ফিচার্ড লেখালেখি

রাজমুকুট | হুসেইন ফজলুল বারী

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ

রাজমুকুট | হুসেইন ফজলুল বারী

এক ঝকঝকে অপরাহ্ণে বৃত্তির কাগজসহ সদ্যকেনা সুটকেস, উৎসুক মন আর একরাশ ক্লান্তি নিয়ে হিথ্রো এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম। নির্বিঘ্নে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন হওয়ার পর ব্রিটিশ কাউন্সিলের এক কৃষ্ণবর্ণ কর্মকর্তা গম্ভীর হয়ে বাম হাতে খসখস করে কি যেন লিখলেন।  এরপর আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন বেশ কিছু পাউন্ড। লন্ডনে থিতু হওয়ার প্রাথমিক ভাতা।  ভদ্রলোক শুভাশীষ জানিয়ে বিদায় নিলে চকচকে নোটগুলি শুঁকে ভাবলাম, এই প্রৌঢ় ব্যাটার বদলে নীলাভ চোখের এক স্বর্ণকেশী তরুণী এলে কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? মনটা কিছুটা খারাপই হয়ে গেল! আবার খামোখাই চোখ রাখলাম সেই কাগুজে মুদ্রায়।  সেখানে অঙ্কিত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথই হলেন প্রথম ব্রিটিশ মেম যিনি পাতলা ঠোঁটে স্মিতহেসে আমাকে বিলেতে সাদর সম্ভাষণ জানিয়েছিলেন। হোক না কাগুজে মুদ্রিত, প্রথম দর্শনের ভালোবাসা বলে একটা কথা আছে না! হার এক্সেলেন্সি কুইনকে কুর্নিশ করে বিমানবন্দরের বাইরে পা বাড়ালাম। 

লন্ডনে এসে প্রথম কয়দিন শুয়ে-বসে কাটালাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগদানের পর পয়লা সুযোগেই বাকিংহাম প্যালেস এলাকায় ঘুরতে গেলাম। রাজকীয় এই প্রাসাদটিই রানি এলিজাবেথের আবাসস্থল ও কর্মস্থল। আমার সহযাত্রী ও গাইড ব্রিটিশ সহপাঠী এমি। রৌদ্র-ঝলসিত সুবর্ণরঙা গেট দিয়ে অকুস্থলে প্রবেশ করতে গিয়ে দেখি শালপ্রাংশু প্রহরীরা ঠায় দাঁড়িয়ে। তাদের শিরে কালো কুচকুচে বেঢপ টুপি, পরনে টাটকা লাল কোট আর কালো ট্রাউজার্স। মসৃণ রাজপ্রাঙ্গণের দ্বার ঘেঁষে ছোপ ছোপ হলদেটে-সবুজের প্লাবন আর বর্ণাঢ্য ফুলের নকশা। ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জীর্ণ পাতার স্তুপ আমার জুতোর নিচে মচমচ করে উঠল।  বসন্ত এখন কিছুটা ম্রিয়মানই। আশেপাশে বেশ কয়েকটা পাথুরে ভাস্কর্যও চোখে পড়ল। ধূসর কাঠবিড়ালি দম্পতি বুড়ো গাছের গা বেয়ে দৌড়ে পালালে ভাস্কর্যরূপী এমি জানাল, ব্রিটিশ রাজের বেশ কিছু মজার ক্ষমতার কথা। ১৩২৪ সালের এক রাজকীয় ফরমানবলে গ্রেট ব্রিটেনের সকল কাঠবিড়ালি, স্টার্জন মাছ, ডলফিন আর রাজহাঁসের মালিক রানি। আবার দৃষ্টি মেলে দেখি, মূল প্রাসাদের মস্তক ছুঁয়ে বর্ণিল রঙধনু ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্তের কোলে। আমার অনুসন্ধিৎসু প্রশ্নে ব্রিটিশ তন্বী রাঙা ওষ্ঠের হাশিয়ায় হাসি এঁকে এক টুকরো জবাব দেয়, মহামান্য রানি এলিজাবেথই ব্রিটিশ সার্বভৌমত্বের প্রতীক।

অবশ্য আইনের ছাত্র হিসেবে আমিও জানি, একসময় অবাধ ক্ষমতা থাকলেও ইংল্যান্ডের ক্ষয়িষ্ণু রাজতন্ত্র বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে মূলত আলঙ্কারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তবু সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে রানির মর্যাদা কী নিছক সম্মানসূচকই? এমি জবাব দেয় এভাবে, সরকািরি কাজের সবকিছু এখনও রানির নামেই সম্পাদিত হয়। সরকার বা বিভিন্ন দফতরের পরিচিতিও তাঁর নামে। যেমন হার ম্যাজেস্ট্রিজ সরকার। এদেশে লিখিত সংবিধান নেই। তবে ব্রিটেনের পার্লামেন্টে পাশ হওয়া বিল আইনে পরিণত হতে রানির সম্মতি আবশ্যক। রানির বিরুদ্ধে কোনো আদালতে কোনো অভিযোগ উত্থাপন করা যায় না।  রানির দায়িত্বপালন মূলত বিভিন্ন প্রথা আর আনুষ্ঠানিকতার নিগড়ে বাধা। রাষ্ট্রীয় আচারে তাঁর অবস্থান সবার শীর্ষে। মোটাদাগে এটা বলা হয়ে থাকে যে,  রানি শুধু রাজত্ব করেন, কিন্তু শাসন করেন না। যুক্তরাজ্য ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ডসহ পনেরটি দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক তিনি। এছাড়াও সাবেক উপনিবেশসমূহ নিয়ে গড়া কমনওয়েলথের প্রধান হচ্ছেন রানী।

আজ রাজপ্রাসাদের বহিরাঙ্গনে পর্যটকদের আনাগোনা একটু বেশিই।  বৈকালিক ভ্রমণরত কয়েকজন নিঃসঙ্গ শ্বেতাঙ্গ মানুষের  হাতে শৃঙ্খলিত কুকুর।  প্রসঙ্গত বলে রাখি, পশুপাখির প্রতি বিলেতবাসিদের গভীর অনুরাগ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। অনিন্দ্যসুন্দর সবুজ উদ্যানে বেড়াতে গেলে  কাঠবিড়ালির ভীরু সঞ্চরণ, জলাশয়ে ভেসে বেড়ানো নিঃশঙ্ক রাজহংসের বিচরণ, মুক্ত কপোতের মধুর বকবক বা প্রশিক্ষিত কুকুরের পথচলা আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই।  হাঁটতে-চলতে, পার্কে-দোকানে, পথে-ঘাটে কতো বিচিত্র প্রজাতির পোষা সারমেয় যে দেখেছি- ছোট্ট পুতুলের মতো, চিতার মতো, দীর্ঘ কেশরযুক্ত, মুখবোঁচা, গম্ভীর সাহেবের মতো। গলাবন্ধ আর জামাপরা স্বাস্থ্যবান প্রভুভক্ত জীবগুলো মুনিবের সুখ-দুঃখের সাথি। এদের নামগুলিও সংক্ষিপ্ত, তবে মাধুর্যময়। মিষ্টিনাম ধরে ডাকলে  বা একটু আদর পেলে এরা কুইকুই করে উঠে। বয়স্কদের কোলে মাঝে মাঝে আদুরে বিড়ালও চোখে পড়ে। কুকুর-বিড়ালের পুরীষ টিস্যু পেপারে মুড়ে কোনো পরিপাটি ভদ্রলোক বা নারী নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলছেন, এটা এখানকার খুবই স্বাভাবিক  দৃশ্য। প্রত্যেক সুপারশপে এদের জন্য খাবার বা  শ্যাম্পু এসব থাকেই। অসুস্থ প্রাণীর জন্য রয়েছে ওষুধ, ভিটামিন আর পৃথক হসপিটাল। নিঃসঙ্গ মালকিন মৃত্যুর আগে প্রিয় পোষা কুকুরকে সব সম্পত্তি উইল করে গেছেন এরূপ সংবাদও ট্যাবলয়েড পত্রিকায় সম্প্রতি দেখা গেছে। পোষা-প্রাণীর জন্য বিনোদনের জন্য ডেডিকেটেড টিভি প্রোগ্রাম পর্যন্ত রয়েছে শুনে তাজ্জব বনে  গেছি। কুকুর-বিড়ালের রিয়েলটি শো তো ব্রিটেনসহ পশ্চিমা বিশ্বে এখন তুমুল জনপ্রিয় প্রোগ্রাম।  কোনো পোষা-প্রাণীর জন্মদিনের দাওয়াত এখনও পাইনি, তবে কুকুরছানার সাবালকত্ব অর্জন নিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানের ছাপানো আমন্ত্রণপত্র আমি নিজ চর্মচোখে দেখেছি। বিলেতে এসেই জানলাম, কুকুরের সাবালকত্ব প্রাপ্তির নিদর্শন হলো পা তুলে প্রস্রাব করা!

পশুপাখির প্রতি অনুরাগের ক্ষেত্রে রানিও পিছিয়ে নেই, বরং তিনি বেশ অগ্রগামীই। তার ঘোড়াপ্রীতির কথা সর্বজনবিদিত। এলিজাবেথ ঘোড়সওয়ারি হয়ে প্রাসাদ চত্বরে ঘুরতে খুব ভালবাসতেন। বছর দুয়েক আগেও স্কার্ফপরা বর্ষীয়ান রানিকে ঘোড়ার পিঠে বেশ আত্মপ্রত্যয়ীরূপেই দেখা গেছে। রাজপরিবারে হর্সকিপার পদবীতে একজন লোকের নেতৃত্বে বিশাল বাহিনী উঁচু সম্মানিতে নিয়োজিত  থাকেন। তাদের মূল কাজ রাজ-আস্তাবল দেখাশুনাসহ রাজপরিবারের সদস্যদেরকে অশ্বচালনায় সহযোগিতা করা। কয়েক দশক আগে এরূপ এক রিসালদারের রয়্যাল ডিউটির আড়ালে ভিন্ন কিছু করার গুঞ্জন উঠেছিল। তবে রাজপরিবারের অনেক সদস্য ব্যক্তিগত জীবনে অজস্র বিতর্ক বা স্ক্যাণ্ডালে জড়ালেও ক্লিন ইমেজের রানি এরূপ কালিমা থেকে একেবারেই মুক্ত। এখনও নিত্যসঙ্গী সারমেয়কুলের সাথে হার এক্সেলেন্সি কুইনের বেশ সৌহার্দ্য। রাজকুমারি সাত বছর বয়স থেকে বামন প্রজাতির একধরনের কুকুর পুষতেন।

জেনে অবাক হলাম, হার ম্যাজিস্টি কুইন বিনা পাসপোর্টে তামাম দুনিয়া ঘুরে বেড়াতে পারেন। দেশভ্রমণেও তার খুব শখ। অভিষেকের পর টানা ছয়মাস তার বিভিন্ন ডোমিনিয়নে ঘুরেছেন। সারা বিশ্বের যেখানেই গেছেন মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন। প্রসঙ্গত, ১৯৬১ সালে রানি বাংলাদেশ ভ্রমণে এসে আমাদের আদমজি জুটমিল ঘুরে দেখেছেন, ঢাকা-চট্টগ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এ দেশের নৌভ্রমণে বিমলানন্দ উপভোগ করেছেন বলে নিজেই জানিয়েছেন। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের দিল্লি সামিট-এ যাওয়ার পথে ১৯৮৩ সালেও আরও একবার বাংলাদেশে এসেছেন। সে-সময় দুইদিন ঢাকায় থেকে বেশ কিছু জনহিতকর কাজের উদ্বোধন করেছেন তিনি। মজার ব্যাপার হলো, এলিজাবেথের ক্ষমতায় আরোহণের সময় আমরা কিন্তু তার অধীনস্ত ছিলাম। কারণ ১৯৪৭ সালে এ অঞ্চল ঔপনিবেশিকতার নিগড় থেকে মুক্ত হলেও ১৯৫৬ সালের সংবিধান প্রণয়নের আগ পর্যন্ত পাকিস্তান টেকনিক্যালি ও লিগ্যালি ব্রিটিশ রানির অধীনেই ছিল। ১৯৫৩ সালে রানির আনুষ্ঠানিক অভিষেকের দীর্ঘ গাউনেও কিন্তু রানির ইচ্ছে অনুযায়ী অনান্য ডোমিনিয়নের প্রতীক বা চিহ্নের সাথে বাংলাদেশের পাটের কুঁড়ির আলপনা এমব্রয়ডারি করা হয়েছিল।

আজ প্রাসাদ এলাকায় নিরাপত্তা তল্লাশির কিছুটা কড়াকড়ি। কিছুদিন পর রানির জন্মদিন। এবার আমার একদম লাজওয়াব হবার পালা যখন এমির কাছেই শুনলাম কুইনের জন্মদিন দুটি! বাংলাদেশে এরূপ দৃষ্টান্ত ঢের আছে, কিন্তু খোদ ব্রিটিশ রানির জন্মদিনে গড়মিল?  এ যে আষাঢ়ে গল্প! ব্রিটিশ যুবতী হেসে বলল, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিলের তারিখ জন্মগ্রহণ করলেও বৈরী শীত এড়িয়ে ফি বছর জুনের দ্বিতীয় শনিবারে বসন্তের ঝলমলে আবহাওয়ায় এ দিবসটি বেশ জাঁকজমক করে পালন করা হয়। রানির এই আরোপিত জন্মদিনই আবার ব্রিটেনের জাতীয় দিবস। ব্রিটিশ রাজমুকুট রানি এলিজাবেথের শিরেই সবচেয়ে বেশি সময় ধরে জ্বলজ্বল করছে। ক্রাউন আর রানি আজ সমার্থক। আর মাত্র কয়েকটি বছর। শতবর্ষী মায়ের জিন, সুষম খাদ্যাভ্যাস, কঠোর নিয়মানুবর্তিতা, উন্নত জীবনযাপন আর মানুষের ভালোবাসায় হে মহামতি আপনি সুস্বাস্থ্য নিয়ে শতায়ু হোন।

লেখক : যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক কথাশিল্পী


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন