লেখালেখি

ক্রান্তিকালের নেত্রী শেখ হাসিনা


ক্রান্তিকালের নেত্রী শেখ হাসিনা

আবদুল মান্নান

২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যা ৭৪ বছরে পা রাখবেন। তাঁকে জন্মদিনের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। তখন আমি বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান। আমার আগে কোনো একসময় কমিশন ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক’ দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সেরা শিক্ষার্থীদের সম্মানিত করার জন্য চালু করেছিল। কখন তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তা-ও জানা যায়নি। কিন্তু ঠিক করলাম তা আবার চালু করার। প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে কৃতী শিক্ষার্থীরা পদক নেবেন। প্রধানমন্ত্রীকে বলায় তিনি রাজি হয়ে গেলেন। তিনি অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন আর শিক্ষার্থীদের গলায় পদক পরিয়ে দেবেন। এটা ২০১৬ সালের কথা। মোট ১৬০ জনের মতো শিক্ষার্থীকে বাছাই করা হলো। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জানানো হলো মাত্র ১০ জনকে প্রধানমন্ত্রী পদক দেবেন। তা শুনে সবাই বেশ হতাশ। অনুষ্ঠানের আগের দিন দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গণভবনে দেখা করলাম। গণভবনে তাঁর অফিসকক্ষে সেদিন তাঁর সঙ্গে অনেক বিষয়ে কথা হলো। এক ফাঁকে তাঁকে সব স্বর্ণপদকপ্রাপ্তকে নিজ হাতে পদক পরিয়ে দিতে অনুরোধ করলে তিনি আমাকে বললেন, ‘বুড়া হয়ে গেছি তো…’। আমি অনেকটা তাঁর কথা শেষ করতে না দিয়ে বলি, ‘আপনি মোটেও বুড়া হননি। আল্লাহর রহমতে আপনি অনেক তরুণের চেয়ে ভালো আছেন, যাঁরা আপনার সঙ্গে কাজ করেন তাঁরা তা ঠিকই জানেন।’ তিনি রাজি হয়ে গেলেন এবং পরদিন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের শাপলা হলের এই পদক প্রদান অনুষ্ঠানে আগের দিন তাঁর সঙ্গে আমার কী কথা হয়েছে তা বলাতে তাঁর পাশে বসা আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুকন্যার সঙ্গে একাধিক সময়ে কাজ করার সুবাদে এটা বলতে পারি, তাঁর কাছে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে কোনো অনুরোধ নিয়ে গেলে তিনি কখনো না করেননি। আজকে সে মানুষটির জন্মদিন। তাঁর কাছে তো আমার কৃতজ্ঞ হওয়ার অনেক কারণ আছে। বলতে পারি, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি চুয়াত্তরে পা দিলেন কিন্তু আপনি বৃদ্ধ হননি। এখনো আপনাকে অনেক দূর যেতে হবে।’

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর দীর্ঘ ছয় বছর শেখ হাসিনা প্রবাসে কাটিয়েছেন। ১৯৮১ সালের মে মাসে এক অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে রিক্ত হাতে তিনি দেশে ফিরেছেন। ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার কাছে জার্মানিতে যাওয়ার আগে তাঁর সব ছিল। দেশে ফিরলেন যেদিন তখন তাঁর পরিবারের কোনো সদস্য জীবিত নেই। ক্ষমতায় বাংলাদেশের প্রথম সেনাশাসক জেনারেল জিয়া, যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন বলে এখন যা প্রমাণিত এবং এই হত্যাকাণ্ডের একজন বেনিফিশিয়ারি। দেশে যখন ফেরেন তখন বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অবস্থা অনেকটা ছত্রভঙ্গ, যদিও শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের স্ত্রী বেগম জোহরা তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে কিছু তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মী দলটিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলেন।

