সোশ্যাল মিডিয়া

নিশাত-এর জন্য শোকগাথা

নিশাত-এর জন্য শোকগাথা

আমি আর নিশাত এক ক্লাসেই পড়তাম। আমি তখন ছোটো ও তখন বড়। ও ছোটো বেলা থেকেই বড়। তার চিন্তা, মেধা, মনন এমন কি বন্ধু সার্কেল ও বড়। যেহেতু আমার জন্ম বেইলী রোডে সে কারণেই সিদ্ধেশ্বরী আর বেইলী রোডই ছিলো আমার সারা সময়ের বিচরণ ক্ষেত্র। দিনের বেলাতে বেইলী রোড মোটামুটি ফাঁকাই থাকতো। ছুটির সময় ভিকারুন্নেসার ছাত্রীদের খানিকটা আনা গোনা এই যা। সেই সময় দেখতাম মার্সিডিজ চড়ে ড্যাম স্মার্ট একটি মেয়ে সাবজিরোতে আসতো। আপাদমস্তক ওয়েস্টার্ণ পোশাক কিন্তু দীর্ঘকায় কেশ বিন্যাসে একজন বাঙালি কিশোরী। তার আগমণে প্রাণবন্ত হয়ে উঠতো পুরো বেইলী রোড। কোনো ভাবেই তার সাথে নিজেকে মেলাতে পারতাম না। আর্ট কালচারের যে সব গুণীজনদের আমরা মামা চাচা বলে সম্বোধন করতাম উনারা সবাই নিশাতের বন্ধু। আমার সাথে দেখা হলে ‘কিরে কেমন আছিস’ বলতো, আমি তখন ভুলেই যেতাম সে আমার সহপাঠী, খুব নরম গলায় বলতাম ‘জি ভালো আছি আপনি ভালো? এই আপনি তুমির সম্পর্কটা ওর চলে যাবার কিছু ক্ষণ আগে পর্যন্তও ছিলো কাল অব্দি। আমার ভালো লাগতো ওকে আপনি বলতে কেননা ওর যাপিত জীবন আমি দেখেছি খুব কাছে থেকে। তাঁর হার না মানা মনোবলকে আমি শ্রদ্ধা করি। সেতো আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ঈশ্বরদা। কোথাও কারো ব্যক্তিগত সমস্যা চলছে নিশাত আছে পাশে, কারো থাকার জায়গা নেই নিশাত আছে পাশে কারো শরীর খারাপ নিশাত আছে পাশে, কেউ চরিত্রটা বুঝতে পারছে না কিভাবে করবে, নিশাত আছে পাশে। কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে নিশাত আছে। নিশাত সব জায়গায় থাকে। আমার বিয়ের সব আয়োজন একা করেছে। কোথা থেকে নাটকের সেট নিয়ে এসে দেখি হলুদের মঞ্চ বানিয়ে ফেললো। আমাকে খুশী করার জন্য হলুদ রঙের শাড়ি পরলো। আশির দশকে এসে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে আমরা খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলাম। ধীরে ধীরে নাটকের পাশাপাশি আবৃত্তির দিকেও ঝুঁকে গেলো। ও আর আমি মিলে বেশ কিছু কবিতার কাজ করলাম। এক সময় দেখি বৈকুণ্ঠে র মা হয়ে গেলো সে। দীর্ঘ দিন আমার ছেলে মেয়েদের নিয়ে সে বেশ কিছু সফল প্রযোজনা মঞ্চস্থ করে ফেললো। আমি আর ও দীর্ঘ এক বছর রিহার্সাল করে বের করলাম ‘পরানের গহীন ভিতর’। আমাদের পাঞ্চাশ উর্ধ্ব প্রযোজনার লাইট ডিজাইন করেছে সে । এ ব্যাপারে তাকে কখনো বলতে হয়নি। দুপুরে মিলনায়তনে গিয়ে দেখি সে নিজে থেকেই লাইট ডিজাইন করছে। নিশাতকে যারা কাছে থেকে চেনেন তাদের সংখ্যা এ পাড়ায় অনেক। এই অগনিত প্রতিটি মানুষের জীবনে নিশাতকে নিয়ে আমার মতো অনেক স্মৃতি আছে। একজন মানুষের পক্ষে এতো মানুষের অন্তরের মানুষ হওয়া সম্ভব নয়। নিশাত তা করে দেখিয়ে গেছে। সে কারণেই বলি নিশাত মানুষ নয় ঈশ্বর। আমরা যাদের গুণীজন বলে নানাভাবে আখ্যায়িত করি নিশাত হয়তো সে কোটায় পরে না। কিন্তু আজ আমরা যাকে হারালাম আমি নিশ্চিত অন্তত নাট্যকর্মীরা স্বীকার করবেন একজন নিশাতের শূন্যতায় আমরা কতোটা অসহায় হয়ে গেলাম।
নিশাত ছিলো আমাদের অহল্যা, আমাদের ইলা মিত্র, আমাদের তেরেসা।নিশাত আপনার তুই ভালো নেই, আপনি ছাড়া এই তুই বন্ধু ভালো থাকবে কি করে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

fifteen − ten =