জানা অজানা ফিচার্ড

যৌনতা নিয়ে যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দেন, লজ্জা কাটান ‘যৌন প্রশিক্ষক’ পল্লবী

১ / ১৯ যৌনতার প্রশিক্ষণ দেন পল্লবী বার্নওয়াল। যে সব শারীরিক চাহিদা নিয়ে আলোচনা করা ভারতীয় সমাজে ‘নিষিদ্ধ’ তা তাঁর কাছে অনয়াসে জানতে চাওয়া যায়। তিনি তার জবাবও দেন সহজ ভাবে। প্রশ্নকর্তার মানসিকতার বিচার না করেই।

যৌনতা নিয়ে যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দেন, লজ্জা কাটান ‘যৌন প্রশিক্ষক’ পল্লবী

দিল্লির বাসিন্দা পল্লবী জানেন ভারতে যৌনতা নিয়ে আলোচনাতেও এক ধরনের অপরাধবোধ কাজ করে। অথচ আন্তর্জাতির পরিসংখ্যান বলছে ভারতেই পর্নোগ্রাফির দর্শক সবচেয়ে বেশি। কেন্দ্র আইন করে এই ধরনের প্রাপ্তবয়স্ক ওয়েবসাইট নিষিদ্ধ করেছে। তার পরও এ দেশে পর্ন ছবি দেখা হয় সবচেয়ে বেশি।
ভারতীয়দের এই অপরাধবোধের অন্ধকার থেকেই টেনে বার করতে চান পল্লবী। তিনি মনে করেন শরীর নিয়ে বা শারীরিক চাহিদা নিয়ে ভারতীয়দের সীমিত জ্ঞানই এই অপরাধবোধের কারণ, যা থেকে অপরাধেরও জন্ম নেয়।

যৌন অপরাধের সংখ্যায় বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ দেশগুলির অন্যতম ভারত। অথচ এ দেশেই যৌনতা নিয়ে খোলামেলা আলোচনায় লজ্জার শেষ নেই। যেখানে বিশ্বের অন্য দেশগুলিতে সাত বছর বয়স থেকেই যৌন শিক্ষার পাঠ শুরু হয় সেখানে ভারতে এখনও স্কুলশিক্ষায় যৌনতার পাঠ্যক্রম নিয়ে নানা ভ্রান্ত ধারণা রয়ে গিয়েছে।
বছর তিনেক হল যৌনশিক্ষাকে স্কুলপাঠ্যের অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে একটি নির্দেশিকা জারি করেছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক। সেই নির্দেশ এখনও পালন করেনি দেশের অর্ধেকের বেশি রাজ্য। যৌনশিক্ষা নিয়ে এই অন্ধকারে থাকা এবং রাখার মনোভাবকেই বদলাতে চান পল্লবী।

পল্লবী নিজের পরিচয় দেন ‘সেক্স কোচ’ বা ‘যৌন প্রশিক্ষক’ হিসাবে। তিনি মনে করেন, যৌনতাকে অপরাধের পর্যায়ে নিয়ে যায় শরীর নিয়ে আমাদের অজ্ঞানতা। দেশে বাড়তে থাকা যৌন অপরাধের একটা বড় কারণও এই মনোভাবই। পল্লবী নিজেও সেই অপরাধবোধের শিকার হয়েছেন বহু বার।

ছোটবেলা থেকেই বাবা-মায়ের জটিল সম্পর্ক দেখে বড় হয়েছেন। প্রথমে না বুঝলেও পরে বুঝেছিলেন, তাঁর বাবা-মায়ের মধ্যে কোনও এক তৃতীয় ব্যক্তি না থেকেও আছেন।

পল্লবী জানিয়েছেন, পার্টিতে বা কোনও অনুষ্ঠানে গেলে পরিচিত অপরিচিত মহিলারা ঘিরে ধরতেন তাঁকে। বাবা-মায়ের সম্পর্ক নিয়ে নানারকম প্রশ্নে ওই বয়সেই জেরবার হতে হত তাঁকে। তাঁর বাবা-মা একই বিছানায় পাশাপাশি ঘুমোন কি না, সেই প্রশ্নও করা হত। তবে বাবা-মাকে কখনও এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শোনেননি তিনি।

পল্লবী জানিয়েছেন, বিষয়টি তিনি জানতে পারেন তাঁর নিজের বিবাহবিচ্ছেদের পর। তাঁর মা নিজেই তাঁকে ঘটনাটি বলেছিলেন। পল্লবী জেনেছিলেন, তাঁর মায়ের বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কথা। জেনেছিলেন, তাঁর বাবা বিষয়টি কানাঘুষোয় শুনলেও বহুদিন তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন করেননি। পল্লবীর মা কে এ নিয়ে প্রশ্ন করতে তাঁর বাবার ১০ বছর সময় লেগেছিল। তত দিনে তাঁরা দুই সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু তারপরও স্ত্রী-র বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কথা সহজ ভাবে নিতে পারেননি পল্লবীর বাবা। ঘটনাটি সমস্ত আবরণ সরিয়ে সামনে এসে যাওয়ার পর দু’জনের সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে। যা আর কখনওই ঠিক হয়নি।

পল্লবী জানিয়েছেন, সে দিন তিনি বুঝেছিলেন শারীরিক ইচ্ছে নিয়ে খোলাখুলি আর সহজে কথা বলতে না পারা পরিবার ভেঙে দিতে পারে। পল্লবীর নিজের বিয়েও তেমনই সমস্যার শিকার।

পল্লবীর কথায়, ২৫ বছর বয়সেই তিনি কুমারিত্ব হারান। তবে শরীর বা শারীরিক চাহিদা সম্পর্কে তখনও প্রায় কিছুই জানতেন না তিনি। দু’বছর পর তাঁর বিয়ের রাতে তাঁকে ভান করতে হয়েছিল যেন পুরোটাই তাঁর প্রথম অভিজ্ঞতা। পল্লবী জানিয়েছেন, তাঁকে ওই পরামর্শ দিয়েছিলেন তাঁর মা। কিন্তু পরে কোনও দিনই স্বামীর সঙ্গে তাঁর যৌন সম্পর্ক সহজ হয়নি।

বছর খানেকের মধ্যে এক সহকর্মীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন তিনি। এক ছেলে নিয়ে বিবাহবিচ্ছিন্না হন পল্লবী। তিনি জানিয়েছেন, বিয়ের রাতে কী করা উচিত এই প্রশ্ন এখনও প্রায়শই আসে তাঁর কাছে। অধিকাংশ প্রশ্নকর্তাই জানতে চান, তাঁরা কী ভাবে তাঁদের অতীত অভিজ্ঞতাকে ঢাকবেন অথচ কিছুই জানেন না এমন হাবভাবও দেখাতে হবে না!

বিচ্ছেদের পর একা মা পল্লবী একের পর এক যৌন সম্পর্কে জড়িয়েছেন। পল্লবীর কথায়, হঠাৎ করেই বেশ হালকা বোধ করছিলাম আমি। নিজেকে মেলে দিয়েছিলাম সব রকম অভিজ্ঞতার জন্য। বিবাহিত পুরুষ, বয়সে অনেক বড় পুরুষের সঙ্গেও সম্পর্কে জড়িয়েছি। ধীরে ধীরে যৌনতা নিয়ে আমার ধারণা বদলাচ্ছিল। আমার কথাবার্তা আলোচনাতেও তা প্রকাশ পাচ্ছিল। বিবাহিত বন্ধুরা পরামর্শ চাইতে আসতে শুরু করেছিল আমার কাছে।

তবে পেশাদার যৌন প্রশিক্ষক হবেন তখনও ভাবেননি পল্লবী। ২০১২ সালে দিল্লির নির্ভয়া-কাণ্ড তাঁর ধারণা বদলে দেয়। পল্লবী বলেছেন, ‘‘ঘটনাটি ভয়াবহ ছিল। কিন্তু আমাকে যা চিন্তায় ফেলেছিল, তা হল ওই আলোচনাকে ঘিরে থাকা উপ আলোচনাগুলি। যেখানে যৌনতা মানেই নৃশংসতা। আমার মনে হয়েছিল কেন এমন ভাবা হবে। যৌনতা থেকে যে আনন্দও নেওয়া যায় আর তাতে একজন মহিলার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকতে পারে, সেটা ভুলে গেলে চলবে কী করে?

এই ভাবনা থেকেই যৌন প্রশিক্ষক হওয়ার যাত্রা শুরু পল্লবীর। সেলসের কাজ করতেন। ঠিক করেন কেরিয়ারের অভিমুখ বদলাবেন। তাঁর মনে হয়েছিল এ দেশ একটা মুক্ত মঞ্চ থাকা দরকার যেখানে মানুষ তাঁদের শারীরিক চাহিদা ও যৌনতা নিয়ে নানা সংশয়ের কথা খেলা মনে আলোচনা করতে পারবেন। সময় নিয়ে এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ নেন পল্লবী। বিশদে পড়াশোনা করেন।

কিন্তু যৌনতা নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে গেলে বাধা আসবে, তা পল্লবী জানতেন। তাই তিনি একটা ইনস্টাগ্রাম পেজ তৈরি করে সেখানে তাঁকে প্রশ্ন করতে বলেন। সেখানেই নিজের নানা অভিজ্ঞতা নিয়েও কথা বলতে শুরু করেন পল্লবী। তাতে কাজ হয়। মানুষ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেন।

দু’বছর আগে টেড টকে কথা বলার জন্যও ডাকা হয় তাঁকে। পল্লবী জানিয়েছেন, টেড টকে শা়ড়ি পড়ে মঞ্চে উঠেছিলেন তিনি। যৌনতা নিয়ে কথা বলায় যে কোনও পাশ্চাত্য ভাবনার দরকার হয় না, একজন ভারতীয় নারীও তাঁর ইচ্ছের কথা সহজে বলতে পারেন, এটা বোঝানোই লক্ষ্য ছিল তাঁর।

এর পর থেকে বহু মানুষ যোগাযোগ করেছেন পল্লবীর সঙ্গে। দিনে গড়ে ৩০টি করে প্রশিক্ষণের অনুরোধ আসতে শুরু করেছিল তাঁর কাছে। পল্লবীকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি।

পল্লবীর ছেলেরও আট বছর। ওকে সহজ ভাবেই বড় করছেন। সময় মতো যৌনতার শিক্ষা তিনিই দেবেন ছেলেকে। কারণ তিনি মনে করেন, ছেলেমেয়েরা বাবা-মায়ের থেকেই এ ব্যাপারে সবচেয়ে ভাল প্রাথমিক শিক্ষা নিতে পারে। তাঁদের অভিজ্ঞতাকে বাস্তব অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখে তার সঙ্গে মানসিক যোগ স্থাপন করতে পারে তারা।
সংবাদটি শেয়ার করুন