জানা অজানা ফিচার্ড

বিশ্ব বই দিবস এবং বটতলা ||| সিদ্ধার্থ সিংহ

বিশ্ব বই দিবস এবং বটতলা ||| সিদ্ধার্থ সিংহ
 
আজ ২৩ এপ্রিল, বিশ্ব বই দিবস। রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্যোগে ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর এই দিনটিকে মহাধুমধাম করে পালন করা হয়। এই বই দিবসের মূল উদ্দেশ্যই হল— বই পড়া, বই ছাপানো, বইয়ের কপিরাইট সংরক্ষণ করা ইত্যাদি বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানো।
আর বই মানেই তো কলেজ স্ট্রিট। এই কলেজ স্ট্রিট, মানে বইপাড়ার কথা আলোচনা করতে গেলেই খুব স্বাভাবিক ভাবেই উঠে আসবে ‘বটতলা’র কথা। কারণ, কলেজ স্ট্রিটে নয়, বইপাড়ার প্রথম সূচনা হয়েছিল বটতলাতেই।
বটতলাটা কোথায় ছিল, কোথায় ছিল সেই বটগাছ? এই প্রসঙ্গে ড. সুকুমার সেন জানিয়েছেন— ‘সেকালে অর্থাৎ আজ থেকে দেড়শো বছরেরও বেশিকাল আগে শোভাবাজার বালাখানা অঞ্চলে একটা বড় বনষ্পতি ছিল, সেই বটগাছের শানবাঁধানো তলায় তখনকার পুরবাসীদের অনেক কাজ চলত। বসে বিশ্রাম নেওয়া হতো, আড্ডা দেওয়া হতো। গান বাজনা হতো, বইয়ের পসরাও বসত। অনুমান হয়, সেই বইগুলো ছিল বিশ্বনাথ দেবের ছাপা। ইনিই বটতলা অঞ্চলে এবং সেকালের উত্তর কলকাতায় প্রথম ছাপাখানা খুলেছিলেন।’
বটতলা অঞ্চলে যে সব পুরোনো পুস্তক বিপণির সন্ধান পাওয়া যায় সেগুলি হল— ‘ডায়মণ্ড লাইব্রেরি’, ‘পাল ব্রাদার্স’, ‘হাতিউদ্দিন আহম্মদ’, ‘ওসমানিয়া লাইব্রেরি’, ‘তারা লাইব্রেরি’, ‘ভিক্টোরিয়া লাইব্রেরি’, ‘ওরিয়েন্ট লাইব্রেরি’, ‘সুলভ লাইব্রেরি’, ‘পূর্ণচন্দ্র শীল’ ইত্যাদি। যেহেতু বইয়ের দোকানে নানা রকম বই মজুত থাকে এবং লাইব্রেরিতেও প্রচুর বই থাকে, তাই সে সময় বেশির ভাগ বইয়ের দোকানের নামের সঙ্গে ‘লাইব্রেরি’ শব্দটা জুড়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
১৮১৮ সাল থেকে ১৮২০ সালের মধ্যে বটতলায় চালু হয় ছাপাখানা। উনিশ শতকের বটতলায় যেমন দেখা যায় মুদ্রণ যন্ত্রের প্রাচুর্য, তেমনি বই প্রকাশনের রমরমা। বাঙালি প্রবর্তিত সংবাদপত্র ‘বাঙ্গাল গেজেটি’ও প্রকাশিত হয়েছিল এই বটতলা থেকেই।
প্রসঙ্গত, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি ছিলেন একাধারে সাংবাদিক। তাঁর সম্পাদিত সংবাদপত্র ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ প্রথম প্রকাশিত হয় ৫ই মার্চ, ১৮২২ সালে। ১৯২২ সালের ১৩ মার্চ আনন্দবাজার পত্রিকা বেরোনোর ঠিক একশো বছর আগে।
তাঁর ‘দূতীবিলাস’ কাব্য ছাপানো হয়েছিল ৯৩ নং গরাণহাট স্ট্রিট, বটতলা থেকে। ভবানীচরণ প্রসঙ্গে ব্রজেন্দ্রনাথ বলেছেন— ‘সাহিত্যে তিনিই সর্বপ্রথম ব্যঙ্গ রচনার সূচনা করেন। তিনিই সর্বপ্রথম সাহিত্যের দর্পণে বাবু ও বিবি বাঙালীকে নিজ নিজ মুখ দেখাইয়া আত্মস্থ হইতে শিক্ষা দেন। পথভ্রান্ত বাঙালীকে মানুষ করিয়া তুলিবার প্রথম ইঙ্গিত তাঁহার রচনাতেই আমরা প্রথম দেখিতে পাই।’
বলা বাহুল্য, ভবানীচরণের এই লেখাজোখাই বটতলা সাহিত্যে একটি আলাদা মাত্রা যোগ করেছিল। বটতলা সাহিত্যে এই নকশা, প্রহসন ও চটুল গানের ব্যঙ্গ বিদ্রুপের মধ্য দিয়ে বারবার প্রতিফলিত হয়েছিল উনিশ শতকের সমাজচিত্র। যেমন ‘কিসে নাই কি পান্তা ভাতে ঘি (১৮৬৩) পুস্তিকায় একটি গান ছিল— কড়াই মুড়ি তাল ফোচ্‌কে ছুঁড়ি। আবার একটি প্রহসনের নাম, ‘হাড় জ্বালানি’ (১৮৬১)।
উনিশ শতকের সমাজের যে চিত্র আমরা ‘হুতুম প্যাঁচার নকশা’য় পাই অথবা দীনবন্ধু মিত্রের প্রহসনে পাই, তার প্রকাশ সব চেয়ে বেশি ঘটেছিল বটতলা সাহিত্যে। বটতলার সাহিত্যকে আমরা যতই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করি, নাক সিঁটকোই, মোটা দাগের সাহিত্য, নিম্ন রুচির এবং প্রান্তিক বলে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করি না কেন, এই সব সাহিত্য, সঙ্গীত কিন্তু গড়ে উঠেছিল তৎকালীন সামাজিক রুচি ও বিষয়বস্তুকে অবলম্বন করেই। বটতলার সাহিত্যে এত রকমের মানুষের আনাগোনা হয়েছে, যা অন্য কোনও সাহিত্যে মেলা ভার। যে সাহিত্যকে আমাদের তথাকথিত সাহিত্য বোদ্ধারা ‘উচ্চবর্গীয় সাহিত্য’ বলে সম্মোধন করেন, না, সেই সব সাহিত্যে তার ছিঁটেফোটাও দেখা যায়নি।
অজস্র বিষয় নিয়ে বটতলা থেকে বই প্রকাশিত হতো। যেমন, ধর্ম-অধর্ম, ইংরাজ ভজনা, ইংরাজ নিন্দা, জ্যোতিষ, জালিয়াতি, খুন-রাহজানি, নীতিশিক্ষা, গীতিশিক্ষা, নারীশিক্ষা, বিধবা বিবাহ, অসম বিবাহ, জ্যোতিষচর্চা, তন্ত্রমন্ত্র, তুকতাক, নারী চেনার উপায়— অর্থাৎ সামাজিক সমস্ত বিষয়ই বটতলায় হাজির ছিল। বটতলা না থাকলে আমরা আজকের এই ‘উচ্চবর্গীয় সাহিত্য’কে কিছুতেই পেতাম না। বটতলার বই আমাদের হারিয়ে যাওয়া অতীতকে অকাট্য হিসেবে প্রামাণ্য করে রেখেছে।
কলেজ স্ট্রিটে যখন একাধারে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, সংস্কৃত কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজের মতো যত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে লাগল, ততই যেন প্রগতি চেতনা নতুন করে অক্সিজেন জোগাল এই অঞ্চলের পুস্তক ভাণ্ডারগুলোকে। আর তার ফলেই এত দিনকার জৌলুস ধীরে ধীরে হারিয়ে ক্রমশ শীর্ণ থেকে আরও শীর্ণ হতে লাগল বটতলার বইপাড়া।
১৯১২ সালে মধ্য কলকাতায় বিদ্যুৎ চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কলেজ স্ট্রিট বইপাড়াকে আরও রসদ জোগাল আর্ট প্রেস, বিজয় প্রেস, গৌরাঙ্গ প্রেস। যে গৌরাঙ্গ প্রেস পরে কিনে নেয় আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠী। এই মুদ্রণ-বিজ্ঞানের উন্নতির ফলেই আধুনিক ছাপাই, বাঁধাই, বিষয়বৈচিত্র্য, আর্টওয়ার্ক দ্রুত পালটে দিতে লাগল পাঠকদের রুচিবোধ।
আজ কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া বিশ্বের সেরা বইয়ের বাজার হয়ে ওঠার পিছনে এটাও ছিল একটা অন্যতম কারণ।
কিন্তু বটতলার প্রকাশকেরা কলেজ স্ট্রিটের প্রকাশকদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারল না কেন? না পারার প্রধানত কারণ তিনটি— প্রথমত, পাঠকের পাঠরুচির দ্রুত পরিবর্তন। বটতলায় যে ধরনের বই বেশি কাটতি ছিল, যেমন নকশা, প্রহসন, গদ্যপদ্যের মিশ্রণে তৈরি চম্পু, অদ্ভুত বশীকরণ, তন্ত্রমন্ত্র, পূজা পদ্ধতি, ব্রতকথা, নিত্যকর্ম পদ্ধতি, তর্জা— যেগুলো ছিল ওঁদের একচেটিয়া বিক্রি, সেই বইগুলো পাঠক আর নিচ্ছিল না। এর পাশাপাশি ওঁরা বুঝতেও পারছিলেন না, পাঠক কী ধরনের বই চাইছে। কী ধরনের বই তাঁদের করা উচিত। 
দ্বিতীয়ত, মুদ্রণ-বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া যে ভাবে পাল্লা দিয়ে নিজেদের উন্নত করেছে, বটতলার প্রকাশকেরা তার একআনাও করতে পারেনি।
তৃতীয়ত এবং প্রধান কারণ হল, কাগজের দাম, ছাপা ও বাঁধাইয়ের খরচ দিন দিন এত বেড়ে যাচ্ছিল, সেই টাকা লাগানোর মতো পর্যাপ্ত পুঁ‍‌জি বটতলার অধিকাংশ প্রকাশকেরই ছিল না। ফলে তাঁদের বই-ব্যবসা একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছিল।
তাঁদের মধ্যে থেকেই যে গুটিকতক প্রকাশক ওখানকার ব্যবসা গুটিয়ে কলেজ স্ট্রিট বা তার আশপাশে এসে নতুন উদ্যোমে ফের শুরু করেছিলেন প্রকাশনা, একমাত্র তাঁরাই কোনও রকমে টিকে গিয়েছিলেন। তার পরেও যাঁরা কলেজ স্ট্রিটে এসেও পুরোনো ধ্যান-ধারণা আঁকড়ে বসেছিলেন, তাঁরা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছিলেন। কেউ কেউ বইয়ের ব্যবসা তুলে দিয়ে একেবারে অন্য ব্যবসায় মন দিয়েছিলেন। কেউ কেউ আবার দোকান বিক্রিও করে দিয়েছিলেন।
যাঁদের বিক্রি করেছিলেন, তাঁরা যে সকলেই বাঙালি ছিলেন, তা কিন্তু নয়। অনেক অবাঙালিও এগিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু অবাঙালি হলে কী হবে? বাঙালি বই-ব্যবসায়ীদের সঙ্গে থেকে থেকে আদব-কায়দা শিখে তাঁরাও যেন বাঙালি হয়ে উঠেছিলেন।
তাঁরাও অন্যান্য প্রকাশকদের দেখাদেখি ঘটা করে পালন করতেন পয়লা বৈশাখ। সে দিনই লেখকদের বরাদ দিতেন নতুন লেখার। চুক্তিও করতেন সেই দিনই।
কিন্তু বইয়ের সেই রমরমা এখন আর নেই। বইপাড়া হারাতে বসেছে তার এত দিনকার সেই পুরোনো ঐতিয্য। তার জৌলুস। কারণ একটাই, নতুন করে আর পাঠক তৈরি হচ্ছে না। লোকেরা যেন দিন দিন বই বিমুখ হয়ে যাচ্ছেন। প্রকাশকরাও হাত গুটিয়ে নিচ্ছেন ধীরে ধীরে। ফলে বেশ কয়েক জন প্রকাশক যতই নতুন করে জেগে ওঠার চেষ্টা করুন, লেখকরা যতই নতুন নতুন ভাবনা-চিন্তা করে টগবগ করে ফুটুন, বইপাড়াকে কিন্তু ইতিমধ্যেই গ্রাস করতে শুরু করেছে একটা অশুভ কালো ছায়া। 
কয়েক বছর আগে দশ কোটি টাকা নিয়ে বইয়ের ব্যবসায় নেমেছিলেন অমল সাহা। খুলেছিলেন সৃষ্টি নামের একটি প্রকাশনা সংস্থা। পাশাপাশি ছিল সেই সময় রমরম করে চলা ক্যাসেটের ব্যবসাও। বাগুইআটির বাইপাসের ওপর নিয়েছিলেন বিশাল বাড়ি। কিন্তু মাত্র কয়েক বছর। সর্বস্ব জলাঞ্জলি যায় তাঁর। ধারে গলা অবধি ডুবে যান। বউয়ের সমস্ত গয়না বিক্রি করেও সে ঋণ শোধ করতে পারেননি তিনি। খুব শোচনীয় অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।
যাঁরা স্কুলপাঠ্য বই করতেন, সেই বই সরকার থেকে বিনে পয়সায় দেওয়ায় সেই ব্যবসাও থমকে গেছে। এ বার কি তবে কবিতা, ছড়া, গল্প, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধের বইয়ের পালা! কবে যে এর কবল থেকে বইপাড়া রেহাই পাবে, আদৌ পাবে কি না, কে জানে!
সংবাদটি শেয়ার করুন