বিশ্ব

একালের রবিনহুড? হ্যাকাররা চুরি করা অর্থ কেন দান করছে

হ্যাকাররা চুরি করা অর্থ
প্রতীকি ছবি

একালের রবিনহুড? হ্যাকাররা চুরি করা অর্থ কেন দান করছে

একটি হ্যাকিং গোষ্ঠী তাদের চুরি করা অর্থ বিভিন্ন দাতব্য সংস্থাকে দান করছে। সাইবার অপরাধের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ এভাবে রহস্যজনকভাবে দান করার ঘটনা এটাই সম্ভবত প্রথম এবং এটি বিশেষজ্ঞদের বেশ ধাঁধাঁয় ফেলে দিয়েছে।

‘ডার্কসাইড হ্যাকার্স’ নামের এই গোষ্ঠীটি হ্যাকিং এর মাধ্যমে বিভিন্ন কোম্পানি থেকে এ পর্যন্ত লাখ লাখ ডলার হাতিয়ে নিয়েছে বলে দাবি করা হয়। তবে এই হ্যাকাররা এখন বলছে, বিশ্বকে তারা আরও বাসযোগ্য করতে চায়। ডার্ক ওয়েবে এক পোস্টে তারা জানিয়েছে, দুটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানে তারা বিটকয়েনে দশ হাজার ডলার দান করেছে। এই দানের রসিদও তারা সেখানে পোস্ট করেছে।

তবে দুটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের একটি, ‘চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল’ জানিয়েছে, তারা এই অর্থ নেবে না।

এই ঘটনাটি একেবারেই অদ্ভূত এবং বেশ চিন্তিত হওয়ার মতো ব্যাপার- নৈতিক এবং আইনগত, দু’দিক থেকেই।

গত ১৩ই অক্টোবর এক ব্লগ পোস্টে ডার্কসাইড হ্যাকার্স দাবি করেছে যে তারা কেবল বড় বড় লাভজনক কোম্পানিকে টার্গেট করে তাদের ‘র‍্যানসমওয়্যার’ দিয়ে। র‍্যানসমওয়্যার মূলত এমন ধরণের কম্পিউটার ভাইরাস, যার মাধ্যমে কোন প্রতিষ্ঠানের আইটি সিস্টেমকে জিম্মি করে রাখা হয় মুক্তিপণ না দেয়া পর্যন্ত।

ডার্কসাইড হ্যাকার্স এই ব্লগপোস্টে লিখেছে, “আমরা মনে করি, বিভিন্ন কোম্পানি যে অর্থ দিয়েছে, তার একটা অংশ দাতব্য প্রতিষ্ঠানকে দেয়া উচিৎ, এটাই ন্যায্য।

“আমাদের কাজকে আপনারা যতটা খারাপ বলেই ভাবুন না কেন, আমরা আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, আমরা কোন একজনের জীবন বদলাতে সাহায্য করেছি। আজ আমরা আমাদের প্রথম দানের অর্থ পাঠিয়েছি।”

এই সাইবার অপরাধীরা বিটকয়েনে তাদের অর্থ দান করে ‘দ্য ওয়াটার প্রজেক্ট’ এবং ‘চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল’ নামে দুটি দাতব্য সংস্থাকে। তারা দান করেছে শূন্য দশমিক ৮৮ বিটকয়েন। দান করার পর তারা যে ট্যাক্স রসিদগুলো পেয়েছে, সেগুলোও পোস্ট করেছে।

চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল মূলত শিশুদের নিয়ে কাজ করে। ভারত, ফিলিপাইন, কলম্বিয়া, জাম্বিয়া, ডোমিনিকান রিপাবলিক, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস, মেক্সিকো এবং যুক্তরাষ্ট্রে তাদের কাজ আছে। প্রতিষ্ঠানটির একজন মুখপাত্র বিবিসিকে জানিয়েছেন, “এই দানের অর্থ যদি কোন হ্যাকারের কাছ থেকে এসে থাকে, আমাদের কোন ইচ্ছে নেই সেই অর্থ নেয়ার।”

অন্য দাতব্য সংস্থা, দ্য ওয়াটার প্রজেক্ট এখনো এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য করেনি। এই প্রতিষ্ঠানটি মূলক সাব-সাহারান আফ্রিকায় সুপেয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে কাজ করে।

একটি সাইবার সিকিউরিটি কোম্পানি ‘এমসিসফট‌ের’ বিশ্লেষক ব্রেট ক্যালো বলেন, “এভাবে অর্থ দান করে এই অপরাধীরা আসলে কী অর্জন করতে চায়, তা পরিস্কার নয়। হয়তো তাদের মধ্যে যে অপরাধবোধ কাজ করছে, সেটি কাটাতে চায়? অথবা হয়তো তারা একধরণের অহমিকা থেকে এটা করছে। নিজেদেরকে তারা হয়তো বিবেকহীন চাঁদাবাজের পরিবর্তে রবিনহুডের মতো কেউ বলে ভাবছে।”

“তাদের উদ্দেশ্য যাই হোক, এটা খুবই অস্বাভাবিক এক ঘটনা। আমার জানা মতে এই প্রথম কোন র‍্যানসমওয়্যার হ্যাকার গোষ্ঠী এভাবে তাদের আয় করা অর্থ কোন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দান করলো।”

ডার্কসাইড হ্যাকার্স তুলনামূলকভাবে নতুন এক গোষ্ঠী। তবে ক্রিপটো-কারেন্সি মার্কেট বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে এরা তাদের ভিক্টিমদের কাছ থেকে জোর করে অর্থ আদায় করছে।

তবে অন্যান্য সাইবার অপরাধী গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ আছে বলেও প্রমাণ আছে। এরকম একটি সাইবার অপরাধী গোষ্ঠী গত জানুয়ারীতে ট্রাভেলেক্সের ওপর হামলা চালিয়েছিল, র‍্যানসমওয়্যার দিয়ে তাদের প্রায় অচল করে দিয়েছিল।

এই হ্যাকাররা যেভাবে দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থ দান করেছে, সেটিও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে চিন্তায় ফেলেছে।

সাইবার অপরাধীরা এজন্য ব্যবহার করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি সেবা, ‘দ্য গিভিং ব্লক।’

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৬৭টি সংস্থা এই সেবা ব্যবহার করে। এদের মধ্যে আছে ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’, ‘রেইনফরেস্ট ফাউন্ডেশন’ এবং ‘শী ইজ দ্য ফার্স্টে’র মতো দাতব্য প্রতিষ্ঠান।

দ্য গিভিং ব্লক দাবি করে, তারাই একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যাদের মাধ্যমে ক্রিপটো-কারেন্সি দিয়ে অর্থ দান করা যায়।

দু’হাজার আঠারো সালে এই প্রতিষ্ঠানটির শুরু। তারা ক্রিপটো-কারেন্সির মাধ্যমে যারা কোটিপতি হয়েছে, তাদেরকে ক্রিপটোকারেন্সীতে অর্থ দানের সুযোগ করে দেয়, যেটি তাদের করের দায় কমাতেও সাহায্য করবে।

দ্য গিভিং ব্লক গনমাধ্যমকে জানিয়েছে, এই অর্থ যে সাইবার ক্রিমিনালরা দান করেছে, সেটা তাদের জানা ছিল না। তারা বলেছে, “আমরা এখনো খোঁজ নিয়ে দেখছি এই অর্থ আসলেই চুরি করা কীনা।”

“যদি দেখা যায় যে এই অর্থ আসলে চুরি করা, আমরা তখন এই অর্থ যাদের, তাদের ফেরত দেয়ার কাজ শুরু করবো।”

তবে কোম্পানিটি এটা স্পষ্ট করেনি, তারা কি এই অর্থ সাইবার অপরাধীদের কাছেই ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলছে, নাকি এই অপরাধীদের শিকার হয়েছিল যারা, তাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলছে।

দ্য গিভিং ব্লক ক্রিপটো-কারেন্সির বড় সমর্থক। তারা আরও বলেছে, “ওরা যেহেতু ক্রিপটো-কারেন্সিতে অর্থ দান করেছে, তাই তাদের ধরাটা বরং সহজ, কঠিন নয়।”

তবে দাতাদের ব্যাপারে দ্য গিভিং ব্লক কী ধরণের তথ্য সংগ্রহ করে, তার বিস্তারিত জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠান বিটকয়েনের মতো ডিজিটাল কারেন্সি কেনা-বেচা করে, তারা ব্যবহারকারীদের পরিচয় যাচাই করে। কিন্তু দ্য গিভিং ব্লকের ক্ষেত্রে সেটি করা হয়েছে কীনা, তা নিশ্চিত নয়।

গনমাধ্যম পরীক্ষামূলকভাবে পরিচয় প্রকাশ না করে দ্য গিভিং ব্লকের অনলাইন সিস্টেমের মাধ্যমে কিছু দান করতে চেয়েছিল, সেখানে দাতার পরিচয় যাচাই করার জন্য কোন প্রশ্ন করা হয়নি।

ফিলিপ গ্রাডওয়েল কাজ করেন ‘ক্রিপটো-কারেন্সি অ্যনালিসিস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে, তিনি ক্রিপটো-কারেন্সির বিষয়ে তদন্ত করেন।

“আপনি যদি মুখোশ পরে কোন চ্যারিটি শপে যান এবং তাদেরকে নগদ ১০,০০০ পাউন্ড দান করেন, তারপর একটি রসিদ দাবি করেন, তখন আপনাকে সম্ভবত অনেক প্রশ্ন করা হবে- এক্ষেত্রেও কোন ব্যতিক্রম নেই।”

“এটা সত্য যে গবেষকরা এবং আইন প্রয়োগকারীরা ক্রিপটো-কারেন্সি অর্থ কোত্থেকে কোথায় যাচ্ছে তা খুঁজে বের করতে এখন অনেক বেশি দক্ষ হয়ে উঠেছেন। কারণ এই ক্রিপটো-কারেন্সি এখন হাতবদল হয়ে ঘুরছে বিশ্বের নানা জায়গায়। তবে প্রতিটি ক্রিপটো-কারেন্সি ওয়ালেটের আসল মালিক কে, সেটি খুঁজে পাওয়া অনেক বেশি জটিল কাজ। অজ্ঞাতপরিচয় লোকজনকে যখন সম্ভাব্য অবৈধ উৎস থেকে পাওয়া অর্থ এভাবে দান করতে দেয়া হচ্ছে, তা কিন্তু অর্থ পাচারের জন্য দরোজা খুলে দেয়ার বিপদ তৈরি করছে।”

“সব ক্রিপটো-কারেন্সি ব্যবসাতেই কিন্তু বহু ধরণের ‘এন্টি-মানি লন্ডারিং’ পদক্ষেপ নিতে হয়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ‘নো ইউর কাস্টমার‌’ (কেওয়াইসি), অর্থাৎ আপনার গ্রাহককে জানুন। এর মাধ্যমে গ্রাহকের ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাই করা হয়, যাতে করে কোন লেন-দেনের পেছনের ব্যক্তিটি আসলে কে, সেটা বোঝা যায়।”

দ্য গিভিং প্রজেক্টের মাধ্যমে আরও যেসব দাতব্য প্রতিষ্ঠান অনুদান নেয়, তাদের সঙ্গে কথা বলেছে গনমাধ্যম।

সেভ দ্য চিলড্রেন গনমাধ্যমকে জানিয়েছে, তারা কখনোই জেনেশুনে এমন দানের অর্থ নেয় না, যা অপরাধের মাধ্যমে অর্জন করা।

মেয়ে শিশুদের শিক্ষা নিয়ে কাজ করে ‘শী ইজ দ্য ফার্স্ট‌’। তারা বলেছে, অজ্ঞাতপরিচয় এবং সম্ভাব্য অপরাধমূলক উৎস থেকে আসার অনুদান তারা নিতে স্বস্তিবোধ করবে না।

সংস্থাটি বলেছে, এটি খুবই লজ্জার ব্যাপার যে খারাপ কিছু লোক ক্রিপটো-কারেন্সির মাধ্যমে দান করার এই সুযোগটি অপব্যবহার করছে। আমরা আশা করবো নামপরিচয় গোপন রাখতে চান এমন দাতারাও যেন আমাদের সমাজের মূল্যবোধের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন।”

সূত্রঃ বিবিসি

বাঅ/এমএ


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন