্ড দিয়ে দেশে টেলিফোন করা যায়। কিন্তু তা মোটেই সস্তা নয়। সেদিন ইউনিভার্সিটিতে পোস্টার দেখলাম নিপ্পন টেলিকম বিদেশী ছাত্রদের বিনামূল্যে দেশে টেলিফোন করার সুযোগ দেবে। বিনামূল্যের কথা শুনে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে, ওদের মধ্যে আমিও একজন। দেশে কথা বলে ফেরার পথে এক টেলিফোন সেবাকর্মী আমায় বললো – টেলিফোন কারডু ওয়া ইকাগা দেছকা (how about telephone card?) আমি বললাম – ইকুরা দেছ কা (how much?) । উত্তরে জানালো তাদা (free)। আমি কেক্ক দেস বলে দাড়িয়ে রইলেম কার্ডের জন্য। কিন্তু বিনামূল্যে কার্ড পাবার কোন আলামতই দেখলাম না। অথচ যারা কথা না বলে শুধু হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তাদের প্রত্যেকেরই হাতে কার্ড । আবারো খটকা। জাপানী ভাষায় কেক্ক একটা অতি শোভনীয় contextual শব্দ যার অর্থ ‘হ্যাঁ’ আবার ক্ষেত্র বিশেষে ‘না’ হয় । যদি কেউ মাথা ঝাঁকিয়ে কেক্ক বলে তবে ‘হ্যাঁ’ ‘না’ হয়ে যায়। তাই কেউ কেউ confusion দূর করতে শুধু কেক্ক না বলে বলে হাই কেক্ক দেস ( yes, yes) অথবা সুমিমাছেন কেক্ক দেস (sorry, no need)। কি জানি আমি কেক্ক বলার সময় বাতাসে মাথাটা দুলে উঠেছিল কিনা।
জাপানে বিদেশী ছাত্র হবার অনেক ফায়দা। প্রায়ই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমার দেশের সংস্কৃতির সাথে পরিচিত করানোর জন্য আমন্ত্রণ আসে এবং সাথে আসে কিছু নগদ লক্ষ্মী। সেদিন আমি আমার সহধর্মিণীর সাথে হাজির হলাম এক হাইস্কুলে। বিরাট এক হল রুম। অসংখ্য ছাত্র ছাত্রী শিক্ষক বসে আছেন। বর্ণাঢ্য এক ব্যানারে লেখা – নিপ্পন বাংগুরাদেশ, ইওকসো কানকেই ( অভিনন্দন জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্ক )। স্টেজে উঠতেই জাপানি মেয়েরা আমার সহধর্মিণীকে ছেঁকে ধরল। ওদের সীমাহীন কৌতূহল ওর শাড়ী নিয়ে, মাথার সিঁদুর নিয়ে। হঠাৎ করে চোখ গেল দেয়ালে টানান পোস্টারের দিকে।
অর্ধনগ্ন পথ শিশু রাস্তার ড্রেনের পাশে কুকুরের সাথে ভাগ করে খাচ্ছে, খাবার, বন্যায় ভেসে গেছে চরাচর, টিনের চালে ছাগল, গরু নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে ছিন্নমূল কিছু মানুষ, রুগ্ন কৃষক তার চেয়ে অধিক কৃশকায় গরু দিয়ে জমি চাষ করছে, আরও কতো ছবি। ছবি গুলো দেখে মনটা নৈরাশ্যে ভরে যায়। নিজের দিকে তাকাতে ভয় হয়। সংশয় জাগে আমার শরীরে পোশাক আছে কিনা, পায়ে জুতো আছে কিনা। দেশকে নিয়ে গর্ব করার মতো, যেসব তথ্য মাথায় ভরে এনেছিলেম, তা মুহূর্তে উবে গেল। অজস্র করতালির পর সমস্ত হল রুমে সুমসাম নীরবতা নেমে এলো। একটা মেয়ে এগিয়ে এলো স্টেজের দিকে। ও বাংলাদেশের উপর একটা স্লাইড সো প্রেসেন্ট করলো। শিক্ষার হার, মাথাপিছু আয় সহ প্রায় সবকিছুই বলে গেল – যা আমি একটু অন্যভাবে পরিবেশন করবো বলে ভেবেছিলেম।
আমার যে আর কিচ্ছু মনে আসছে না। কি দিয়ে আমার দেশের নেতিবাচক এমেজ কে আড়াল করব! আমার ডাক এসেছে কিছু বলার। আমায় সাহস দিলো রবীন্দ্র নাথ, আচার্য জগদীশ চন্দ্র বোস, সত্যেন বোস। ওরা অনেকেই টাগরের নাম শুনেছে। টাগরের নাম বলাতে একজন শিক্ষক এগিয়ে এলেন, আধো বাংলায় সে কণ্ঠে সুর তুলল- যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে…। পরে শুনেছি, উনি বাংলাদেশে কোন এক এনজিওর হোয়ে কাজ করেছেন। কথায় কথায় ছবিগুলোর উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলেম। বুঝতে বাকি রইলো না এন জিও গুলো দেশের দরিদ্রতাকে নগ্ন ভাবে দেখিয়ে কিভাবে নিজেদের পকেট ভরছে। দেখতে দেখতে সবার কৌতুহল হল আমার বাংলা ভাষা নিয়ে, আমার বর্ণমালা নিয়ে। আমি বোর্ডে লিখলাম ক, ওরা সমস্বরে বলল কা, আমি লিখলেম খ, ওরা আবারো বলল কা। ক এবং খ এর মধ্যে পার্থক্য বুঝাতে যেয়ে আমি গলদ ঘর্ম । একি বিড়ম্বনা গ এবং ঘ কে নিয়ে। আমি আমার বাংলা বর্ণমালার এগারো স্বরবর্ণের সাথে ওদের পরিচিত করে দেই। বুক ফুলিয়ে বলি আমরা অনেক বিদেশী শব্দই মূল উচ্চারণের কাছাকাছি উচ্চারণ করতে পারি এই স্বরবর্ণের বৈভব দিয়ে। নিজকে মোটেই আর দরিদ্র মনে হয় না। ছবিগুলো দেখে আমার মনের আকাশে যে মেঘ জমেছিল তা আস্তে আস্তে কেটে যায়।আমাদের ছোট্ট শহর মাৎসুইয়ামাতে দশ বার ঘর বাঙ্গালীর বসবাস। যেকোনো ছোট খাটো উৎসবে আমরা একে অপরে মিলিত হই। আড্ডা জমে ওঠে। দেশের সমস্যা নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে প্রয়োজনের চেয়ে অধিক আলোচনা হয়। কেউ কেউ তার আভিজাত্য, বংশ গৌরব, দেশে কোন উচ্চতর অবস্থানে ছিল সে সব কথা নানা ভূমিকায় জানিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে ছোট্ট এই কমিউনিটির মধ্যে নানা রকম বিভাজন চোখে পড়ে।
বিদেশের মাটিতে পা রেখেই আমাদের বাঙ্গালী কমিউনিটি নিয়ে একটা কথা শুনেছিলেম তা হলো যেখানেই তিনটে পরিবার সেখানেই দুটো দল। সেই কথাই সত্য হল। পারস্পারিক হিংসা, হীনমন্যতা, উচ্চমন্যতা থেকে একটু দূরে আপেক্ষিক শান্তিতে অবস্থান করার জন্য আমি বাসা নিয়েছে শহরের মাঝে অপেক্ষাকৃত অভিজাত এলাকায়। একদিন পালাক্রমে আমার আতিথেয়তার সুযোগ আসে। নিমন্ত্রিত অতিথির মধ্যে আমায় একজন উপদেশ দেন বিদেশের মাটিতে এতো ভালো বাড়ীতে থাকার ফুটানি না দেখিয়ে কম দামের বাসাতেই থাকা ভাল- , তাতে পয়সাও বাচবে, সাথে সাথে সেনসেই দের সহানুভূতিও মিলবে। কথাটা বেশ মনে ধরলো। তাইতো এখানকার বাঙ্গালীরা আমার অর্ধেক ভাড়ার বাসায় থাকে। সেনসেইদের কাছে ইনিয়ে বিনিয়ে বলে সেইকাৎসু গা তাইহেন নে (life is very expansive)। তাতে অনেকেই বেশ সুফল পেয়েছে, বিশেষ করে কৃষিবিদরা। ওরা গবেষণার উদ্যানে উৎপাদিত মুলো, আলু, সিম, কপি সহ কেউ কেউ থাকার স্থানও পেয়েছে বিনামূল্যে। যদিও অধিকাংশ বাড়ীই তেলাপোকা অধ্যুষিত, তাতে কি? টাকাতো জমবে।
কথায় আছে সঙ্গদোষে লোহা ভাসে।আমিও ওদের দেখা দেখি ইউনিভার্সিটির কাছাকাছি কম দামে একটা বাসা পেয়ে যাই। জাপানী প্রতিবেশীরা আমায় স্থানান্তরে সাহায্য করে। পরদিন সকালে স্বল্প শিক্ষিত কর্মজীবী জাপানী প্রতিবেশীদের সাথে দেখা হয়। ওরা সমস্বরে আমাদের অভিবাদন জানায়। একজন কাল বিলম্ব না করে বলে ফেলে – সেই কাৎসু গা তাইহেন নে ….
যে এলাকায় বাসা নিয়েছি সেখানে অজস্র অশীতিপর বৃদ্ধ বৃদ্ধার বসবাস। অনেকেই সরকারের পারিতোষিকে চলে, অনেকে যুদ্ধ ফেরা সৈনিক। আমি কেন যেন এদেরকে পাকিস্তানীদের মতো এড়িয়ে চলি। যদিও জানি এদের অনেকেই হিতৈষী। তবু এদের দেখলেই জাপানী সৈনিকদের বর্বরোচিত আচরণের কথা মনে পড়ে। দেখা হলেই এরা পরম্পরাগত ভাবে মিটিমিটি চোখ নিয়ে মুখে একটা সুন্দর হাসি ঝুলিয়ে রাখে কিন্তু চোখের আড়াল হতেই প্রমিত ভাষায় কি যেন বলাবলি করে। ওসাকায় জাপানী ভাষা অধ্যয়ন কালে পড়েছিলেম – it is very Insidious to read the japanese mind । আমি তাই সদা সতর্ক। আমাদের বড় ভাই ডঃ আকবর আমাকে বারবার এদের থেকে একটু দূরে থাকতে বলেছেন। এরা যুদ্ধোত্তর জাপানের ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতি নিজ চোখে দেখেছে, আজকের এই বৈভবের পেছনে এদের রয়েছে অক্লান্ত শ্রম আর নিষ্ঠা। এরা বিদেশীদের ভালো চোখে দেখে না। এরা মনে করে আমরা শুধু ওদের রক্ত জল করা পয়সা লুটতে এসেছি। তাই এরা যেন জানতে না পারে আমরা জাপান সরকারের বৃত্তি নিয়ে পরিবার নিয়ে সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে দিনাতীপাত করছি।
একটা সরু গলি পার হলেই বড় এক রাস্তা। রাস্তার ধার ঘেঁষে একটা সলতের মতো নদী বয়ে গেছে। নদীর ধার টাইলসে বাধানো। স্বচ্ছ নদীর জলে ছোট ছোট মাছ (ছাকানা)খেলা করে। আমি সময় পেলেই দারা পরিবার নিয়ে ঘুরে বেড়াই নদীর ধার ধরে। সেদিন আমার ছোট্ট বাবুটাকে হাত ধরে নিয়ে গেছি নদীর জলের খুব কাছাকাছি। ওকে বলছি বাবা দেখ ছাকানা, বল ছাকানা। ও আধো আধো কণ্ঠে বলে ছাকানা। হঠাৎ দেখি এক বৃদ্ধ মৎস্য শিকারির পোশাক পড়ে জল থেকে কি যেন তুলছে। কৌতূহলী হয়ে কাছে যাই। ভুল ভেঙে যায়, ও মৎস্য শিকারি নয়। নদীর জলে কোন দুষ্ট ছেলে যদি কোন কিছু ফেলে, এদের কাজ হলো স্বেচ্ছাশ্রমে ওগুলো পরিষ্কার করা। নদীর ধারে ছোট্ট টুঙি ঘরে এরকম অনেক বৃদ্ধকে উৎ পেতে বসে থাকতে দেখেছি। ওরা যে অবসরে প্রকৃতিকে সুন্দর রাখার মহান ব্রতে নিজেদের উৎসর্গ করছে জেনে কৃতজ্ঞতায় মাথাটা নুয়ে এলো। আমি মাথা নুয়াতে মোটেই কার্পণ্য করি না।
এর পর থেকে ওদের সাথে আমার প্রায় প্রতিদিনই দেখা হয়। একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবার পথে ওদের সাথে দেখা। একজন আগ বাড়িয়ে আমায় অভিবাদন করে। আমার প্রতিত্তোর পাবার আগেই বলে ফেললো সেইকাৎসু গা তাইহেন নে । দোমো সুমিমাছেন, দোকো কারা ওকানে মোরাইমাসকা (মাফ করবে, টাকা কোথা থেকে পাও)? আমার বুকটা ধক করে উঠে। আকবর ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। আমার মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আর কোন পথ নেই। আমি বলি – কুনি নো সেইফু কারা (দেশের সরকারের কাছ থেকে) শুনে ওরা বিস্মিত । একে অপরের দিকে অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে বলে যায় – হন্ত ( সত্যি)। আমি সন্মতি সূচক মাথা নাড়িয়ে বলে চলি – জীবুন নো কুনি কারা ( আমার নিজ দেশ থেকে) । এবার সবাই সমস্বরে বলে আনাতা গা এরাই নে (তুমি তো এক বিশাল ব্যক্তিত্ব হে)…