মার্কিন গণতন্ত্র, শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদ |||| ডঃ শোয়েব সাঈদ
ট্রাম্প আমলে যুক্তরাষ্ট্রের যে রাজনৈতিক সংকটের সূচনা, তাকে অনেকেই গণতন্ত্রের সংকট বলতে চাচ্ছেন। ক্যাপিটল হিলের ঘটনার পর বাংলাদেশের সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র নিয়ে অনেক আলোচনা, লেখা দেখেছি, যাতে গভীর পর্যবেক্ষণের চাইতে নিজেদের রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা আর সুবিধের অনুকূলে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের নাজুক পরিস্থিতি নিয়ে মূল্যায়ন ছিল। গণতন্ত্রকে সংহত করার জন্যে প্রয়োজন অবাধ নির্বাচন ব্যবস্থা এবং এই ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক রূপটি তৈরি করতে প্রয়োজন দীর্ঘদিনের চর্চা। এগুলো যেমন একদিনে তৈরি হয়না আবার একবার তৈরি হলে তেমনি একদিনের ঘটনায় ভেঙ্গেও যায় না।
আমেরিকার ইতিহাসে ক্যাপিটলের হিলের সাম্প্রতিক ঘটনার কোন নজির নেই, মার্কিন গণতন্ত্রে এর কোন উদাহরণ নেই। মার্কিন গণতন্ত্রের এই বিভাজিত অবস্থা ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হবার পরেই যে তৈরি হয়েছে তা নয়, এর বীজ বোপিত ছিল মার্কিন সমাজের ভেতর যুগ যুগ ধরেই। শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদের দুষ্ট ক্ষতটি ট্রাম্প আমলে উন্মোচিত হয়েছে খুব নোংরাভাবে, তাতে ঝাঁকি খেয়েছে গণতন্ত্র। তবে সেই ঝাঁকুনি সামলে নেবার ক্ষমতা রয়েছে দেশটির। মার্কিন গণতন্ত্রের দুটো পিলার স্বাধীনতা আর আইনের শাসনের সক্ষমতা রয়েছে বিরূপ পরিস্থিতি সামলে নেবার।
তৃতীয় পিলার অর্থাৎ অবাধ আর সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থাটি ভীষণ চোট পেয়েছে ২০২০ এর নির্বাচনে ট্রাম্পের শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদের কাল্ট ধরণের রাজনীতির কারণে। কিন্তু এই কালো অধ্যায়ের মানে তো এই নয় যে মার্কিনীরা নিজেদের দেশের শাসন ব্যবস্থায় ফ্যাসিবাদের পথে হাঁটছে। পুঁজিবাদের কালো অধ্যায়ের ঘাত-প্রতিঘাতে ট্রাম্পের মত অরাজনৈতিক, শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদের কাল্ট চক্রের ক্ষমতায় চলে আসা মার্কিন গণতন্ত্রের দুর্বলতা বটে, মার্কিন রাজনীতিকে এটি প্রভাবিত করছে বটে, কিন্তু দিনশেষে আইনের শাসনের কারণেই মার্কিন গণতন্ত্র ঝাঁকুনি সামলে নিতে পারছে।
আইনের শাসনের জন্যে ন্যায়নিষ্ঠ আমলাতন্ত্র, নৈতিক বিচার বিভাগ, মুক্ত, প্রাণবন্ত মিডিয়া আর স্বাধীন সিভিল সোসাইটি খুবই জরুরী।
প্রবল ক্ষমতাশালী ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকার সব চেষ্টার পরেও কোন কিছুই অর্জন করতে পারেনি, এটাই মার্কিন গণতন্ত্রের টিকে থাকার সক্ষমতা। এই সক্ষমতা অর্জনে ন্যায়নিষ্ঠ আমলাতন্ত্রের বিরাট ভূমিকা। যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পালা বদলে আমলাতন্ত্রের মাথায় পরিবর্তনের সূচনা ঘটে, সেটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে, সংবিধানকে ডিফাই করার জন্যে নয়। আমলাতন্ত্রের একটি স্থায়ী সেট-আপ বরাবরই থাকে যাকে বলে “স্থায়ী সরকার”। সরকারের বিভিন্ন এজেন্সীর অলিগলিতে ছড়িয়ে থাকা তথাকথিত এই “স্থায়ী সরকারের” আমলাদের অধিকাংশের নিজস্ব রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সবাই রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব বাড়িতে রেখেই অফিসে আসে এবং প্রেসিডেন্ট কোন দলের তা ভুলে গিয়ে কংগ্রেস কর্তৃক প্রণীত আইনে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের ন্যায় সঙ্গত কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে যায়। হ্যাচ এক্টের মাধ্যমে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত সরকারি অফিসে নিজের রাজনৈতিক অবস্থানের পক্ষে আমলাদের সংযত হতে বাধ্য করা হয়। এভাবেই আইন এবং পরিস্থিতি নীতিহীন আমলাদের পিছু নেবার মাধ্যমে চেক এন্ড ব্যালেন্স বজার রাখে।
ট্রাম্প তৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্রের মত তার প্রতিপক্ষকে জেলে ঢুকানোর হুমকিও দিয়েছে। কিন্তু বিচার বিভাগের শীর্ষ পদে ট্রাম্পের পছন্দের মনোনয়নের পরেও সার্বিকভাবে বিচার বিভাগ সাংবিধানিক নীতি নৈতিকতার পথেই হেঁটেছে, গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্যে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষেই কাজ করে গেছে।
ট্রাম্প বরাবরই বলে এসেছে মিডিয়া জনগণের শত্রু। ট্রাম্পের বিরূপ আচরণের মধ্যেও মিডিয়া ট্রাম্পের একের পর এক কেলেংকারি প্রকাশ করে গেছে। রাষ্ট্র প্রধান কিংবা সরকার প্রধানকে প্রশ্ন করতে তোষামোদী ভূমিকায় অধিকাংশ সময় ব্যয় করেন তৃতীয় বিশ্বের অনেক সাংবাদিক, মার্কিন মিডিয়া সেই পথে হাঁটলে বিজয়ী হত ট্রাম্পরাই, কিন্তু মার্কিন মিডিয়ার দায়িত্বশীলতা অবশেষে গণতন্ত্রের বিজয়কেই নিশ্চিত করেছে।
আইনের শাসনের যথেষ্ট ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে ট্রাম্প। সংবিধানের প্রতি অনুগত নয়, বরং ব্যক্তি ট্রাম্প আর ট্রাম্প ইজমের প্রতি অনুগত করতে গিয়ে এফবিআই, গোয়েন্দা সংস্থা, সামরিক বাহিনী, পুলিশ, সিভিল আমলা সহ সব জায়গায় চাপ দিয়েছে বটে তবে সার্বিকভাবে কোন কাজে আসেনি। নিজের ট্যাক্স ফাঁকি থেকে বাঁচতে অনেক চেষ্টাই করেছেন, বিচার বিভাগে পছন্দের নিয়োগ দিয়ে ট্যাক্স বিষয়ে রুলিং নিজের পক্ষে নিতে পারেননি। ট্রাম্প বিশ্বের অনেক সরকার প্রধানের মত একনায়ক হবার পথে হাঁটতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সাংবিধানিক আর নির্বাহী প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তিশালী ভিত্তির কারণে চিৎকার চেঁচামিচি ছাড়া তেমন কিছুই করতে পারেনি।
ট্রাম্প সফল না হলেও মার্কিন নির্বাচন ব্যবস্থাকে একটি দুর্নামের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এই ঝুঁকি মোকাবিলা করা দরকার। পপুলার ভোটকে অবজ্ঞা করে ইলেকটোরাল ভোট নির্ভর বর্তমান ব্যবস্থার বিষয়ে নতুন করে ভাবার সময় হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা রাজনীতিবিদরা তাঁদের যুগের তুলনায় একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তৎকালীন গ্রামীণ ব্যবস্থা, শিক্ষার অপ্রতুলতা, যোগাযোগ ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা, কম গড়পড়তা আয়ুর অনগ্রসর সমাজ ব্যবস্থার আলোকে। বুশ, আল-গোরের নির্বাচন, ১৮৭৬ সালের হেইস বনাম টিলডেনের নির্বাচন জটিলতা সহ দুয়েকটি নির্বাচনে ঝামেলা হয়েছে বৈকি। আমেরিকান গণতন্ত্রের বার্ধক্যকে অনেকে সমস্যার কারণ বলে মনে করে। এই পুরাতন গণতন্ত্রের নবায়ন দরকার, সংশোধনীগুলো দুর্নাম মোকাবিলায় পর্যাপ্ত নয় বলেই মনে হচ্ছে। আফ্রিকান আমেরিকান, হিস্পানিক, নতুন প্রজন্মের মত নানা শ্রেণীর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট গণতন্ত্রে আধুনিকায়নটা জরুরী।
অনেক নতুন গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন আর গণতন্ত্রকে রক্ষার নানা রক্ষাকবচ তৈরি করা হয়েছে। ভারতের শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন, দক্ষিণ আফ্রিকা, তাইওয়ানের মত দেশে রয়েছে নির্বাচন পরিচালনায় শক্তিশালী ব্যবস্থা। নতুন গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে বিচার বিভাগের বিরাজনীতিকরণ টেকসই গণতন্ত্রের জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের রাজনৈতিক নিয়োগ ট্রাম্পের মত মানুষদের হাতে পড়লে বিপর্যয় তৈরি করতে পারে। বিচারকদের চাকুরীর বয়স আর নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বিশ্বের বহু দেশে খুব স্বচ্ছ প্রক্রিয়া রয়েছে। জাপানে সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের পর পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে জনগণ কর্তৃক অনুমোদিত হতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র এসব বিষয়ে অনেক পিছিয়ে, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সুপ্রিম কোর্টকে শুধু সংবিধানের ব্যাখ্যাকারী নয়, বলা হয় যুক্তরাষ্ট্রের ঐক্যের প্রতীক। এরকম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ অরাজনৈতিক হওয়াটা খুব জরুরী।
এসব সীমাদদ্ধতার পরেও আমেরিকার গণতন্ত্রের শক্ত ভিত্তি থাকার কারণে রাজনৈতিক জটিলতায় বিপর্যয়কর পরিস্থিতি এড়াতে যথেষ্ট সক্ষম। মার্কিন গণতন্ত্রের সুনাম আছে বটে, অন্তত হও বললে হয়ে যাবার মত প্রবল ক্ষমতাধর কোন নেতা তৈরি হবার সুযোগ নেই। তবে অবস্থানটা কখনোই আদর্শিক ছিলনা। গণতন্ত্রের উত্তম কোন রেফারেন্সে যুক্তরাষ্ট্রের নাম কিন্তু আসে না, সেরা গণতন্ত্রের দেশ বলার কোন সুযোগ নেই। গণতন্ত্রের সূচকে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা ২৫তম। প্রথম দশে স্কেনডিনেভিয়ানদের জয়জয়কার, সাথে আছে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড।
ট্রাম্পের বেপরোয়া আচরণ আর উনার উগ্র সমর্থকদের সৃষ্ট সমস্যা কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে অবাধ আর নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থার দুর্বলতা থেকে উদ্ভূত নয়। বরং কট্টরপন্থী রক্ষনশীল মতবাদ নিয়ে জনগণের ভোটে অবাধ আর নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যেমেই ট্রাম্পের ক্ষমতার আসা। ব্যক্তি ট্রাম্পের মাফিয়া মার্কা আচরণের কারণে মার্কিন নির্বাচন ব্যবস্থায় কিছু দুর্বলতা দৃষ্টি গোচর হয়েছে বটে কিন্তু দিনশেষে এই নির্বাচন ব্যবস্থাই ট্রাম্পকে বেপরোয়া হতে বাঁধা দিয়েছে, আটকে দিয়েছে যা খুশী করার ইচ্ছেকে। এর অন্যতম কারণ নিরপেক্ষ নির্বাচনকে নিশ্চিত করার জন্যে সহযোগী অন্যান্য সাংবিধানিক আর নির্বাহী প্রতিষ্ঠানগুলোর আইনের শাসনের প্রতি আনুগত্য। সামরিক, বেসামরিক আমলারা কিংবা আইন শৃঙ্খলাকারীদের ব্যক্তিগত স্বার্থ, পদোন্নতি, ক্ষমতার মত বিষয়গুলি ট্রাম্পের নির্বাচনে জয়ী হবার মেকানিজমের সাথে কোন অবস্থাতেই জড়িত ছিলনা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনিক সিস্টেমে, ফেডারেল আর রাজ্যের ক্ষমতার ভারসাম্য আর বিকেন্দ্রীকরণে এর কোন সুযোগ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে অবাধ আর সুষ্ঠুতা নিয়ে ঢালাও মন্তব্যের আগে এই পার্থক্যগুলো অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে।
মানুষের চারিত্রিক মেকআপের প্যাটার্নটির জন্যে শিক্ষা আর সভ্যতার দীর্ঘদিনের চর্চাটি গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রে জনগণের মধ্যে বহু নেতিবাচক বৈশিষ্ট থাকলেও এদের সরকারি আর বেসরকারি নির্বাহীদের মধ্যে আত্মসন্মানবোধের কিছু মৌলিক নর্মস কাজ করে, যার ফলে বিচ্ছিন্ন কিছু উদাহরণ ছাড়া নিজ জনগণ, রাষ্ট্র, সংবিধান আর ন্যায়-নিষ্ঠতার প্রতি আনুগত্যকে অগ্রাহ্য করে লোভের কারণে নিজেকে অন্যায়ের কাছে সমর্পণের সংস্কৃতি বিরল, সামষ্টিকভাবে একেবারেই অনুপস্থিত। ব্যক্তি স্বাধীনতা আর আত্মমর্যাদাবোধ মার্কিন সমাজে ট্রাম্পের মত কোন মন্সস্টারের উত্থানকে আটকে দিতে সক্ষম এটি ভুলে গেলে মার্কিন রাজনীতি বিশ্লেষণে অবিচার করা হবে।
মার্কিন নির্বাচন ব্যবস্থা, গণতন্ত্র গেল গেল বলে তৃপ্ত হবার আগে জর্জিয়ার রাজ্য সচিবের কথা আমরা ভুলি কি করে। যুক্তরাষ্ট্রে রাজ্যগুলোর রাজ্যসচিব রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত এবং ফেডারেল থেকে রাজ্যের বিভিন্ন স্তরের নির্বাচন বিষয়ে দায়িত্ব প্রাপ্ত। জর্জিয়ার রাজ্যসচিব ব্রাড রাফেনস্পারজার ট্রাম্পের রিপাবলিকান দলের লোক। ট্রাম্প নিজে আর ডাকসাইটের আইনজীবীর সহায়তায় এক ঘণ্টা কথা বলে রাজ্য সচিবকে তার পক্ষে কারচুপির জন্যে ব্যাপক চাপ দিয়েছে। বিশ্ববাসী ইতিমধ্যে এই কথোপকথন শুনেছে। রাজ্যসচিব দৃঢ়তার সাথে ট্রাম্পের দাবীর প্রতি দ্বিমত পোষণ করে নির্বাচনী সততার পক্ষে, সংবিধানের পক্ষেই অবস্থান নিলেন, তার দলের রাষ্ট্রপতির পক্ষে নয়। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব আর আত্মমর্যাদাবোধ যখন শিক্ষিত সমাজের, নির্বাহীদের ব্র্যান্ড হয়ে যায়, অসততা তখন আপনা থেকেই সটকে পড়ে।
সংকটকালে কট্টরপন্থী রাজনীতিবিদদেরও জনগণ আর সংবিধানের পক্ষেই দাড়াতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রে কিছু উগ্র রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক আদর্শিক রাজনৈতিক আছেন যারা সংকটকালে দেশের ঐক্যের প্রতীক হয়ে যান। ট্রাম্প সমর্থকদের ক্যাপিটল হিলকে লাঞ্চিত করার কলঙ্কময় একই দিনে বাইডেনের জয়কে আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের জন্যে রাতভর কংগ্রেসের উভয় কক্ষের রাজনীতিবিদের সংবিধান আর জনগণের প্রতি চরম আনুগত্যের আর দায়িত্বশীলতার এপিসোডটি গণতন্ত্রের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। বিগোট রাষ্ট্রপতির গুণ্ডামিকে অগ্রাহ্য করতে উপ রাষ্ট্রপতি, হাউজ আর সিনেট নেতৃত্বের পক্ষ বিপক্ষ রাজনৈতিকরা যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের কালো দিনে একই সাথে যে আলোকিত উদাহরণ তৈরি করলেন, জনগণের (জন্যে, দ্বারা) সরকারের দায়বদ্ধতায় এক অনন্য সাধারণ উদাহরণ।
ট্রাম্প কর্তৃক সৃষ্ট সমস্যাটি ছিল মূলত শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের অস্তিত্বের লড়াই। কেন এই লড়াই? যার কারণে ট্রাম্পকে ক্ষমতায় থাকতেই হবে, ভোটারদের ভোট না পেলেও কিংবা ক্যাপিটল হিল দখল করে হলেও। এর কারণ শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের ক্রমশ সংখ্যা লঘু হয়ে আসাকে নিয়ে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা আর এটিকে এদের অস্তিত্বের জন্যে হুমকি মনে করা। ট্রাম্প আর তার সমর্থকদের উগ্র চিন্তা চেতনা, ভাবনা নতুন কিছু নয়, পশ্চিমাদের বিশেষ করে মার্কিনীদের মননে গেঁথে আছে শত শত বছর ধরে। ফলশ্রুতিতে ২০২০ সালের প্রাযুক্তিক উৎকর্ষের আর অধিকতর মানবিক বিশ্ব ব্যবস্থার মধ্যেও ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েস্ট সিনেমার মানসিকতা থেকে বের হতে পারেনি বহু আমেরিকান।
আধুনিক আমেরিকার প্রাযুক্তিক, সামরিক আর অর্থনৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের জন্যে যাদের অবদান সবচেয়ে কম, ভোগে আবার এদের অংশগ্রহণ বেশী। গ্লোবালাইজেশনের ফলে এরা শঙ্কিত আর তাই এটি তাঁদের মরণ কামড়। ট্রাম্পের বিজয়ের পর একটি লেখায় বলেছিলাম ট্রাম্পের উত্থান শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের যুগের শেষের শুরু। যুক্তরাষ্ট্রের ২০২০ সালের নির্বাচন নিয়ে “লিটিগেশনে নির্বাচন আর মার্কিন সভ্যতা” শীর্ষক একটি লেখায় বলেছিলাম মার্কিন সভ্যতার আলোর ছোঁয়া লাগেনি যে সব অংশে শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা মূলত সেই অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। যুক্তরাষ্ট্রে জ্ঞান-বিজ্ঞানে ভূমিকা রাখে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর ইমিগ্রেন্ট প্রধান পশ্চিম প্রান্তের প্রশান্ত মহাসাগরের তীরবর্তী আর উত্তর পূর্বের আটলান্টিকের তীরবর্তী রাজ্যগুলো এবং সভ্যতার আলো এখানে বৈশ্বিক মানদণ্ডে আভা ছড়াচ্ছে, বিশ্বের সেরা সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংখ্যা এসব অঞ্চলেই বেশী। ট্রাম্প সমর্থক মধ্যবর্তী অঞ্চলের রাজ্যগুলো আগে থেকেই দায়িত্বশীলতা আর মানবিকতার চেয়ে নিজের স্বার্থ-সংশ্লিষ্টতায় বাড়াবাড়ি ধরণের আগ্রাসী।
ক্যাপিটল হিলের আক্রমণকারীদের চেহারা সুরুত, ভাবভঙ্গি যারা দেখেছেন, তাঁরা নিশ্চয় ধারণা করতে পারবেন ট্রাম্প সমর্থকদের শ্রেণী বিন্যাসটি। এই শ্রেণীটির পৃষ্টপোষক ট্রাম্পের মত কিছু ধনী, মোটা বুদ্ধির আলট্রা রক্ষণশীলরা। এরা আপাতত রিপাবলিকানদের ঘাড়ে সওয়ার হলেও একটা সময় মডারেট রিপাবলিকানদের মধ্যেও বিরক্তি উৎপাদন হবে যার লক্ষণ ইতিমধ্যেও স্পষ্ট। কোন কোন উচ্চাবিলাসী রক্ষণশীল রাজনৈতিক এই শ্রেণীটিকে ব্যবহার করে ফায়দা লুটবে বটে, আরো কিছু বছর এদের চেঁচামিচি মার্কিন রাজনীতি আর গণতন্ত্রকে ব্যস্ত রাখবে বটে, তবে সময়ের পরিক্রমায় এদের শক্তি ক্ষয় হতে বাধ্য।
একটা সময় শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা নীরবেই তাঁদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারত, এখন সমস্যা হচ্ছে বলেই এদের ক্ষোভ, শক্তি প্রদর্শন। শক্তি প্রদর্শনে শক্তি ক্ষয় হয়ে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে যাবার সম্ভাবনা বেশী। ক্যাপিটল হিলের আক্রমণ এদের শক্তি যোগাবে না বরং এদের বিরুদ্ধে বাকীদের অবস্থানকেই সংহত করবে। ট্রাম্পের মাফিয়া কর্মকাণ্ডে রিপাবলিকানরা শুধু প্রেসিডেন্ট নয়, সিনেটেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। কিছু উগ্রপন্থী সিনেটর আর ট্রাম্পের এই ভূমিকার হিসেবনিকেশ আনচ্যালেঞ্জড যাবার কথা নয়।
ট্রাম্পের নানা বিতর্কের মধ্যেও ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের ট্রাম্পের প্রতি ধীর স্থির আর কমিটেড আনুগত্য ছিল দেখার মত। কিন্তু শেষতক ট্রাম্পের বাড়াবাড়ি আর নিতে পারেননি পেন্স। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আর সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যকার পার্থক্য রাজনীতির কঠিন বাস্তবতা বটে।
আজকের যুক্তরাষ্ট্রের সার্বিক অবকাঠামোতে অপেক্ষাকৃত নতুন ইমিগ্রেন্টদের অবদান বিশাল যা শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের কাছে অস্তিত্বের হুমকি। ফলে ক্ষমতায় গিয়ে ট্রাম্পের প্রধান কাজ ছিল ইমিগ্রেশনের বিরুদ্ধে অবস্থান। আজকের গ্লোবালাইজেশনের বাস্তবতায় এই অবস্থান ব্যাক ফায়ার করতে বাধ্য। আমেরিকা গ্রেট এই দাবীর পেছনের রূপকারদের মধ্যে বিভাজন যদি করতে হয়, শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের চাইতে ইমিগ্রেন্টদের দাবীটাই বেশী যৌক্তিক, ডাটা কিন্তু তাই বলছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির অগ্রসরতার কেন্দ্রে আছে ইমিগ্রেন্টগণ। যুক্তরাষ্ট্রে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে কর্মরত মানব সম্পদের প্রায় ৩০% বিদেশে জন্ম গ্রহণকারী। এদের সাথে প্রথম আর দ্বিতীয় জেনারেশনের ইমিগ্রেন্টদের যোগ করলে সংখ্যাটা কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যায় খুব সহজেই। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ গবেষকদের জন্ম বিদেশে। একটি উদাহরণ, ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে ৬ জন নোবেল পেলেন তাঁদের সবায় জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে। যুক্তরাষ্ট্রে এযাবৎ পাওয়া নোবেল প্রাইজের ৩০% এর জন্ম বাইরের দেশে, ইমিগ্রেন্টদের ইমিডিয়েট প্রজন্ম যোগ করলে এই সংখ্যাটিও সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যায়। এই বাস্তবতার প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্যের বেশ কিছু সংবাদপত্রে রাজনীতিবিদের ইমিগ্রেশনের বিরুদ্ধে অবস্থানে বিষয়ে সতর্ক করা হয়।
শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের বড় অংশই শিক্ষা দীক্ষায় পিছিয়ে, এদের চালায় এদের শিক্ষিত অংশ। ইমিগ্রেন্ট নিয়ে অবস্থানেও এদের বিভাজন আছে। আফ্রো-এশিয়ান ইমিগ্রেন্ট আর ইউরোপিয়ান ইমিগ্রেন্ট বিষয়ে এদের ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গি। ট্রাম্পের ব্যক্তিগত ক্ষমতার লোভ এবং কৌশল শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের চিন্তা চেতনাগুলো ব্যবহার করতে গিয়ে মার্কিন সমাজের দগদগে ঘা টুকু একেবারে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এই ঘা টুকু কি শুকাবে, না ম্যালিগ্নেন্সীর দিকে যাবে সময়ই বলে দেবে। আমার ব্যক্তিগত অভিমত শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের জন্যে ক্ষয়িষ্ণু সময় আপেক্ষারত। শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের আবেগ ব্যবহার করে ট্রাম্প মার্কিন নির্বাচন ব্যবস্থাকে যেভাবে বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছে, এটি হয়তো মার্কিন গণতন্ত্রকে দিনশেষে ভাবমূর্তি উদ্ধারে কিংবা সংস্কারে প্রেরণা যোগাবে।