মুক্তিযুদ্ধ

যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৪ | সুশীল কুমার পোদ্দার

যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৪

পূর্ব প্রকাশের পরধা রা বা হি ক 

যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৪ | সুশীল কুমার পোদ্দার

বাতাসে জলজ গন্ধ। কোথা থেকে দমকা বাতাস এসে আমাদের বারবার ভিজিয়ে দিয়ে যায়। পাট ক্ষেতের মধ্য দিয়ে পথ করে করে আমরা পৌঁছে যাই এক কর্দমাক্ত নদী তীরে। নদীতে উথালপাথাল ঢেউ। বিশাল আকৃতির তিনটে নৌকা ঢেউয়ের তালে উঠানামা করছে। নদীতীরে আরো অনেক পলায়নপর মানুষ। আমার মেসোর পরিবারের সাথে দেখা হয় । সাথে আমার এক শিকলবন্ধী পাগল দাদা। নৌকা থেকে দড়ি বাধা বিরাট এক কাঠ নামানো হয়েছে। সেই কাঠ বেয়ে বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে অনেক অচেনা মানুষ। এবার আমাদের পালা। আমার পাগল দাদাটা অজানা কারণে কেন যেন কেঁদে যাচ্ছেন। কিছুতেই সে নৌকায় উঠবে না। মানব মন বড় বিচিত্র। আমার ঐ পাগল দাদাটার পাগলামি কেন যেন সবাইকেই সংক্রামিত করে। আমরা সবাই মা-বাবাকে দেখে জন্মভূমির মাটিকে জানালেম শেষ প্রণাম।

নুয়ের জাহাজের মতো বিরাট এই নৌকা। ঠিক হলো সর্ব নিম্ন স্তরে থাকবে আমাদের মা-বোন। তার পরের স্তরে পুরুষের দল। আমাদের বিছানা হলো পাটের গাট্টির উপর। গলুইয়ের উপর অনেক মাঝি মাল্লা। পরে শুনেছি ওদের সাথে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। তখনো ভোরের আলো ফোটেনি। মাঝিরা দাড় টেনে উজান বেয়ে চলছে। আমাদের গন্তব্য আসামের ম্যানকার চর। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম থেকে জেগে উঠে মা দিদিকে কিছুতেই চিনতে পারিনা। গায়ে অকাল বৈধব্যের মতো মলিন শাড়ি, চুলগুলো অবিন্যস্ত, বিবর্ণ পাণ্ডুর মুখ। আমি সেদিন কিছুতেই বুঝতে পারিনি, মেনে নিতে পারিনি এই অদ্ভুত পরিবর্তনকে। মনে পড়ে যায় মার কাছে শুনা সেই পৌরনীক শ্রীবৎস রাজ ও চিন্তামণির কাহিনী।

মাঝে মাঝে নৌকা জন বিরলহীন চরে থামে। কেউ কেউ প্রাতঃকাজ ও স্নান সেরে নেই স্বল্প সময়ে। আমরা লাকড়ি সংগ্রহ করে মাকে দেই। মা সেই লাকড়ি দিয়ে মাটির চুলোয় ধুয়ো উড়িয়ে রান্না করেন। মা দিদিরা কখনো উপরে আসেন না। মাঝে মাঝে আমরা তিন ভাই উপরে আসি। বিশাল জলরাশি ভাটির টানে ছুটে চলেছে। ইতিমধ্যে আমাদের পেছনে পড়ে থাকা নৌকাটিতে ডাকাতি হোয়ে গেছে। সামনে বাহাদূরবাদ ঘাট। এই ঘাট পার হলেই নাকি আমরা নিরাপদ। এ বাহাদূরবাদ ঘাটে নাকি পাকসেনারা গান বোট নিয়ে টহল দেয়। এক সুমসাম নিস্তব্ধতা নেমে আসে। আমরা নিঃশ্বাস নিতেও ভয় পাই। সবাই চোখ বুজে প্রার্থনা করছে। আমরা কান পেতে থাকি কখন মাঝিরা বলবে আমরা জীবন মৃত্যুর বিভাজন রেখা পার হয়েছি। অবশেষে আসে সেই মহেন্দ্র ক্ষণ। সবার মনে স্বস্তি ফিরে আসে কিন্তু ডাকাতের ভয় পিছু ছাড়ে না।

এক প্রত্যুষ বেলায় আমাদের নৌকা একটা পাহাড়ের কাছে নঙ্গর করলো। আমরা সবাই হৈ হৈ করে নেমে পরেছি বালুবেলায়। স্বচ্ছ নদীর জল, অদূরে সবুজ পাহাড়। বড়রা চলে গেছে চাল ডাল কেনার জন্য। দাদা পাহাড় থেকে একটা বিরাট কাঁঠাল নিয়ে,এসেছেন। কৌতূহল বসে নিয়ে এসেছেন লম্বা কিছু অদ্ভুত ধরনের বাঁশ। আমরা সবাই অনেক দিন পর স্নান করি নদীর জলে। আমাদের গন্তব্য আর বেশী দূরে নয়…

চলবে…

যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৪ | সুশীল কুমার পোদ্দার ,  ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।

 

 

এসএস/সিএ



সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন