লেখালেখি

গণস্বাস্থ্য কিট, কিছু কথা |||| ডঃ  শোয়েব সাঈদ

 


গণস্বাস্থ্য কিট, কিছু কথা |||| ডঃ  শোয়েব সাঈদ

আমাদের দেশে পক্ষে বিপক্ষে প্রচারণা এতটাই বিষাক্ত যে সত্যটা পালিয়ে যায় আর এই অবস্থায় বিজ্ঞানের সত্যটাকে সামনে আনতে যাওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, অনেকটা স্রোতের বিপরীতে কথা বলে অপদস্ত হওয়া। তারপরেও দেশপ্রেম আর বিজ্ঞান  চর্চার বিশুদ্ধতার টানে কারো কারো  ঝুঁকি নিয়ে মূল পয়েন্টে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে এগিয়ে আসতে হয়।

পত্রিকায় এসেছে গণস্বাস্থ্য উদ্ভাবিত জি আর কোভিড ১৯ ডট ব্লট অ্যান্টিবডি টেস্ট কিট করোনা শনাক্তে কার্যকর নয় বলে জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে করোনার উপসর্গ নিয়ে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে গণস্বাস্থ্যের কিটে মাত্র ১১ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত শনাক্ত করা গেছে। বৈশ্বিক সফলতার মানদণ্ডে এটি ৯৫% এর বেশী হতে হবে।

আজকে আমাদের সময়ে দেখলাম গণস্বাস্থ্যের কিট প্রকল্প কোঅর্ডিনেটর ডা. মুহিব উল্লাহ খন্দকার বলছেন, গণস্বাস্থ্যের অ্যান্টিবডি কিটের কাজ করোনা শনাক্ত করা নয়। এটা হচ্ছে অ্যান্টিবডি কিট। তিনি বলেন, অ্যান্টিবডি সাধারণত উপসর্গ দেখা দেওয়ার ৬/৭ দিন পর থেকে দেখা দিতে শুরু করে। প্রথমত উপসর্গযুক্ত কোনো ব্যক্তির যদি অ্যান্টিবডি টেস্টের ফল পজিটিভ আসে, তাহলে তার অর্থ হবে অতি সম্প্রতি তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং তার শরীরে করোনা প্রতিরোধী ক্ষমতা তৈরি শুরু হয়েছে। ডা. মুহিবের মন্তব্য এন্টিবডি কিট সংক্রান্ত বিজ্ঞানের সত্যিকারের প্রতিফলন।  এই বিষয়টি আমরা বার বার বলার চেষ্টা করেছি, কিন্তু হালে পানি পাইনি।

বিশ্বব্যাপী বাস্তবতা হচ্ছে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে নিউক্লিক এসিড নির্ভর টেস্ট (আরটিপিসিআর) অন্যদিকে গবেষণা আর পরিস্থিতি মূল্যায়নে সেরোলজিক্যাল বা এন্টিবডি টেস্ট। আমার অনেক লেখায় আর টকশোতে এন্টিবডি কিটের বিজ্ঞানটা সামনে এনে এই বিষয়ে পরিস্কারভাবে ব্যাখা করেছি। “গণস্বাস্থ্য কিট বিজ্ঞানটাকে বাঁচতে দিন”  শীর্ষক লেখাতে বিজ্ঞানটাকে সামনে  আনার চেষ্টা করেছি। এন্টিবডি কিটের বিজ্ঞান, সফলতা, ঝুঁকি, বৈশ্বিক অবস্থার বিস্তারিত নিয়ে কলাম লিখেছি। অনেক বিজ্ঞানীও এ নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছেন কিন্তু জনমতের বিপরীতে বিজ্ঞানের কণ্ঠস্বর ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে গিয়েছে।

মিডিয়ার লক্ষ্যভেদী প্রচারণা আর জনমতের কাছে বিজ্ঞান কখনো সমর্পিত হয়না। বিব্রত হয়ে সঙ্কোচবোধ করে বটে, তবে দিনশেষে বৈজ্ঞানিক সত্যটাই আসল সত্য। কিট উদ্ভাবন আলোচনার প্রথম দিকে একে আরটিপিসিআর এর বিপরীতে দাড় করিয়ে শত ডলার খরচের বিপরীতে তিন ডলারের প্রচারণা ন্যায় সঙ্গত ছিলনা। আজকে গণস্বাস্থ্য বলছে অ্যান্টিবডি কিটের কাজ করোনা শনাক্ত করা নয়, অথচ জনগণ ব্যাপকভাবে ধারণা পেয়েছে এটি করোনা শনাক্ত করার কিট। জনগণ বিভ্রান্ত হয়েছে, একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল এই কিট চালু হলে করোনা পরিস্থিতি পাল্টে যাবে, অথচ এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিলনা বিশেষ করে একটিভ ইনফেকশনের পর্যায়ে।

এন্টিবডি টেস্ট কিটের বৈশ্বিক মূল্য ৩-১০ ডলারের মধ্যেই। এন্টিবডি টেস্টেকে আরটিপিসিআর এর প্রতিযোগী করে লাখ লাখ মানুষের টেস্ট করার প্রচারণায় জনমত পক্ষে গেছে বটে, বিজ্ঞানটা পরাজিত হয়েছে। যারা বিষয়টি পরিষ্কার না করে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুলের উপর দাড়িয়ে থাকা জনমতের সুবিধে নিয়েছেন বিজ্ঞান চর্চার নামে, জ্ঞানপাপের অভিযোগ তো তোলাই যায়। ডঃ জাফ্রুল্লাহ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অহঙ্কার, স্বাধীন বাংলাদেশেও উনার অনেক অবদান, উনার  শত্রুরাও উনার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন করেন না। পত্রিকায় যখন উনার দেশপ্রেমের পাশাপাশি এন্টিবডি কিট নিয়ে কথা বলা হয় আবেগঘন ভাষায়, মনে হয় বিজ্ঞানটাকে ইচ্ছাকৃত ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে। ভাবছি, এটা কি আমাদের বিজ্ঞান সাংবাদিকতার দীনতা, না অন্য উদ্দেশ্য?

আমেরিকায় লাখো মানুষ কোভিডে মারা গেছে। এন্টিবডি কিটের অসংখ্য কোম্পানি থাকার পরেও রোগ নির্ণয় হয়েছে আরটিপিসিআর দিয়েই, এটাই বৈশ্বিক গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড এখন পর্যন্ত। এই বৈশ্বিক সত্যের পেছনে একটি বিজ্ঞান ছিল; যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান আর ইউরোপের কর্তৃপক্ষ নিশ্চয় ষ্টুপিড নয়। বাংলাদেশে দেখা গেল জনমত সেই বিজ্ঞানকে বুঝতে চায়নি বা বুঝতে দেওয়া হয়নি। আরটিপিসিআর আর এন্টিবডি নিয়ে আলোচনা বিশ্বের কোথাও ছিলনা, এটি বাংলাদেশে ছিল হট টপিক।

আমরা আবেগতাড়িত হয়ে পাওনিয়ার সেজে বিশ্বকে বিজ্ঞান বিষয়ে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করলাম।  ট্রায়াল সফলতা, কাঁচামালের মান, বানিজ্যিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ঝুঁকিগুলো তুরি মেরে উড়িয়ে দিলাম। গবেষণাগারের সফলতা আর ফিল্ডে সম্প্রসারণের যে গ্যাপ তাও বুঝতে চাইলাম না। পিয়ার রিভিউ, বৈজ্ঞানিক তথ্য আদান প্রদানে বৈশ্বিক মানদণ্ডে চলতে চাইলাম না। টার্গেট নির্ধারণে অস্থির ছিলাম। এন্টিজেন, এন্টিবডি, রক্ত, স্যালাইভা ইত্যাদিন নানাদিকে ঘুরে কোথায় ল্যান্ড করব বিভ্রান্ত হলাম। রক্তে ভাইরাল লোড খুব কম, এটি জানার পরেও রক্ত থেকে এন্টিজেন টেস্টের কথাও বললাম।

সার্স ভাইরাসের এন্টিবডির মেয়াদ তিন বছর। পত্রিকায় কথা বলার সময় মনে থাকছেনা, ২০০৩ সালে তৈরি হওয়া এই এন্টিবডি ২০২০ সালে একটিভ থাকতে পারেনা। বিজ্ঞানে অতিকথন ভুল সংকেত দেয়, আস্থাহীনতা তৈরি করে। বিজ্ঞানটাকে হেকিমী পর্যায়ে নামিয়ে আনলে বাহবা পাওয়া যায় বটে কিন্তু বিজ্ঞানটা হারিয়ে যায়।

এন্টিবডি টেস্ট কিট বিশ্বের অনেক দেশেই তৈরি করছে, আমাদের একটি অবশ্যই গর্বের। কিন্তু আমরা কি বৈজ্ঞানিক তথ্য উপাত্তের পথে হাঁটতে পেরেছি? বৈজ্ঞানিক পিন পয়েন্টে কথা বলতে পেরেছি? অবিবেচক প্রচারণায় জড়িয়ে কিছু মিডিয়াকে কাছে টেনে বিজ্ঞানটাকে কি অবহেলা করিনি? বিজ্ঞানটাকে পক্ষ বিপক্ষের জনমতের বলি না করে বিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের পথে চলতে দিতে হলে এই প্রশ্নগুলো তো এড্রেস করতে হবে। বৈজ্ঞানিক গবেষণার পেশাদারিত্ব দারুণভাবে ব্যাহত হয় যদি প্রতিদিনই টিভি বা সংবাদপত্রে নিউজ হতে থাকে গবেষণার খণ্ডিত ফলাফল নিয়ে। একটা জাতির চরম দুর্ভাগ্য বিজ্ঞানটাকে বিজ্ঞানের জায়গায় না রাখতে পারা।

গণস্বাস্থ্য কিট, কিছু কথা |||| ডঃ  শোয়েব সাঈদ ।    লেখক ঃ কলামিস্ট  এবং মাইক্রোবিয়াল বায়োটেক  বিষয়ে  মন্ট্রিয়লে বহুজাতিক কর্পোরেটে  ডিরেক্টর পদে কর্মরত  এবং সিবিএনএ-এর উপদেষ্টা।    

 

সি/এসএস


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে cbna24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন