বর্তমান সঙ্কটময় পরিস্থতি বিবেচনায় প্রতিনিয়ত পত্রিকার পাতায় খারাপ খবরই চোখে বেশি পড়ে। তারপরও দু’একটি সুখবরের প্রত্যাশায় প্রতিদিন সংবাদপত্রে চোখ বুলিয়ে যাই। ভাবি; অন্তত: একটি সংবাদ হলেও দৃষ্টিগোচর হবে যা মনের খোরাক যোগাবে, আমাদের আনন্দ দান করবে। নিজ দেশের ইতিবাচক খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হলে স্বাভাবিকভাবেই মন উৎফুল্ল থাকে। নেতিবাচক খবর মনকে আরো খারাপ করে রাখে। যদি নেতিবাচক খবর উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত হয়ে থাকে তাহলে মন আরো বিষণ্নতায় নিমজ্জিত থাকে।
কিছুদিন আগে পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারি যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিং নির্ণয়কারী প্রতিষ্ঠান কিউএস বিশ্বের সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ে একটি র্যাংকিং প্রকাশ করে। র্যাংকিংটি ২০২১ সালের জন্য নির্ণীত করা হয়। কিউএস যুক্তরাজ্যের এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা সারা বিশ্বের এক হাজার বিশ্বিবদ্যালয়ের র্যাংকিং প্রকাশ করে থাকে। র্যাংকিং বিবেচনায় আমাদের দেশের মাত্র দু’টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে। একটি হলো বুয়েট অন্যটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তাও বিশ্ববিদ্যালয় দু’টি শেষের দিকে স্থান করে নিয়েছে। দেশের অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয় নেই!
যুক্তরাজ্যের সিআইবি নেতা রিচার্ড ল্যাম্বার্ড ‘ The Lambert Review of Business University Collaboration’- এর এক প্রতিবেদনে ২০০৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং বিষয়ক ধারণাটি প্রথমে সামনে নিয়ে আসেন। এরপর থেকেই কয়েকটি সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং বিষয় নিয়ে কাজ করা শুরু করে। সেগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য হল যুক্তরাজ্যের টাইমস হায়ার এডুকেশন(টিএইচই) ও কিউ এস এবং চীন থেকে প্রকাশিত একাডেমিক র্যাংকিং অব ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিজ।
তবে সেই প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ কতগুলো উপাত্তের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন সূচকের মাধ্যমে র্যাংকিং প্রকাশ করে থাকে। প্রথমদিকে অর্থাৎ ২০০৪ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত Times Higher Education(THE) এবং QS(Quacquarelli Symonds) একত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং প্রকাশ করে। কিন্তু, ২০১০ সাল থেকে কিউএস এবং টাইমস হায়ার এডুকেশন আলাদাভাবে র্যাংকিংপ্রকাশ করা শুরু করে।
তবে, যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত QS(Quacquarelli Symonds) বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং নির্ণয়ে প্রথম থেকেই বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে আসছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং নির্ণয়ে কিউএস- এর গ্রহণযোগ্যতা তুলনামুলকভাবে বেশি। কিউএস বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং নির্ণয়ে মোট ছয়টি সূচকের মাধ্যমে সামগ্রীক মান নিরূপন করে থাকে।
সূচক ছয়টি হলো: একাডেমিক খ্যাতি, চাকরির বাজারে সুনাম, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, শিক্ষক প্রতি গবেষণা উদ্ধৃতি, আন্তর্জাতিক শিক্ষক অনুপাত এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী অনুপাত।
একাডেমিক খ্যাতি বা রেপুটেশন বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিংতৈরিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। এই পদ্ধতিতে র্যাংকিং নির্ণয়ের জন্য ৪০ মার্কস বরাদ্দ রাখা হয়। এক্ষেত্রে অতি নামি-দামী বিশ্ববিদ্যিলয়ের নাম র্যাংকিংয়ের সামনে চলে আসাই স্বাভাবিক। একাডেমিক খ্যাতি বা রেপুটেশন সূচক নির্ধারনের জন্য সারা বিশ্ব থেকে উচ্চ শিক্ষায় সম্পৃক্ত গবেষকদের মতামত চাওয়া হয়। তারা নিজ প্রতিষ্ঠান ব্যতীত অন্য ত্রিশটি বিশ্ববিদ্যালয়কে ভোট প্রদান করতে পারেন। যাদের মতামতের ভিত্তিতে নেয়া হয় তাদের অবশ্যই কমপক্ষে দশ বছরের উপরে উচ্চ শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত থাকতে হবে। ২০১৭-১৮ সালে ৭৫,০১৫ জন গবেষকের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে সূচক নির্ণয় করা হয়। তবে আমাদের দেশে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত গবেষণা হয় না। শিক্ষাখাতে যে বরাদ্দ রাখা হয় বিশ্ববিদ্যালয়র বেতন ও পরিচালনার ব্যয় নির্বাহ করতেই চলে যায়। গবেষণাখাতে বরাদ্দ রাখা হয় ২.৩ শতাংশ যা গবেষণা খাতের জন্য খুবই কম বলা চলে।
আরেকটি সূচক হলো চাকরির বাজারে সুনাম। সময়ের আবর্তনে এই সূচকটি যেকোন সময় পরিবর্তিত হতে পারে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এই সূচক অক্ষুন্ন রাখা অত্যন্ত কঠিন ব্যপার। এক্ষেত্রে চাকরি বাজার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালণ করে। চাকরির বাজারে সুনাম খ্যাত সকল প্রতিষ্ঠানের কাছে জানতে চাওয়া হয় কোন বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েট কেমন তৈরি করছে। তাদের মতামতের উপর ভিত্তি করে সূচক নির্ধারণ করা হয়। এই সূচকে ১০ মার্কস ইন্ডিকেটর রূপে কাজ করে। তাই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভাল অবস্থান দখল করে আছে তাদের পক্ষে মতামত প্রাধান্য পায় বলে র্যাংকিং নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সঠিক প্রতিফলন নির্দেশ করতে সহায়তা করে। অন্যান্য উন্নত দেশের
গ্র্যাজুয়েটদের তুলনায় আমাদের দেশের অতি কম সংখ্যক গ্র্যাজুয়েটই বিশ্বের সুনামখ্যাত প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত রয়েছে। তাই সূচক নির্ণয়ে আমরা স্বাভাবিকভাবেই পিছিয়ে যাই।
পরের সূচকটি হলো শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত। কোন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতের উপর ভিত্তি করে এটি নির্ণয় করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতিক হার যত কম হবে ততই গুণাগুণ সম্পন্ন হবে এই ধারণার উপর ভিত্তি করে সূচক নির্ণীত হয়ে থাকে। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা ধরে রাখতে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। র্যাংকিং নির্ণয়ের জন্য এখানে ২০ মার্কস বরাদ্দ রাখা হয়।
শিক্ষক প্রতি গবেষণা উদ্ধৃতি র্যাংকিং নির্ণয়ে আরেকটি ইন্ডিকেটর। এটি আসলে প্রথম সূচকটির সাথে সম্পৃক্ততার নামান্তর মাত্র। কোন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কয়টি গবেষণা বের হলো তার সূচক নির্দেশ করে। তবে বড় বিশ্বিবিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে বেশি গবেষণা প্রকাশিত হলেই যে বেশি মান নিরূপিত হবে তেমনটি কিন্তু নয়। কারণ, প্রতিটি গবেষণার বিপরীতে মোট শিক্ষকের সংখ্যা নিরূপিত হয়ে থাকে। সূচকটিতে র্যাংকিং নির্ণয়ের জন্য ২০ মার্কস বরাদ্দ রাখা হয়। তাই কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশি শিক্ষক বা কম শিক্ষক সেখানে কোন প্রভাব ফেলবে না। কয়টি গবেষনার উদ্ধৃতি বের হয়েছে তার উপর নির্ভর করবে। একাডেমিক খ্যাতি এবং শিক্ষক প্রতি গবেষণা উদ্ধৃতি সূচক দুটি বলতে গেলে পরিপূরকই বটে। অর্থাৎ যে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার স্থান যত বেশি পাবে র্যাংকিংয়ে উপরের দিকে আসা সহজতর হবে। দু’টি সূচকে মোট ৬০ মার্কস গবেষণা তথ্যের উপরই নির্ভর করে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুতিকাগার রূপে গবেষণাগার অত্যাবশ্যক যা আমাদের দেশে তুলনামুলকভাবেই কম।
অন্য একটি সূচক হলো আন্তর্জাতিক শিক্ষক অনুপাত। এই সূচকে ৫ মার্কস বরাদ্দ থাকে। একটি দেশে আন্তর্জাতিক শিক্ষক নিয়োগের উপর নির্ভর করে সূচকটি নির্ধারিত হয়। আমাদের দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আন্তর্জাতিক শিক্ষক নেই বললেই চলে। তাই উক্ত সূচকটিও আমাদের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে র্যাংকিংনির্ণয়ের ক্ষেত্রে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে।
অপর সূচকটি হলো আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী অনুপাত। একটি দেশের মাঝে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যার উপর ভিত্তি করে জরিপ করা হয়। অন্যান্য দেশ থেকে আগত আমাদের দেশে শিক্ষার্থী অনুপাত তুলনামুলকভাবে খুবই কম থাকে। সেজন্য সূচকটি আমাদের জন্য নেতিবাচকই বটে।
সকল সূচক বিবেচনায় এগিয়ে থেকে পার্শ্ববর্তী দুটি দেশ ভরতের ২১ টি এবং পাকিস্থানের ৭ টি বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিংয়ে স্থান পায়। অথচ আমাদেরও গর্বের বিষয় হতে পারতো একসময়ের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে।
স্বপ্নের স্তরে উঠার পরিস্ফুটনে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ আমাদের নিকট অতিমুল্যবান। তবে আমাদের উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করলেও সামনের দিকে ধাবমান হওয়া কঠিন বাস্তবতায় ঠেকে।আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। তা না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগমুহূর্তে কল্পিত মনে যে আশাটুকু নিয়ে কোন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় তাতেও ছেদ পড়ে! যেটা আমিও অনুভব করেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর।
ক্লাস শুরুর পর্যায়েই প্রায় দেড় বছর জলাঞ্জলি দিতে হয়েছিল। তখনো বুঝতে পারিনি শিক্ষাক্ষেত্রে সেশনজটের কালো থাবা জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে! সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোন অভিভাবক শিক্ষাক্ষেত্রে খোঁজে পাইনি। সেমিস্টারের এক ক্রেডিটের কোর্স সপ্তাহে এক ঘন্টা হওয়ার কথা থাকলেও, চার ক্রেডিটের কোর্স সর্বমোট চারটি ক্লাসের (চার ঘন্টা) মাধ্যমেই পরিসমাপ্তি ঘটতেও দেখেছি! ম্যাড়ম্যাড়ে অবস্থানে থেকে কোনভাবে অনার্স শেষ করে মাস্টার্সের পরীক্ষা দিলেও প্রায় এক বছর পর চূড়ান্ত ফলাফল হাতে আসে। পাঁচ বছরের কোর্স সম্পন্ন করতে মোট সময় ব্যয় হয়েছিল আট বছর!
এই সমস্যাসমুহ কাটিয়ে উঠা কষ্টকরই বটে। তারপরও আমরা আশাবাদী যে সমস্যা ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে দেশের শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশটুকু প্রতিফলিত হবে। ভবিষ্যতে র্যাংকিং নির্ণয়ে আমাদের দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে থাকবে।
-অঞ্জন কুমার রায় । ব্যাংকার ও লেখক