নতুন সূর্যে মিইয়ে যাক বিভীষিকাময় রাত
শামীমুল হক || মেঘে ঢাকা নীল আকাশ। চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। আতঙ্ক সর্বত্র। হঠাৎ দৈব বিস্ফোরণ। কাঁপছে বিশ্ব। কাঁপছে প্রিয় বাংলাদেশ। অদৃশ্য করোনার থাবা।
সন্দেহের বীজ সবার মনে। ঘরে, বাইরে, হাসপাতালে লাশ। ভয়ে আপনজনের লাশের কাছেও যেতে অনীহা। এ এক অন্যরকম চিত্র। পৃথিবী যেন বদলে গেছে। হারিয়ে গেছে মায়া মমতা। কিন্তু এ থেকে নিস্তারের কী উপায়? পরামর্শ এলো নিজেকে বন্দি করে রাখা। এতেও রেহাই নেই। বন্দি অবস্থায়ও করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। দিশাহারা মানুষের এমন নিয়তি কি কেউ কখনো ভেবেছিলেন? না! কিন্তু এমন এক কঠিন পরিস্থিতিকে সঙ্গী করেই হাজির হয় ২০২১ সাল। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও শিল্পখাতকে বিপর্যস্ত করে তোলে। অর্থনীতির চাকা থমকে দাঁড়ায়। করোনা দেশবাসীকে দেখিয়ে দিয়ে যায় স্বাস্থ্যখাতের বেহাল দশা। করোনা টেস্টের রেজাল্টেও যেখানে ভেজাল। দুর্নীতির একের পর এক ভয়াল থাবা স্বাস্থ্যখাতে। অবিশ্বাস্য সব কাহিনী। মানুষ থ হয়ে যায় দুর্নীতির এমন চিত্র দেখে। আর শিক্ষাখাতকে করে যায় তছনছ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ মাসের পর মাস। শিকেয় উঠে লেখাপড়া। শিক্ষাজট লেগে যায় সকল পর্যায়ে। এই সেশনজটে পড়ে এসএসসি থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত। মোটকথা শিক্ষা ক্যালেন্ডার ওলট-পালট করে দেয়। সেশনজটে অনেকের আবার চাকরির বয়সসীমা পেরিয়ে গেছে। অন্ধকার নেমে এসেছে কারো কারো জীবনে। আর দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি শিল্পখাতের চাকা অচল হয়ে পড়ে। এ থেকে বাঁচতে মালিকরা ছাঁটাই করতে থাকেন কর্মকর্তা-কর্মচারী। জনশক্তির বাজার সংকুচিত হয়ে পড়ে। বহু প্রবাসী বেকার হয়ে দেশে ফেরেন। ভালোবাসা, মায়া, মমতাকে পায়ে পিষে মারে এই করোনা। স্বামী হন স্ত্রী হারা। স্ত্রী স্বামী হারা। সন্তান হন পিতৃহারা। মাতৃহারা। কেউ হারান আদরের ভাই। কেউবা বোন। আগের বছরের জের টেনে আনে করোনার নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টের হানা। গলদঘর্ম বিজ্ঞানীরা। এরই মধ্যে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের হানা বিশ্বজুড়ে। বাংলাদেশেও ওমিক্রন শনাক্ত হওয়ার মধে দিয়ে নতুন বছরের আগমন। আজ ভোরের সূর্য উঁকি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদায় নেবে ঘটনাবহুল ২০২১ সাল। নতুন আলোয় যোগ হবে ২০২২। আজকের ভোরের আলো নিয়ে আসবে নতুন বছরের বার্তা। নতুন বছরে নতুন আশা মানুষ দেখছে কোথায়? বিষাদের কালো ছায়া যে আস্টেপৃষ্টে আছে গোটা পৃথিবীজুড়ে। অজানা, অদৃশ্য করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেল বছর টিকা আবিষ্কার হয়। উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনুন্নত দেশগুলোও টিকার পেছনে দৌড়ায়। এখনো দৌড়াচ্ছে। এরই মধ্যে করোনায় খাওয়ার ওষুধ এনেছে বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মা। গভীর হতাশার মাঝে এ যেন এক আলোক বর্তিকা। কিন্তু এই করোনা অগণিত মানুষকে করে গেছে কর্মহীন। অর্থহীন। যারা গরিব থেকে আরও গরিব হয়েছে। কেউ কেউ নিঃস্ব হয়েছে। কেউ হারিয়েছেন বাসস্থান। তাদের জীবনযুদ্ধকে করে গেছে ইস্পাত কঠিন। ২০২২ সালে কি করোনা থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে? এখানেও হতাশা। যুদ্ধ চালিয়ে যেতেই হবে। এ এক অসম যুদ্ধ। পৃথিবীর সাতশ’ কোটির বেশি মানুষ প্রার্থনা করছেন প্রতিনিয়ত এ থেকে রক্ষা পাওয়ার। মানুষ আশাবাদী। আশা নিয়েই বেঁচে থাকে। রঙিন স্বপ্ন দেখে। করোনার ক্ষেত্রে যে স্বপ্নও দেখার জো নেই। করোনা ছাড়াও ২০২১ সালে দেশে ঘটে গেছে বহু আলোচিত ঘটনা। সারা বছরই আলোচনায় ছিল সড়কে মৃত্য ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। গত বছরের ১৪ই জানুয়রি টেকনাফ নয়াপাড়া রোহিঙ্গা বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডে পাঁচ শতাধিক বসতি পুড়ে যায়। উখিয়া রোহিঙ্গা শিবিরে অগ্নিকাণ্ড মারা যায় ১৫ জন। ৭ই জুন রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ২৭শে জুন রাজধানীর মগবাজারের একটি ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণে মারা যায় ১২ জন। ৮ই জুলাই নারায়ণগঞ্জের সেজান জুস কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে কমপক্ষে ৫০ জন মারা যায়। সর্বশেষ ২৩শে ডিসেম্বর ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে লঞ্চে বিস্ফোরণে আগুন লাগে। এমভি অভিযান-১০ নামের এ লঞ্চে মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডে ৪২ যাত্রী লাশ হয়। এখনও অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন। কি ভয়ানক! আগুন নেভাতে প্রয়োজন হয় পানির। অথচ এই পানিতে ভেসে থাকা লঞ্চে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। পানি থাকতেও আগুন নেভানো গেল না। বছরের শেষদিকে এসে সড়কে মৃত্যুর প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে। ২৪শে নভেম্বর গুলিস্তানে রাস্তা পার হতে গিয়ে নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান মারা যান। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির চাপায় নাঈমের মৃত্যু সারা দেশকে নাড়া দেয়। শিক্ষার্থীরা নেমে আসেন রাজপথে। এরই মধ্যে উত্তর সিটি করপোরেশনের লোগো লাগানো একটি গাড়ি চাপায় মারা যায় আরও একজন। আন্দোলনের মাঝেই অনাবিল বাসের চাপায় বাড্ডা এলাকায় মারা যান আরেক কলেজছাত্র। এ নিয়ে হয় গাড়ি ভাঙচুর। এতকিছুর পরও সড়ক দুর্ঘটনা কমেনি। বরং বাড়ছে। সড়ক দুর্ঘটনা এখন এক মহামারির নাম।
১৩ই অক্টোবর সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গা পূজার অষ্টমীর দিন কুমিল্লার নানুয়ারদীঘি এলাকার একটি মণ্ডপে হনুমান মূর্তির পায়ের নিচে মুসলমানদের পবিত্র কোরআন শরীফ রাখার ঘটনায় উত্তাল হয়ে ওঠে দেশ। এর জেরে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে সংঘর্ষে ৫ জন নিহত হন। এছাড়া নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ, রংপুরের পীরগঞ্জ, কক্সবাজার, সিলেট, মৌলভীবাজার উত্তাল হয়ে ওঠে। বছরের শেষদিকে এসে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার দাবিতে বিএনপি রাজপথে নামে। জেলায় জেলায় তারা সমাবেশ করে। এরমধ্যে ফেনী, হবিগঞ্জসহ ক’টি জেলায় ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এ আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে।
বিশ্বের মানুষের এ মুহূর্তে প্রার্থনা মহান সৃষ্টিকর্তা করোনামুক্ত বিশ্ব উপহার দিক। মানুষ আগের মতো নিঃসঙ্কোচে, মন উজাড় করে হাসুক। নতুন বছরে পৃথিবী ফিরে যাক আগের রূপে। হিংসা-হানাহানি থেকে মুক্ত থাকুক মানুষ। ভালোবাসায় উজাড় করে দিক নিজেকে।
নতুন বছর মানেই নতুন আনন্দ। নির্মল আনন্দই মানুষকে সুন্দর হতে শেখায়। আনন্দের ভেতর দিয়ে সুন্দর হতে হবে। বড় হতে হবে। এই বড়, দেহে কিংবা সম্পদে নয়। মানুষ হিসেবে বড়। মন ও মননের দিক থেকে বড়। মনের দিক থেকে বড় না হলে কোনো নতুনকে স্বাগত জানানো যায় না। নতুনকে গ্রহণ করা যায় না। বরণ করা যায় না। দিন দিন করে মাস যায়। মাস মাস করে বছর। বছর বছর করে বেড়ে ওঠে জীবন। এভাবেই জীবনের সঙ্গে জীবনকে জোড়া দিয়ে পথ চলতে হয়। মানুষ জীবনের জন্য কাজ করে। জীবনের জন্য এগিয়ে যায়। জীবনের জন্যই পথচলা। এই পথচলা যেন সবার জন্য সুগম হয়- নতুন বছরে এটাই কামনা। গুড বাই ২০২১। ওয়েলকাম ২০২২। বিভীষিকাময় দীর্ঘ রাত যেন শেষ হয় নতুর সূর্যের তাপে। -মানবজমিন
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান