ফিচার্ড বিশ্ব

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে স্বেচ্ছায় পদ ছাড়ার সংস্কৃতি নেই কেন?

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে স্বেচ্ছায় পদ ছাড়ার সংস্কৃতি নেই কেন?

নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেবার ঘোষণা দিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনায় এসেছেন।এর কয়েকমাস আগে তীব্র সমালোচনার মুখে প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস।

উন্নত ও গনতান্ত্রিক বিশ্বে সরকারের শীর্ষ পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘটনা অহরহ দেখা যায়। অনেক সময় তারা সমালোচনার মুখে পদ ছেড়ে দেন, আবার কখনো-কখনো জনপ্রিয়তা থাকলেও নিজের পদ থেকে সরে দাঁড়ান।

কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় – বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানে এ ধরণের চর্চা নেই বললেই চলে। বরং রাজনীতির মারপ্যাঁচে কিভাবে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করা যায় সে চেষ্টা করা হয় এসব দেশে। স্বেচ্ছায় নিজের পদ থেকে সরে যাবার ঘটনা খুবই বিরল।

উন্নত দেশগুলোতে যেটি খুবই সাধারণ ঘটনা সেটি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দেখা যায়না কেন?

অনেকে মনে করেন, এর একটি বড় কারণ হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ক্ষমতায় থাকা আর না থাকার মধ্যে ‘বিরাট পার্থক্য’ তৈরি করে।

ক্ষমতা ছাড়লে অসন্তোষের মুখে পড়ার আশংকা থাকে অনেকের।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন ক্ষমতা বা পদ থেকে সরে দাঁড়িয়ে অন্যকে সুযোগ দেয়া বা নিজের ব্যর্থতা গ্রহণ করার মতো ‘উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও রুচি’ তৃতীয় বিশ্বের অনেক রাজনীতিকদের মধ্যে নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলছেন দায়িত্ব পালন শেষে সরে দাঁড়ানো উচিত-এই ধারণাটি সমাজেই বিকশিত হয়নি এবং এ কারণে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান তৈরিই হয়নি।

রাজনীতিকরা অনেক সময় ক্ষমতায় থাকাকালীন প্রতিপক্ষকে যেমন দমনের চেষ্টা করেন, তেমনি নিজে ক্ষমতা ছাড়লে একই পরিস্থিতিতে পড়বেন-এই আশংকায় যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করেন।

“ক্ষমতা ছাড়লে প্রতিশোধের শিকার হওয়ার আশংকায় অনেকে ক্ষমতা ছাড়তেই চান না। তবে এটি শুধু রাজনীতির ক্ষেত্রেই নয়, বরং সব ক্ষেত্রেই পদ পদবী আঁকড়ে রাখার প্রবণতা আছে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মিস্টার মজুমদার।

তার মতে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে সম্পর্ক তাতে করে কেউই কারও প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা প্রদর্শনে রাজি থাকে না বরং কে কাকে কিভাবে দুর্বল করে নিজেকে শক্তিশালী করবেন সেটিই মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

একই ধরণের অভিমত দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক রোবায়েত ফেরদৌস। তার মতে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়িয়ে অন্যকে সুযোগ দেয়া বা নিজের ব্যর্থতাকে গ্রহণ করার মতো ‘উঁচু গণতান্ত্রিক রুচি বা মানসিকতা’ কোনোটাই এখানে গড়ে ওঠেনি।

“তারা ক্ষমতায় থাকার সময় প্রতিপক্ষকে শত্রু জ্ঞান করে নিধনের চেষ্টা করেন বলেই ক্ষমতা ছাড়তে ভয় পান। সে কারণেই নতুন কারও কাছে দলের নেতৃত্বও ছাড়তে চান না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

অর্থাৎ বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে রাজনীতিকদের জন্য বড় ভয়ের জায়গা হলো ক্ষমতা ছাড়ার পর তার পরিস্থিতি কেমন হতে পারে সেটি। ক্ষমতা ছাড়লে জন অসন্তোষের শিকার হওয়ার ভয় থেকে এসব দেশের রাজনীতিকরা নিজ পরিবারের সদস্যরা ছাড়া অন্য কারও কাছে ক্ষমতা বা নেতৃত্ব ছাড়তে আগ্রহী হন না। এমনকি নিজ দলের মধ্যেও তারা অন্ধ অনুসারী ছাড়া কাউকে নেতৃত্বের কাছাকাছি আনতে চান না। বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টাও হয় অনেক দেশে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, উন্নত বিশ্বে সরকার পরিচালনায় জবাবদিহীতা থাকে। ক্ষমতা ছেড়েও তারা সামাজিক বা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারেন।

ক্ষমতা ছেড়ে যাবার পর কোন প্রতিহিংসার শিকার হবার ভয় থাকে না।

অনেকে নানা প্রতিষ্ঠানে বক্তব্য দেন বা বই লিখেন। তাদের সামাজিক মর্যাদা ও সম্মানের কোনো হানি হয় না।

ফলে ক্ষমতা বা দলের নেতৃত্ব ছাড়া নিয়ে তাদের মধ্যে কখনো ভীতি কাজ করে না।

ব্রিটেনের লৌহমানবী খ্যাত প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পর জন অসন্তোষের মুখে তার পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে ডেভিড ক্যামেরন, টেরেজা মে, বরিস জনসন, লিজ ট্রাস তাদের নীতির প্রশ্নে ক্ষমতার পাশাপাশি দলীয় নেতৃত্ব থেকেও সরে গেছেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের সরে দাঁড়ানোর বিপক্ষে ছিলেন ডেভিড ক্যামেরন। কিন্তু এ বিষয়ে গণভোটে ব্রেক্সিট পন্থীরা জিতে গেলে ক্ষমতা ও দলের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ান তিনি।

তারও আগে টনি ব্লেয়ার দশ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ক্ষমতা ও দলের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ান এবং রাজনীতি থেকেই অবসর নেন।

আবার বিরোধী নেতাদের ক্ষেত্রেও বিদায় নেয়ার উদাহরণ আছে নানা জায়গায়। ব্রিটেনেরই লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন বিদায় নিয়েছেন নতুন নেতৃত্বকে সুযোগ দেয়ার জন্য।

আবার গত বছর মে মাসে অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচনে হেরে বিরোধী নেতাকে অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি লিবারেল পার্টির নেতার পদ থেকেও সরে দাঁড়িয়েছিলেন স্কট মরিসন।

এশিয়াতেই জাপানসহ অনেক দেশে অহরহই রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতা ও দলের নেতৃত্ব ছাড়ছেন।

তবে বাংলাদেশসহ অনেক দেশই আছে এশিয়া ও আফ্রিকায় যেখানে নির্বাচন নিয়েও যেমন প্রশ্ন থাকে তেমনি ক্ষমতা ও রাজনীতি থেকে নেতাদের হাসিমুখে খুব একটা বিদায় নিতে দেখা যায় না।

সূত্র : বিবিসি বাংলা



সংবাদটি শেয়ার করুন