বৈচিত্রময় কানাডা : প্রাগৈতিহাসিক থেকে বর্তমান একটি পর্যালোচনা ।।। আকবর হোসেন
আমাদের টরন্টো শহরের বাসিন্দা শ্রী ননীগোপাল দেবনাথ কানাডাকে এই নানা চমকপ্রদ তথ্যে ভরা এই বইটির রচয়িতা। অনুন্নত বিশ্ব থেকে আমরা যারা এসব দেশে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকি আমাদের প্রতিটি দিনই নানা কৌতূহলে ভরা থাকে। তারপরও খুব কম অভিবাসীই তাদের কৌতূহলকে লিখে প্রকাশ করতে পারেন। আমাদের এই লেখক কোন সাধারণ কাজ করেননি তিনি এই লেখার মালমসলা যোগাতে গিয়ে অনুসন্ধিৎসু হয়ে নানা বই পড়েছেন, অনেক আকর্ষণীয় স্থানে গিয়েছেন এবং অনেক বিদগ্ধ জনের সাথে কথা বলেছেন। কার্যত তাঁর এই রচনাটি একটি গবেষণালব্ধ শ্রমের সাফল্য বহন করে। কানাডা একটি বিরাট দেশ যার পূর্বে আটলান্টিক মহাসাগর আর পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর। মাঝখানে অতি মনোরম ঢেউ খেলানো বিস্তীর্ণ ভূমি যার কোথাও সযত্নে লালিত বনভূমি, নীল জলের অনেকগুলি হ্রদ আর তুষার শুভ্র পর্বতমালা।
যে কোন গবেষণালব্ধ গ্রন্থে বানানো তথ্যের কোন স্থান নেই বলে এই বইটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠযোগ্য রচনা যা পাঠককে কানাডার অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত নির্ভরযোগ্য পরিচয় দিতে সক্ষম। বইটি থেকে জানা যায় তুষার যুগে আমাদের এখানে কি অবস্থা ছিল, কবে প্রথম মানুষ এখানে জীবিকা নির্বাহের জন্য আসতে আরম্ভ করে এবং তাদের জীবন তখন কেমন ছিল। এই উত্তর আমেরিকায় আদিবাসীরা যে ইউরোপ থেকে আসা মানুষদের হাতে নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত হয়েছেন এবং পরিশেষে কোণঠাসা হয়ে নিভৃতে আশ্রয় নিয়েছেন এর হৃদয়গ্রাহী ও প্রাঞ্জল উপস্থাপন লেখকের গভীর অনুভূতি ও অনুধাবনের সাক্ষ্য বহন করে। তিনি শুধু অক্ষরের মালাই গাথেননি এর মাঝে নিজের চিন্তা ও বিচারবুদ্ধিকে কাজে লাগিয়েছেন। লেখক অত্যন্ত নিপুণভাবে এবং উচ্চ মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কানাডায় আদিবাসিদের প্রতি বাইরে থেকে আসা মানুষদের অবিচার ও অন্যায়কে তুলে ধরেছেন। তিনি ধর্মের মর্মান্তিক যে ভ্রম যা মানুষকে অবদমিত রাখে সেই দিকে মনোযোগ রেখে এখানকার খৃষ্টধর্মের অনাচারকে তুলে ধরেছেন। আদিবাসীরা এই অন্যায়ের নির্মম শিকার ছিল যা আজও তাদের মন ও মানসিকতা থেকে লোপাট হয়নি। তিনি তাঁর লেখায় আবাসিক বিদ্যালয়ে নির্বিচারে শিশুদের ধর্ম্যান্তর এমন কি হত্যা পর্যন্ত যে হয়েছে তার ঐতিহাসিক বিবরণ তুলে ধরেছেন। লেখকের এই নির্মোহ সত্য বলার মানসিকতা তাঁর প্রখর পর্যবেক্ষণ শক্তির পরিচয় বহন করে।
এই বইটিতে আধুনিক কানাডার মানবিক জীবন পদ্ধতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বহুল ব্যবহার নিয়ে প্রচুর মূল্যবান তথ্য রয়েছে। লেখক প্রত্নতাত্ত্বিক, ভৌগলিক, প্রাগৈতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক দিকগুলিকে সুষ্ঠু ভাবে বিবেচনা করে ছবি সহ নানা উপকরণ দিয়ে বইটিকে সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি সাধারণ ও মননশীল পাঠকদের জন্য নানা অজানা ও অল্প জানা বিষয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করে কানাডার প্রকৃত পরিচয় সবার সামনে তুলে ধরার সৎ উদ্যোগ দেখিয়েছেন।
তিনি খুব আবেগের সাথে লিখেছেন যে কানাডাকে হৃদয় দিয়ে জানতে হলে এই মহান ও বিশাল ভূখণ্ডটির নৈসর্গিক সৌন্দর্যকে জানতে হবে। দীর্ঘ শীতকালের তুষার শুভ্র প্রকৃতির নীরব সন্ন্যাসীর নির্বিকার রূপ, বসন্তের সাত বিলিয়ন ফুলের অভূতপূর্ব লালিমা, হ্রদের তীরে তীরে বুনো হাসের পরিচারণ, আকাশে আকাশে সাদা মেঘের ভেলা আর পাতাঝরার ঋতুতে যাই যাই করে প্রাণ তবু যেতে পারিনে এই কান্না। ননীগোপাল দেবনাথ প্রাকৃতিক জীবনের এই অফুরন্ত ভাণ্ডারকে কানাডার মাটিতে প্রাণ দিয়ে নির্মোহ ভাবে অথচ বাস্তবে অনুভব করেছেন।
সবশেষে বলি বইটির সাজসজ্জা অতি সুন্দর, নিটোল ও নন্দিত মনে হয়েছে আমার কাছে। কোথাও কোথাও প্রকাশের স্বল্পতা ও অসমাপ্ত দেখা যায় যা লেখক পরবর্তী সংস্করণে খেয়াল রাখতে পারেন।
‘বৈচিত্রময় কানাডা : প্রাগৈতিহাসিক থেকে বর্তমান’, ননীগোপাল দেবনাথের লেখা গবেষণা মূলক গ্রন্থ, প্রকাশক মূর্ধন্য ঢাকা, বাংলাদেশ। প্রকাশ সময় অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২৩। গ্রন্থটি বাংলাদেশে মূর্ধন্য অথবা Online WWW. rokomari.com থেকে সংগ্রহ করা যাবে।কানাডায় সংগ্রহের জন্য Phone-647-880-6139 অথবা ই-মেইল [email protected]এ যোগাযোগ করুন।
লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৩ সালে ইতিহাসে এম. এ ডিগ্রী নেয়ার পর দেশে ও বিদেশে নানা সামাজিক পরিবেশে কাজ করেন।বর্তমানে টরন্টোর বাসিন্দা এবং একজন সচেতন মুক্তমনের লেখক বলে পরিচিত। বিজ্ঞান মনস্ক এই লেখক তিন খানা গ্রন্থের রচয়িতা। শহরে তাঁর অনুরক্ত বহু সজ্জন তাঁকে দার্শনিক হিসাবে গুরু মেনে চলে। তাঁর গ্রন্থ ও লেখায় নিজ আত্মচেতনার সুস্পষ্ট আলোকিত উপলব্ধি লক্ষ্য করা যায়। আত্মদর্শন ও মানবিক দৃষ্টভঙ্গি প্রাঞ্জল ভাষায় বিশ্লেষণের ফলে বিশেষভাবে তাঁর লেখা পাঠক প্রিয়।