যাপিত জীবন

জাপানের যাপিত জীবন – ৫ | সুশীল কুমার পোদ্দার

ধা রা বা হি ক…….পূর্ব প্রকাশের পর

জাপানের যাপিত জীবন – ৫ | সুশীল কুমার পোদ্দার

দেখতে দেখতে আমাদের ওসাকার জীবন সংক্ষিপ্ত হয়ে আসে। আমাদের এ শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয় শহরে। হোস্ট আমাদের প্রায় প্রতি সপ্তাহান্তে নিয়ে যান দর্শনীয় জায়গায়। অকাতরে খরচ করে যান আমাদের পেছনে। নিয়ে যান বড় বড় রেস্টুরেন্টে, যেখানে খাবার চেয়ে খাদ্য অপচয় হয় অধিক।

একদিন ক্লাসে সেনসেই জাপানের মাফিয়া চক্র ইয়াকুজার কথা বলেন। বলেন তাদের উদ্ভব, বিকাশ ও জাপানিজ সমাজে তাদের আধিপত্যের কথা। বই পুস্তকে, টিভি সিরিয়ালে, চলচ্চিত্রে কখনো তাদের রবিনহুড আবার কখনো অতি নিষ্ঠুর রুচিবোধহীন অধঃপতিত অপরাধী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। ওদের প্রকৃত পরিচয় জানতে সেনসেইকে জিগ্যেস করি, জিগ্যেস করি হোস্টকে। সবারই নেতিবাচক ধারণা। সাধারণ মানুষ এ আলোচনাকে এড়িয়ে চলে। এদের নাকি গুরুর প্রতি আনুগত্যের স্মারক হিসেবে অনেকের কনে আঙ্গুল কাটা। এরা কালো চশমা পড়ে, কালো গাড়ীতে চলাফেরা করে। রাস্তা দিয়ে যেতে কালো চশমা পড়া কোন জাপানিজকে দেখলেই ভীত বিহ্বল হয়ে দেখি আঙ্গুল কাটা আছে কিনা।

বিদায়ের দিন যতো ঘনিয়ে আসে ততোই পড়ালেখার চেয়ে ভ্রমণের কার্যক্রম বেড়ে যায়। আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় জাপানের সমৃদ্ধ অতীত ইতিহাসের শহর কিয়টোতে। অপরূপ সৌন্দর্যের শহর এই কিওটো। টোকিওতে রাজধানী স্থানান্তরিত হবার আগে প্রায় ১০০০ বছর কিওটোই ছিল রাজধানী শহর। এই শহরে প্রাচীন এবং আধুনিক স্থাপত্য কলা পাশাপাশি বাস করে। যুদ্ধ বিগ্রহের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে অক্ষত এই শহর পর্যটকদের অভিবাদন জানায় তার বিচিত্র ঐশ্বর্য দিয়ে। বৌদ্ধ মন্দির, সিন্তো মন্দির, নয়নাভিরাম রাজপ্রাসাদ, রাজ উদ্যান, পথের ধারের পুস্প পল্লোবীত নাম না জানা বৃক্ষরাজির এক যাদুকরী আকর্ষণে এই শহরে হাজির হয় হাজার হাজার মানুষ। আমরা হাটতে হাটতে হারিয়ে যাই সুদূর অতীতে। ভাবতে শিহরিত হই এককালে এই জনপদ ধরে প্রবল দাপটে ঘোড়া ছুটিয়ে চলতো সামুরাই (যোদ্ধা বংশভূত) , সোগুন (সামরিক শাসক) সহ কতো রাজন্যবর্গ।

যাত্রা পথে চোখে পড়ে সুন্দর রঙ্গিন টাইলসের কিছু ট্র্যাডিশনাল বাড়ী। সেনশি দূর থেকে আমাদের পরিচয় করে দেন গেইসা তথা গেইসা হাউজের সাথে। এই গেইসা হাউসে প্রশিক্ষণ পায় কমবয়সী তরুণীরা। তারা দীর্ঘ সময় গভীর অভিনিবেশ সহকারে শিক্ষা নেয় নৃত্য, গীত ও আলাপচারিতার কলাকৌশল । সবার কাছে এরা পরিচিত ইন্টারটেইনার হিসেবে। ভাবতে অবাক লাগে তাদের এই শিক্ষা শুধু অর্থের বিনিময়ে নৃত্যের ঝঙ্কারে, সংগীতের মূর্ছনায় বিত্তবান পুরুষদের বিনোদন দেওয়া। জাপান এখনো মেয়েদের প্রকৃত মর্যাদা দিতে পারেনি। গেইসা তথা গেইসা হাউজ এরি ধারাবাহিকতা।

আমাদের বাস এসে থামে একটা কাবুকি থেয়েটার হাউজের সামনে। ভেতর থেকে ভেসে আসে অদ্ভুত কিছু কণ্ঠ হতে উদগীরিত অদ্ভুত সব পংক্তিমালা। যার মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝি না। কতকগুলো পুরুষ সামুরাই পোশাক পড়ে, মুখে সাদা কালো লাল রঙ মেখে বিচিত্র ভঙ্গীতে অভিনয় করে যাচ্ছে। কখনো উচ্চ গলায় কখনো অত্যন্ত নম্র গলায় একই সাথে কখনো পুরুষ কখনো মেয়ের অভিনয় করে যাচ্ছে। পরে জানতে পেরেছি কাবুকীর বিবর্তনের ইতিহাস। অতীত নগ্নতার কলঙ্ক মুছে ফেলে কেমন করে কাবুকি আজ ট্র্যাডিশনাল ও সমসাময়িক সংস্কৃতির মধ্যে মিল বন্ধন ঘটিয়েছে তার ইতিহাস, কেমন করে কাবুকী আজ শুধু পুরুষ নিয়ন্ত্রিত তার ইতিহাস।

এবার আমাদের ফিরে আসার পালা। দু’ধার মোজাইকে বাধানো এক শীর্ণ কায়া নদীর ধার ঘেঁষে আমাদের বাস ছুটে চলেছে। ক্যাসেটে বেজে চলেছে মিসরো হিবারীর কিন্নরী কণ্ঠের সেই জনপ্রিয় গান – কাওয়া নো নাগারে নো ইওনি…। যতো বার শুনি এই গান, ততবারেই ফিরে যাই আমি আমার আপন ঠিকানায়,
aa kawa no nagare no you ni, odayaka ni kono mi wo makasete itai
aa kawa no nagare no you ni, itsumademo aoi seseragi wo kikinagara
……
( আহ, নদীর ঐ প্রবহমানতার সাথে আমি নীরবে চলে যেতে চাই
আহ, নদীর সেই সতত প্রবাহে ফেনায়িত জলের শব্দ শুনতে শুনতে আমি চলে যেতে চাই…)

ভাঙলো, ভাঙলো মিলন মেলা, ভাঙলো। এবার আমাদের নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরার পালা। শ্রীনিভাসন চলে গেছে। চলে গেছে কেওড়া সান। মাধবকে বিদায় দিয়ে ফিরে আসার পথে মনটা অসীম শূন্যতায় ভরে যায়। কি যেন নেই, কি যেন নেই। এক সময়ের প্রানচান্চল্যে মুখরিত ডর্মটাকে প্রেতপুরি বলে মনে হয়। রাত পোহালে আমরাও চলে যাবো। মিজান টোকিওর পথে আর আমি যাবো সেতো নাইকাই ( seto island sea) পার হয়ে সুউচ্চ পাহাড়ের পর মাথা তুলে আকাশের পানে চেয়ে থাকা অযুত নিযুত পাইন বৃক্ষ দিয়ে পরিবেষ্টিত সবুজ শহর মাৎসুইয়ামাতে।

স্থলপথের চেয়ে জলপথ আমায় অধিক টানে। জাপানের দ্বীপ দিয়ে ঘেরা সমুদ্রের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের বর্ননা শুনেছি লোকমুখে। আজ এলো সেই মহেন্দ্র ক্ষণ। সন্ধ্যার পড়ন্ত সূর্য সেত নাইকাই এর নিলাভ জলরাশিকে রাঙিয়ে তুলেছে। নিলাভ জলরাশির মাঝে ধ্যানমগ্ন ঋষির মতো দাঁড়িয়ে আছে ছোট ছোট অসংখ্য মায়াবী পর্বতমালা । আমাদের ফেরী যাবে ঐ সব পর্বতের গা ঘেঁষে। আমি ফেরীর ধার ঘেঁষে দাড়িয়ে আছি। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলবিন্দু আমায় ভিজিয়ে দিয়ে যায়। স্নিগ্ধ সতেজ বাতাস সাগর থেকে নিয়ে আসে একটা জলজ গন্ধ।

আমার পাশে দাড়িয়ে আছে এক জাপানী যুবক। ওর পিতৃভূমি মাৎসুইয়ামা। কথায় কথায় অনেক কিছু হয় জানা। ও আমাকে বুঝিয়ে যায় এ সেতো নাইকাই এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব। জাপানের চারটি ভূখন্ডের মূল তিনটি ভূখন্ড হনসু, কিউসু ও সিকুকুকে সংযোগ করেছে এ বিশাল জলরাশী। ও আমার দেশ সম্পর্কে জানতে চায়। জানতে চায় সমাজ ও পরিবার সম্পর্কে। আমি আমার দেশের পারিবারিক সুদৃঢ় বন্ধনের কথা বলি, কথা বলি পিতা পুত্রের সম্পর্ক নিয়ে। কথা বলি বাবা মার প্রতি আমাদের দায়িত্ব নিয়ে। একান্নবর্তী পরিবারের উষ্ণতা ওকে আলোড়িত করে। বৃদ্ধ বয়সে বাবা মাকে সেবার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের নৈকট্য লাভের সংস্কৃতি ওকে নাড়া দেয়। ও একই শহরে চাকুরী করে; অথচ বাস করে বাবা মা থেকে দূরে। কালে ভদ্রে বাবা মার সাথে দেখা করতে যায়। ও যখনি অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন হয়েছে তখনি ঘর ছেড়েছে। জাপানীজ তথা পশ্চিমা দুনিয়ার এই তো রীতি। ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অকপটে বলে ফেলে আমরা এমন কেন?

ভোর হয়ে গেছে। অদূরে মাৎসুইয়ামা পোর্ট। মাইকে ঘোষনা হচ্ছে কোনো ফেরি ওয়া মামুনাকু তোচাকু শিমাস ( ফেরী অনতিবিলম্বে গন্তব্যে পৌছবে ) .. শিবারাকু ও মাচি শিত্তে কুদাসাই মাছে ( সম্মানীয় যাত্রীগণ একটু অপেক্ষা করুন), ওয়াসুরে মনো নাই ইউনি গো চু ই শিত্তে কুদাশাই ( নিজের জিনিষপত্র নিতে ভুলবেন না)। আমি অনেক না ভোলা স্মৃতি নিয়ে পা রাখি মাৎসুইয়ামার মাটিতে। ফেরীর কর্মীরা মাথা নিচু করে অভিবাদন জানায়। মুখে বলে ইওকসো মাৎসুয়ামা নি ( মাৎসুইয়ামাতে সুস্বাগতম)।

সুন্দর এক ছিমছাম শহর এই মাৎসুইয়ামা। টোকিও ওসাকার মতো নাগরীক জটীলতা এখানকার মানুষজনকে তেমন স্পর্শ করেনি। এরা এদের চিরন্তন আতিথেয়তা দিয়ে আমাদের মতো বিদেশী শিক্ষার্থীদের বরন করে নেয়। কোন প্রয়োজনে এরা পরিমরি করে ঝাপিয়ে পড়ে। আমার নতুন বাসস্থানের অনতিদূরে স্থানীয় কৃষি পন্যের বাজার। বড় বড় বাধাকপি, বিশাল আকৃতির মূলো ওরা আমায় যৎসামান্য মূল্যে দিয়ে দেয়। আর কথায় বলে সেই কাৎসু গা তাইহেন নে ( জীবন বড় কঠিন) ! মাছের বাজারে হরেক রকম সামুদ্রিক মাছ। এরা আমাদের মতো তেলে ঝোলো মাছ খায় না। সবচেয়ে তাজা সতেজ মাছটা ওরা খায় কাচা। মরে যাওয়া মাছের কদর অনেকটা কম। তাই আমাদের খুব কম মূল্যে দিয়ে দেয়। জীবন্ত কাকড়া ও সামুদ্রিক ঢাউস আকৃতির চিংড়ি এখানে মহার্ঘ। দেখে বিস্মিত হই যখন দেখি কেউ পটাৎ করে জীবন্ত কাকড়ার ঠ্যাং ভেঙ্গে মুখে দিয়ে এর স্বাদ পরীক্ষা করে।

আমি যে দ্বীপে এসেছি এর নাম শিককু। জাপান তার সমস্ত ভুখন্ডকে 47 টি প্রশাসনিক অন্চলে ভাগ করেছে। এহিমে হলো এমনি একটা প্রশাসনিক অন্চল যার রাজধানী হলো মাৎসুইয়ামা। এই মাৎসুইয়ামাতে রয়েছে আমার বিদ্যাপিঠ এহিমে ইউনিভার্সিটি, এখানে রয়েছে জাপানের অন্যতম উষ্ণ প্রস্রবন যেখানে ঢুকতে হয় নগ্ন হয়ে। প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটকের আনাগোনা। আশপাশ দিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। নগ্ন হবার মতো রুচী ও সাহস না থাকায় জাপানীজ সতীর্থদের কাছে অপাংতেয় হয়েছি কতোবার।

প্রফেসরের সাথে আমার গবেষনার বিষয়বস্তু নিয়ে আজ আনুষ্ঠানিক আলোচনা। এর আগে বেশ কয়েকটি বৈঠক হয়ে গেছে। আমি ইতিমধ্যে ইউনিভার্সিটি ভাগার থেকে একটা সুন্দর সাইকেল কুড়িয়ে পেয়েছি। ওটা দিয়েই চলাফেরা করি। জাপানে তেমন কিছুই কিনতে হয় না। ঘরের সমস্ত আসবাবপত্র রাস্তার ধারেই পাওয়া যায়। জাপানীজরা মানষিক চাপ থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য অনেক অপ্রয়োজনীয় মহার্ঘ জিনিষ কিনে অব্যবহৃত অবস্থায় ফেলে দেয়।

আমার শেনশেই এর সাথে বৈঠক দুপুর একটায়। আমি চিকামিচি (সর্টকার্ট পথ) খুজতে যেয়ে পথ হারিয়ে ফেলি। পাচ মিনিট বিলম্বে হন্তদন্ত হয়ে সেনসেই রুমে ঠুকে সবিনয়ে ক্ষমা চেয়ে নেই। সেনসেই নিরবে রুম থেকে বেড় হয়ে যান। আমি অসহায় হোয়ে তাকিয়ে আছি। সেনসেই এর সেক্রেটারি আমায় একটা কাগজ ধরিয়ে দেন। কাগজে লেখা রাইসু গেৎসুইউবি ইচি যি ( আগামী সোমবার একটা) । পাচ মিনিটের বিলম্ব আমার জীবনে এক ভারী ছাপ রেখে যায় । এখনো কোন বাংগালী প্রোগ্রামে নিমন্ত্রণ পেলে সবার আগে পৌছে যাই। কখনো কখনো ঘন্টা দুয়েক অপেক্ষা করেও যখন কারোর দেখা পাইনা তখন মনে হয় – কোন ভুল হয়নি তো!

চলবে…
জাপানের যাপিত জীবন – ৫ | সুশীল কুমার পোদ্দার  ,  ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।
লেখকের স্মৃতিচারণের অন্যান্য পর্বগুলি দেখতে হলে 
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ১ |  যুদ্ধের স্মৃতি কথা ২ |  যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৩ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৪ |  যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৫ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৬ |  যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৭ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৮ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৯ |
স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ১ | স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ২ | স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ৩ | স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ৪ | ,
জাপানের যাপিত জীবন – ১ |জাপানের যাপিত জীবন – ২ জাপানের যাপিত জীবন – ৩ | জাপানের যাপিত জীবন – ৪ |

সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন