প্রবাসের সংবাদ

নিউইয়র্ক ‘কফিন রাখার জায়গাও কমে আসছে’-ড. রাজুব ভৌমিক

নিউইয়র্ক 'কফিন রাখার জায়গাও কমে আসছে
ড. রাজুব ভৌমিক

নিউইয়র্ক ‘কফিন রাখার জায়গাও কমে আসছে’-ড. রাজুব ভৌমিক । ‘নিউইয়র্ক সিটির হাসপাতালগুলোর সামনে এখন অনেক ট্রাক পার্ক করা থাকছে। সবগুলো লাশ বোঝাই। শত শত লাশ। এখানে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা এমনভাবে বাড়ছে যে, কবর দেওয়া বা কফিন রাখার মতো জায়গা ক্রমেই কমে আসছে। শহরের আশপাশের কবরস্থানগুলোতেও জায়গা নেই। করোনায় মৃতদের এখন পার্কে কবর দেওয়ার চিন্তা করছে সরকার। আর মৃত্যুর ছয় দিনের মধ্যে স্বজনরা লাশ দাবি না করলে হার্ট আইল্যান্ডে গণকবর দেওয়া হচ্ছে।’ করোনাভাইরাস সংক্রমণের শীর্ষে থাকা দেশ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের কাউন্টার টেররিজম অফিসার ড. রাজুব ভৌমিক এভাবেই জানালেন সেখানকার পরিস্থিতি।

আট বছর ধরে নিউইয়র্ক পুলিশে কাজ করছেন বাংলাদেশি রাজুব ভৌমিক। সাড়ে তিন বছর আগে আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে হাডসন নদীতে ঝাঁপ দেওয়া এক ব্যক্তিকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধারের ঘটনায় তিনি গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রশংসিত হন। পুলিশে কাজ করার পাশাপাশি তিনটি বিষয়ে পিএইচডি করা রাজুব সেখানকার দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পড়ান। এখন তিনি আমেরিকান কলেজ অব এডুকেশন থেকে ‘শিক্ষা ও নেতৃত্ব’ বিষয়ে চতুর্থ পিএইচডি করছেন। তার প্রথম ব্যাচেলর ডিগ্রি ছিল ‘ক্রিমিনাল ইন্টেলিজেন্স’ নিয়ে।

সমকালের সঙ্গে কথোপকথনে রাজুব জানান, নিউইয়র্ক সিটিতে কেউ স্বাভাবিকভাবে মারা গেলেও পুলিশ তার  বাড়িতে গিয়ে প্রাথমিক তদন্ত করে। ৯৫ ভাগ ঘটনায় মৃতদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য সরকারি হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। তবে এখন এত মানুষ মারা যাচ্ছে যে গুরুত্বপূর্ণ মনে না হলে ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফনের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। কারণ মর্গে লাশ পাঠানোর মতো অবস্থা নেই। গত চার সপ্তাহে প্রায় চার হাজার মানুষ মারা গেছে। সেই লাশগুলো মর্গে পাঠানো হয়নি। এত লাশ ময়নাতদন্ত বা পরে সৎকার করার মতো লোকও পাওয়া যাচ্ছে না।

নিউইয়র্কে করোনায় মৃতের সংখ্যা ১৮ হাজার ছাড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই অঙ্গরাজ্যে অনেক বাংলাদেশির বসবাস। তাদের মধ্যে আক্রান্তের হারও বেশি। এখন পর্যন্ত অন্তত ১৫৫ জন বাংলাদেশি মারা গেছেন। এ প্রসঙ্গে ড. রাজুব বলেন, ‘পরিস্থিতি এতটা খারাপ হওয়ার পরও সবাই পুরোপুরি সচেতন নয়। এখানে অনেক বাঙালি আছে। তারাই আইন বেশি অমান্য করে। বিভিন্ন স্থানে বাঙালিদের ছোট ছোট গ্রোসারি শপে ভিড় জমায়। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে আড্ডা দেয়। নইলে এত আক্রান্ত হতো না।’

তিনি জানান, নিউইয়র্কের হাসপাতালে সেবা বেশ ভালো। তবে রোগীর অস্বাভাবিক চাপের কারণে স্বাস্থ্যকর্মীরা ১৬-২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। অনেকে অভিযোগ করছেন, চার হাজার মানুষ সেবা না পেয়ে মারা গেছেন। তবে এই দোষ স্বাস্থ্যকর্মী বা সরকারের নয়। আক্রান্ত মানুষ হাসপাতালে যেতে চাইছেন না। কারণ হাসপাতালে মারা গেলে নানা প্রক্রিয়া শেষে লাশ পেতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। আবার স্বজনরাও রোগীর সঙ্গে থাকতে পারেন না। তারা ফোন করে রোগীর হালনাগাদ তথ্য পেতেও বিড়ম্বনায় পড়েন। করোনা ছাড়া অন্যান্য সাধারণ রোগের চিকিৎসা নির্বিঘ্ন করতে আলাদা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নৌবাহিনীর একটি জাহাজ ‘ইউএসএস কমফোর্ট’ এখন এক হাজার শয্যার ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

নিজের কাজ প্রসঙ্গে রাজুব বলেন, ‘আমি হাসপাতালগুলোয় ডিউটি করছি। সেখানকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং সমস্যার সমাধান করা আমার কাজ। হাসপাতালগুলোর অবস্থা এখন খুবই খারাপ। সারাক্ষণ অ্যাম্বুলেন্স যাচ্ছে-আসছে। এখন এই শহরের মানুষের ঘুম ভাঙে অ্যাম্বুলেন্সের শব্দে। প্রত্যেক ধূলিকণায় যেন করোনার আতঙ্ক মিশে আছে। এমন পরিস্থিতিতে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিউইয়র্ক পুলিশের বিপুলসংখ্যক সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন অন্তত ২৯ জন। এর মধ্যে অপরাধীরাও সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে। দোকানপাট বেশিরভাগ বন্ধ। একেকটায় মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের জিনিসপত্র। নিউইয়র্ক যেমন বিশ্ব বাণিজ্যের একটি কেন্দ্র, তেমনি মাফিয়াদেরও স্বর্গরাজ্য। তাই বাড়তি সতর্কতা আছে। আমরা পিপিই পরে দায়িত্ব পালন করি।

তিনি জানান, নিউইয়র্ক শহরের বাসিন্দারা স্বাস্থ্যকর্মী ও পুলিশসহ করোনাকালে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা পেশাজীবীদের নিয়ম করে ধন্যবাদ জানায়। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে সবাই বাসার জানালা দিয়ে মাথা বের করে সুরে সুরে তালে তালে এই ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।

কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া নিউইয়র্কের মানুষ নিয়ম মেনে ঘরে থাকার চেষ্টা করছেন বলে জানান রাজুব। তিনি বলেন, ‘সামনে গ্রীষ্ফ্মকাল আসছে। এ সময় এখানে সবাই খুব আনন্দ করে। সমুদ্র সৈকতগুলো খুলে দেওয়া হয়। তবে এবার সৈকত পুরোপুরি বা আংশিক বন্ধ রাখা হবে। প্রায় সব পার্ক এখন বন্ধ। আবার এই পরিস্থিতিতে অনেকে আছেন চাকরি হারানোর শঙ্কায়।’

রাজুব ভৌমিক শিক্ষকতা ও পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চাও করেন। এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় তার তিনটি বই বেরিয়েছে। সেগুলো হলো- আয়না সনেট, শশীকাহন ও টেম্পু পাশা নাইটসিফট। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় তার লেখা ‘জার্নালিস্ট অব টুডে : প্রোফাইলস ইন ফ্যাশন অ্যান্ড ডাইভার্সিটি’। এ ছাড়া তার উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে- ‘ক্রিমিনাল জাস্টিস : থিওরি ইন প্র্যাকটিস’ ও ‘লিডিং থিওরিজ অব ডিলিঙ্কুয়েন্ট বিহেভিয়ার অ্যান্ড ক্রিমিনোলজি’।

একসঙ্গে এতকিছু কীভাবে সামলান? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি হেসে বলেন, ‘প্রথম প্রজন্মকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য পরিশ্রম তো করতেই হয়। আমি রাত ৯টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত পুলিশের দায়িত্ব পালন করি। বাসায় ফিরে তিন ঘণ্টা ঘুমাই। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে যাই। এসবের পাশাপাশি নিজের পড়াশোনা ও লেখালেখি চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি।’

-সমকাল থেকে

সংবাদটি শেয়ার করুন