জীবন ও স্বাস্থ্য

বাংলাদেশে দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট |||| ড.  শোয়েব সাঈদ

বাংলাদেশে দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট |||| ড.  শোয়েব সাঈদ

মাস তিনেক আগে কলাম লিখে সতর্ক করেছিলাম যে দক্ষিণ আফ্রিকাতে পাওয়া মিউটেশন E484K এর ভ্যারিয়েন্ট এবং ব্রাজিলে পাওয়া আরেকটি ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে উদ্বিগ্ন বিজ্ঞানীরা, বিপদ সামনে। পিয়ার রিভিউড পাবলিকেশন তখনো আসেনি, তবে গবেষণা তথ্যে জানা গিয়েছিল E484K মিউটেশনটির নিউট্রালাইজিং এন্টিবডিকে ফাঁকি দেবার প্রবণতা থাকতে পারে। নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি হচ্ছে সেই এন্টিবডি যা ভাইরাসকে সরাসরি আক্রমণ করে ধ্বংস করে। টিকা নিয়ে বিশ্বব্যাপী দৌড়-যাপের মধ্যে নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি অর্থাৎ টিকা ফাঁকি দেবার মিউটেশন দুশ্চিন্তার কারণ তো বটেই।

অতি সংক্রামক কিন্তু টিকার জালে নিষ্ক্রিয় হওয়া ইউকে ভ্যারিয়েন্ট নিয়েও কলাম লিখেছি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মূল ভয়টা ছিল এই ইউকে ভ্যারিয়েন্টকে নিয়ে। কিন্তু ভ্যাকসিন ফাঁকি দেবার দক্ষিণ আফ্রিকার সেই বেয়াদব মিউটেশনটি বাংলাদেশকে গ্রাস করতে উদ্যত হবে এতদূর ভাবনার অবকাশ হয়তো আমাদের ছিলনা। বার বার বলেছি পশ্চিমাদের তুলনায় বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলোতে করোনা ঠেকাও অভিযান ছিল খুব ঢিলেঢালা, অনেকটা গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতারের মত, ফলাফল দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বাংলাদেশে সহজেই হিজরত এবং ব্রিটিশদের আগেই উপনিবেশ বানানো।

করোনাকাল আমাদের প্রাণবিজ্ঞানের অনেক কঠিন শব্দ শিখিয়েছে। মিউটেশন বা পরিবর্তন ভাইরাসের জন্যে প্রতিনিয়ত ঘটা সাধারণ ধর্ম। অনেকগুলো মিউটেশনের ফলে একটি ভাইরাস স্ট্রেইনে কিছুটা ভিন্ন ধরণের জেনেটিক লাইনের উদ্ভব হয় যাকে ঐ স্ট্রেইনটির নতুন ভ্যারিয়েন্ট বলা হয়। ভাইরাস পোষক কোষে যেমন কোভিড ভাইরাস আমাদের দেহের কোষে প্রবেশ করে নিজেদের অসংখ্য কপি তৈরি করে। ক্রমাগত কপি করতে গিয়ে ভাইরাসের আরএনএতে কিছুটা ভুলভ্রান্তি বা ত্রুটি ঘটে থাকে যাকে আমরা মিউটেশন বলি।

প্রাণীর গাঠনিক উপাদান প্রোটিন বা আমিষের সাথে আমরা সবাই পরিচিত। এক একটি ইট দিয়ে যেমন দালান তৈরি হয় তেমনি মূলত ২০ ধরণের এমাইনো এসিডের একের পর এক গাঠনিক বিন্যাসে প্রোটিন তৈরি হয়। এমাইনো এসিডগুলোর এক অক্ষর এবং তিন অক্ষরের কোড থাকে, মিউটেশনের বিন্যাস বুঝাতে এক অক্ষরের কোড ব্যবহার করা হয়।

ভাইরাসের গঠনতো মানুষের মত জটিল নয়, বরং গাঠনিকভাবে সবচেয়ে সহজ সরল ফলে বিন্যাস হিসেব করতেও সুবিধে।

মিউটেশন E484K এর অর্থ হচ্ছে চীন থেকে বের হওয়া কোভিড ভাইরাসটির জেনেটিক বিন্যাসে স্পাইক প্রোটিনের ৪৮৪ নম্বরে ছিল E কোডের এমাইনো এসিড গ্লুটামেট। কপিজনিত ত্রুটির ফলে অর্থাৎ মিউটেশন হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টে ঐ ৪৮৪ নম্বর বিন্যাসে গ্লুটামেটের জায়গাটি নিয়ে নিল অন্য আরেকটি এমাইনো এসিড লাইসিন যার কোড হচ্ছে K।

ব্রিটিশ ভ্যারিয়েন্ট B117 এর N501Y মিউটেশনটি অধিক সংক্রমণের জন্যে দায়ী। এখানে ৫০১ নম্বর বিন্যাসের এস্পারাজিন এমাইনো এসিড(N)কে সরিয়ে দিয়েছে টাইরোসিন (Y)।

মিউটেশনের এই খেলায় ভাগ্য ভাল হলে আগ্রাসী না হয়ে ভাইরাস অকেজো বা বিলুপ্ত হয়ে যায়। কোভিড সংকটে আমাদের বেশ ভুগতে হচ্ছে। এখন দেখা যাচ্ছে ভ্যারিয়েন্টের আধিক্যে মূল ভাইরাসটি বিলুপ্ত হবার পথে।

দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টটির মূল শয়তানি হচ্ছে E484K মিউটেশন যা ভ্যাকসিনকে ফাঁকি দেয়। এই বিষয়ে লেখার আগে আমি বেশ কিছু সাম্প্রতিক প্রকাশিত এই সংক্রান্ত গবেষণা প্রবন্ধ ঘেঁটেছি।

সংক্রমণের মাধ্যমে বা টিকাদানের মাধ্যমে আমাদের শরীরে উৎপন্ন নিউট্রালাইজিং এন্টিবডিকে দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট বি১.৩৫১ আংশিকভাবে এড়িয়ে যেতে পারে। উহান থেকে ছড়িয়ে যাওয়া আসল ভাইরাসকে নিস্ক্রিয় করা ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনের সফলতা ভ্যারিয়েন্ট বি১.৩৫১ কে নিস্ক্রিয় করার সফলতার চেয়ে ৭ ফোল্ড বেশী।

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে এই ফাঁকি দেবার ঘটনা আমাদের দেশের কোভিশিল্ড হিসেবে পরিচিত এসট্রাজেনেকার ক্ষেত্রে শুধু নয় , ফাইজার, মর্ডানা এমনকি স্পুটনিকের ক্ষেত্রেও ঘটছে। তবে ফাইজার, মর্ডানার ক্ষেত্রে এই ভ্যারিয়েন্টটির ফাঁকি দেবার পরিমান অনেক কম।

এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৯৫% ইনফেকশন কিন্তু এই ভ্যারিয়েন্ট বি১.৩৫১ দ্বারা। দক্ষিণ আফ্রিকার সাম্প্রতিক করোনা পরিস্থিতির গ্রাফিক্যাল উপস্থাপনা দেখলে দেখবেন বিগত কয়েক মাসের তুলনায় কেমন করে গ্রাফ ক্রমান্বয়ে বেশ নীচে নেমে আসছে, পরিস্থিতি অনেক নিয়ন্ত্রণে।

ভ্যারিয়েন্ট যতই আগ্রাসী হোক না কেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে কোভিড নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব কঠিন নয়, জাপান অস্ট্রেলিয়া তার অন্যতম উদাহরণ।

বাংলাদেশে দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের আধিক্যের কারণে যে সমস্ত অভিবাসী বাংলাদেশীদের ফাইজার, মডার্নার ভ্যাকসিন নেবার সুযোগ আছে বাংলাদেশে ভ্রমণের আগে সেই ভ্যাকসিন ডোজ শেষ করে যাওয়াই ভাল। বেয়াদপ ভ্যারিয়েন্টের কবলে পড়লে হয়তো সংক্রমিত হবেন, ভোগান্তি হবে, কিন্তু এসট্রাজেনেকা সহ যে কোন ভ্যাকসিনই আপনাকে গুরুতর পরিণতির হাত থেকে রক্ষা করার সাহায্যটুকু করবে।

ডঃ  শোয়েব সাঈদ লেখকঃ কলামিস্ট এবং মাইক্রোবিয়াল বায়োটেকনোলজিস্ট। কানাডার একটি বহুজাতিক কর্পোরেটে  ডিরেক্টর পদে কর্মরত।   


সর্বশেষ সংবাদ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান
সংবাদটি শেয়ার করুন