শেখ হাসিনা ছোটবেলায় স্কুল শিক্ষকের পেশা বেছে নিতে চেয়েছিলেন; কিন্তু নিয়তি তাঁকে শুধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বানায়নি, তিনি এই মুহূর্তে একজন বিশ্বনন্দিত রাষ্ট্রনায়ক। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটি তাঁর তৃতীয় লাগাতার মেয়াদ, সব মিলিয়ে চতুর্থবার। প্রথমবার তিনি সরকার গঠন করেছিলেন ১৯৯৬ সালে, যখন তাঁর বয়স ছিল ৪৯ বছর। তাঁর পিতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি শপথ নেন, তখন তাঁর বয়স ছিল ৫২ বছর। বয়সের বিচারে শেখ হাসিনা তাঁর পিতাকেও ছাড়িয়ে গেছেন। বাংলাদেশের জনগণ মনে করে এই মুহূর্তে শেখ হাসিনাই বাংলাদেশকে পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশে রূপান্তর করতে পারবেন।

পিতা শেখ মুজিবকে যখন সপরিবারে ঘাতকরা হত্যা করে তখন শেখ হাসিনা একজন গৃহবধূ বৈ অন্য কিছু নন। সে সময় তিনি বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার স্ত্রী, যাঁর প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে তাঁর দুই সন্তানকে মানুষ করা আর ঘরসংসার সামলানো। আর সেই শেখ হাসিনার দূরদর্শিতার কারণে বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বদরবারে উন্নয়নের একটি সফল রোল মডেল, যা জাতিসংঘ থেকে বিশ্বব্যাংক সবাই স্বীকার করে। একজন আদর্শ নেতা হওয়ার জন্য কিছু গুণাবলি আবশ্যক, যার মধ্যে সাহস, সততা, দূরদৃষ্টি আর সহনশীলতা অন্যতম। যাঁরা রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেন তাঁদের জন্য এসব গুণ থাকাটা জরুরি। যুক্তরাষ্ট্রের থমাস জেফারসেন, আব্রাহাম লিংকন, ড. মার্টিন লুথার কিং, ব্রিটেনের মার্গারেট থ্যাচার, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, চিলির আলেন্দে, ভিয়েতনামের হো চি মিন, মিসরের জামাল আবদুন নাসের, ভারতের নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধী, সোভিয়েত ইউনিয়নের ভ্লাদিমির লেনিন, আর বাংলাদেশের শেখ মুজিবুর রহমান এসব গুণাবলির কারণেই নেতা হতে পেরেছিলেন। পরবর্তীকালে এঁরা অনেকেই নেতা থেকে পরিণত হয়েছিলেন রাষ্ট্রনায়কে। সমাজ বা রাষ্ট্র পরিচালনায় এঁরা সবাই মানুষের আস্থা অর্জন করেছিলেন, বদলে দিতে পেরেছিলেন মানুষের চিন্তাধারা আর সমাজকে। বিশ্ব স্বীকৃত এই নেতারা কেউ নেতা হয়ে জন্মগ্রহণ করেননি। পরিস্থিতি তাঁদের নেতা বানিয়েছে। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচন ছিল দলকে কার্যকরভাবে টিকিয়ে রাখার একটি চেষ্টা। তখন শেখ হাসিনা দিল্লিতে প্রবাস জীবন যাপন করছেন। সেখানে নিরাপত্তার খাতিরে তিনি মিসেস তালুকদার এবং একজন গৃহবধূ। শেখ হাসিনা এক মারাত্মক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরেছিলেন। ফিলিপাইনের স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট ফ্রেডিনান্ড মার্কোসের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনের মাঝে ফিলিপাইনের নির্বাসিত রাজনৈতিক নেতা বেনিগনো আকিনো জুনিয়র ১৯৮৩ সালের ২১ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরেছিলেন। মার্কোসের সেনাবাহিনী আকিনোকে ম্যানিলা বিমানবন্দরে বিমানের সিঁড়িতে গুলি করে হত্যা করেছিল। শেখ হাসিনার দেশে ফেরাটাও তেমন একটা নিরাপদ ছিল না। তার পরও তিনি দেশে ফিরেছিলেন স্রেফ মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা আর তাঁর পিতার প্রতি বাংলাদেশের জনগণের ভালোবাসার পুঁজিকে কেন্দ্র করে। দেশে ফেরার পর শেখ হাসিনা দেশের ও দলের রাজনীতিতে যে অসামান্য অবদান রেখেছেন তা একমাত্র সম্ভব হয়েছে দেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসা, সাহস আর দূরদৃষ্টির কারণে। যে এরশাদবিরোধী আন্দোলন শুরু করেছিলেন এই দেশের ছাত্রসমাজ তাতে পরবর্তীকালে যোগ দিয়েছিল খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সাতদলীয় ঐক্যজোট। কিন্তু শত চেষ্টা করেও সেই আন্দোলনে হাওয়া লাগছিল না যতক্ষণ পর্যন্ত শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫ দলীয় ঐক্যজোট এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনের বেলায়ও একই চিত্র দেখেছি। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে এই আন্দোলন শুরু হলেও তা বেগবান হয়েছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার পর।

শেখ হাসিনার সাহস দেশের মানুষ নানা সময়ে দেখেছে, যার অন্যতম ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে একাত্তরের ঘাতকদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাদের বিচার শুরু করা আর নানা ধরনের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কারণে যখন পদ্মা সেতু প্রকল্প ভেস্তে যাচ্ছিল তখন। একাত্তরের ঘাতকদের বিচার বন্ধ করার জন্য অনেক আন্তর্জাতিক চাপ ছিল। শেখ হাসিনার সাহসের কারণে এই বিচার হয়েছে। পদ্মা সেতু ষড়যন্ত্রে তাঁকে যখন সবাই বিপর্যস্ত করতে চেয়েছে তখন তিনি সাহস করে বলেছিলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের বা অন্য কারো সহায়তা চাই না। আমাদের অর্থেই এই সেতু নির্মিত হবে।’ সেই সেতু নির্মাণ এখন শেষের পথে। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে নির্বাচনকে বানচাল করার জন্য খালেদা জিয়া দেশের মানুষের বিরুদ্ধে যে অগ্নিসন্ত্রাস শুরু করেছিলেন, তখন আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র নেতাই এই নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। একমাত্র শেখ হাসিনাই বলতে পেরেছিলেন সংবিধান সমুন্নত রাখতে এই নির্বাচন যথাসময়ে হবে। তাইতো তিনি ক্রান্তিকালের নেত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগের সবাইকে কেনা গেলেও একমাত্র শেখ হাসিনাকে কেনা যায় না। এমন একটা বাক্য উচ্চারণ করতে সৎসাহস লাগে, যেটা শেখ হাসিনার আছে।

সব নেতার যেমন শক্তির অনেক উৎস থাকে, ঠিক তেমন দুর্বলতাও থাকে। বঙ্গবন্ধুরও ছিল। তিনি তাঁর দেশের মানুষকে বেশি ভালোবাসতেন, যা ছিল তাঁর ভাষায় নিজের দুর্বলতা। এটি তাঁর নিজের কথা। শেখ হাসিনার শক্তির উৎস তাঁর প্রতি মানুষের, বিশেষ করে তৃণমূল কর্মীদের ভালোবাসা। ভিয়েনাপ্রবাসী সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি এম নজরুল ইসলাম ২০১০ সালে শেখ হাসিনাকে নিয়ে ‘উদার অভ্যুদয়ের নেত্রী’ নামে অসাধারণ একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেছিলেন। তাতে অনেকের লেখা আছে। সেখানে প্রকাশিত আমার লেখায় আমি শেখ হাসিনার দুর্বলতা সম্পর্কে যে মন্তব্যটি করেছিলাম তা পুনরুক্তি করে লেখাটি শেষ করতে চাই। ২০১০ সালে লিখেছিলাম, ‘তিনি সব মানুষকে সহজেই বিশ্বাস করেন এবং এই বিশ্বাস কখনো কখনো ভুলভাবে করেন। ফলত অনেকে তাঁকে ভুল পথে পরিচালিত করতে চেষ্টা করেন।’ এটি শেখ হাসিনার বড় দুর্বলতা। এর সুযোগ নিয়ে বর্তমান সময়ে তাঁর অনেক আস্থাভাজন মানুষ নিরলসভাবে তাঁর ক্ষতি করে যাচ্ছেন, যা অনেক সময় তিনি হয়তো বুঝতে পারেন না। নিজের ‘ভুলে’র জন্য বঙ্গবন্ধু অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন, বাংলাদেশ হয়েছিল অভিভাবকহারা। বঙ্গবন্ধুকে শতায়ু হতে দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। তাঁর কন্যা শতায়ু হোন, এই প্রত্যাশা করি। শুভ জন্মদিন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

 

 

⇒এসএস/সিএ

সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন