ডিজিটাল আশা আকাঙ্ক্ষা ||| সুশীল কুমার পোদ্দার
ছেলেঃ এই , জানো?
মেয়েঃ আচ্ছা, না বললে কেমন করে জানবো বলি? যতো সব মুদ্রা দোষ ! কথা বলার আগেই এই জানো? এই জানো?
ছেলেঃ মানে, আমি না একটা খুব সুন্দর কবিতা লিখিছি- মধ্যবিত্তের বাজার সংস্কৃতি নিয়ে
মেয়েঃ তা কেমন করে বুঝলে – তোমার ওটা সুন্দর কবিতা। শুনেছি একটা ভালো কিছু সৃষ্টি করতে জীবনের শেষ অবধি কেটে যায়। জীবন সাহাহ্নে দাঁড়িয়ে কতো লেখক/কবিকে বলতে শুনেছি – আহা, যদি আরও একটু সময় পেতাম… তা হলে একটা সুন্দর কিছু সৃষ্টি করে যেতে পারতাম। যাক, বলে ফেল তোমার সুন্দর কবিতা।
ছেলেঃ তুমি আমার মুডটাই নষ্ট করে দিলে। জীবনে কবিতা শুনানোর মতো একটা শৈল্পিক মনও পেলাম না।
মেয়েঃ হু, আদিখ্যেতা না করে বলে ফেল
ছেলেঃ শুন মন দিয়ে –
আমি বাজারে গেলুম কিনবো মাছ, মাংস তরিতরকারি,
ফিরে এলাম কচুর শাঁক নিয়ে।
মেয়েঃ এইটা কোন কবিতা হোল? মাছ, মাংস তরিতরকারি, কচুর শাঁক!
ছেলেঃ কেন নয়। কচুর শাঁক গরীবের খাবার বলে, এর কি কোন শৈল্পিক মূল্য নেই? বড় ক্ষেদ হয়- সারাজীবন কতো কবিতা নিয়ে ভেবেছি, লিখার চেষ্টা করেছি, কিন্তু তোমাদের মতো বেরসিক, অসমঝদার মানুষের তিরস্কার শুনতে শুনতে কতবার আমার প্রতিভার অপমৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু না, আর নয়। জানো?
মেয়েঃ আবারো জানো? সকাল থেকে বলছি বাজার শূন্য, বাজারটা করে এসো। কিন্তু তা নয়। জানো জানো করে বেড়াচ্ছে।
ছেলেঃ শুন, ফেসবুকে না অচ্ছুত নামে একটা লেখক গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে। ওখানে আমাদের মতো অস্পর্শ্য আর অচ্ছুৎরা লেখালেখি করে। আমার লেখাটা ওখানে পোস্ট করেছি।
মেয়েঃ তা response কেমন পেলে? আজ কাল তো ভালো জিনিষের কদর নেই। শুধু হিংসা আর negative vibration । অর্থহীন posting এ like এর ছড়াছড়ি। নিচ্ছয়ই অনেকগুলো like পেয়েছ?
ছেলেঃ এখনো পাইনি, তবে আশা ছাড়ীনি, হয়তো পাবো। হয়তো, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব অত্যন্ত ব্যস্ত। সময় পায়নি লাইক দেবার। তবে একটা দারুণ ইন্সপিরাইং কমেন্ট পেয়েছি। একজন লিখেছে কি জান ? – আমার কবিতার মধ্যে নাকি যথেষ্ট রাজনৈতিক উপাদান রয়েছে যা দিয়ে নাকি একটা গণ আন্দোলন গড়ে তোলা যায়। ঠিক কিছুটা আরব বসন্তের মতো। সরকার কেমন করে আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের পুষ্টিহীন, মেধাহীন করার নীলনকশা আঁকছে – তা নাকি আমার কবিতার মাঝে মূর্তমান হয়ে উঠেছে।
মেয়েঃ বেশ ভালো। তাহলে, রাস্তায় নেমে পর তোমার কচুর শাঁকের আঁটি নিয়ে। কবি গুরু তো বলেইছেন – যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে
ছেলেঃ দেখ, তুমি বিদ্রূপ করবে না। আসলে তুমি কবিতাই বুঝ না ; তা না হলে গতবছর তোমার জন্ম দিনে কি এক অসাধারণ কবিতা লিখেছিলেম । এতটুকু মূল্যায়ন হয়নি।
মেয়েঃ আমার তো মনে নেই। নিচ্ছয়ই কোন কালীদাস মার্কা কবিতা হবে!
ছেলেঃ দেখ, আমি তো মহাকবি কালীদাস হতে পারবো না। তবে এক অসাধারন scientific প্রেমের কবিতা –
তোমাকে ভালোবেসে আমি বিলিয়ে দিতে পারি সবকিছু
জলের দামে বিকিয়ে দিতে পারি আমার চাঁদের জমি, স্পেস স্টেশন,
শুধু তোমাকে পাবার জন্যে,
আমি অনন্তকাল ক্যাপসুল হয়ে ঘুরে বেড়াব তোমার কক্ষপথে।
মেয়েঃ থাম, কি অবাস্তব রে বাবা, চাঁদ, স্পেস স্টেশন, বিকিয়ে দেবে – যেন উনার বাপদাদার সম্পত্তি।
ছেলেঃ দেখ, বাপদাদাকে এর মধ্যে আনবে না। আমার ঠাকুর দাদা ছিলেন বিশিষ্ট অঙ্কবিদ – আয্যভট্টের ভাবশীষ্য। । শূন্যের রহস্য ভেদ করতে নে পেরে উনি আত্মহত্যা করেছিলেন। আর শুন, কবি সাহিত্যিকরা একটু আধটু বেহিসেবীই হয়। আমার কাজ হোল কবিতা লেখা। পাঠকের দায়িত্ব হোল নিজ দায়িত্বে বুঝে নেওয়া। বাদ দাও কবিতার কথা। আমি জানি কবিতা ও কবি তোমার অপছন্দের তালিকার শীর্ষে – তুমি তো প্লেটোরই ভাবশীষ্য। তোমাকে একটু রাগানোর জন্যে এতো বাগাড়ম্বর।
মেয়েঃ তাইতো, তুমি সংসারী মানুষ। একটু বাস্তবতায় ফিরে আসো। কবিতা দিয়ে কি পেট ভরে?
ছেলেঃ ধর, বাস্তবতায় ফিরে আসলাম।
মেয়েঃ আবারো মুদ্রাদোষ। কি ধরব আমি? আসল কথায় আসো।
ছেলেঃ sorry, আমি না পূজা উপলক্ষে তোমার জন্যে শাড়ী ও গহনার order দিয়েছি।
মেয়েঃ সত্যি ! মেঘ না চাইতেই জল! তা কোথায় order দিলে আমার সাথে পরামর্শ না করেই?
ছেলেঃ আমাজন, অনলাইনে। ওরা শীঘ্র drone এ তোমার শাড়ী ও গহনার kits পাঠিয়ে দেবে। সাথে পাঠাবে একটা বিশেষ ধরণের ছাতা।
মেয়েঃ মানে। কি বলছ তুমি? – শাড়ী, গহনার kits, সঙ্গে ছাতা !!
ছেলেঃ ডিজিটাল তো। দেখ, প্রযুক্তি কতো এগিয়ে গেছে। তোমরা আজও সেই প্রাচীন শাড়ী, গহনা নিয়ে পড়ে আছো। তোমাকে শুধু অনলাইনে একটা form fill up করতে হবে – সেখানে শাড়ীর রঙ, ডিজাইন, কখন কোন শাড়ী পড়বে তার schedule , তার সাথে মিলিয়ে কোন গহনা শরীরের কোন অংশে পড়বে তার লিস্টি। বাস, হয়ে গেল।
মেয়েঃ আর ছাতা?
ছেলেঃ ওটা হোল একটা বিশেষ ধরণের antenna cum projector। ওরা স্যাটেলাইট এর মাধ্যমে তোমাকে ট্রাক করে শাড়ী গহনার 3D holographic image data send করবে projector এর মাধ্যমে তোমার শরীরে ছড়িয়ে দেবার জন্যে।
মেয়েঃ তা ঐ ছাতাটা কোথায় থাকবে?
ছেলেঃ ওটা ঠিক তোমার মাথার উপরে
মেয়েঃ সে কি বিশ্রী ব্যাপার। আমি মাথায় ছাতা নিয়ে ঘুরবো?
ছেলেঃ ছাতা হলেও ওটা হবে বেশ fashionable. আর একটু সহ্য করে নেবে। নতুন টেকনোলজি তো। আস্তে আস্তে antenna দৈর্ঘ্য কমে কমে তোমার চুলের ক্লিপের মধ্যে ঢুঁকে পড়বে।
মেয়েঃ আমি কিন্তু নতুন শাড়ী গহনা পড়েই পূজা মণ্ডপে যাবো পূজা দেখতে
ছেলেঃ নিচ্ছয়ই যাবে। চুরি ডাকাতের ভয় নেই। তুমি নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াবে। যখন খুশী তখন সেল ফোনের বাটনে চাপ দিয়ে ডিজাইন চেঞ্জ করতে পারবে। খুশী তো?
মেয়েঃ সব ঠিক আছে তবে ঐ antenna ছাড়া। আচ্ছা, পূজা ঘনিয়ে আসছে তুমি তো এবার প্রতিমা order দিলে না !
ছেলেঃ কে বলেছে দিইনি। ওটাও order দিয়েছি। সব ডিজিটাল, সবি holographic। এ বিদেশের মাটিতে পূজা করা কি ঝামেলার ব্যাপার। বেলপাতা, আম্র পল্লব, দূর্বা ঘাস, কলা পাতা – এখন সব available। holographic computer screen এ হাত রাখবে – দেখতে পারবে পূজার সব সরঞ্জাম। এমনকি মিষ্টান্ন, নৈবিদ্য, ফল মুল কিচছু কিনতে হবে না।
মেয়েঃ আর ঠাকুরদা মানে পুরোহিত? পুরোহিত ছাড়া কি পূজা হয়? যে কালচার একবার ভেতরে গেথে বসেছে – তা থেকে কি বেড়িয়ে আসা যায়?
ছেলেঃ আমি তো জানি – পুরোহিত ছাড়া তুমি তো পূজাকে অসম্পন্ন মনে কর। তাই তোমার কথা মনে রেখে (যদিও খরচাটা একটু বেশী পড়ে গেল) কলিকাতার প্রশিদ্ধ পুরহীত ডট কম এর সাথে যোগাযোগ করেছি। পুরোহিত শ্রী শ্রী যজ্ঞেশ্বর মহাশয়ের বাড়ি থেকে পূজার মন্ত্র সরাসরি broadcast হবে। আমরা বাড়ির পূজার মণ্ডপে বসেই উনার সাথে সব উপচার পালন করতে পারবো।
মেয়েঃ তুমি এগুলো কি বলছ? আমি তো সত্যিই অবাক হয়ে যাচ্ছি। আচ্ছা, তুমি যে বললে, পূজার প্রসাদ, খিচুড়ি, ডালনা, ফুল কপির রসা সবকিছু digital. তবে খাবো কি? মুণ্ডু?
ছেলেঃ দুটো option খোলা আছে – এক হোল physical – এক্ষেত্রে তোমাকে [www.noibidho.com এ যেয়ে online order দিতে হবে। দ্বিতীয় option হোল virtual । এক্ষেত্রে যেটা হবে – তোমার রেগুলার খাবারের উপর holographic image পড়বে। মোটা ভাত হয়ে যাবে বাসমতী, পাতলা ডাল রূপ নেবে উপাদেয় পায়েসে। এক্ষেত্রে গুগলের কাছ থেকে একটা app subscribe করতে হবে। তোমার সেল ফোন থেকে app টা মস্তিষ্কে সঠিক স্বাদ গন্ধের stimuli তৈরি করবে। তুমি পরম তৃপ্তিতে ডালকে পায়েস মনে করে চেটে পুটে খাবে।
মেয়েঃ আচ্ছা, তুমি এতক্ষণ যা বলে গেলে তা কি সত্যি? কেমন কেমন যেন লাগছে?
ছেলেঃ কেমন কেমন নয়। অনেকটাই সত্যি । মনে আছে, সেদিন তুমি ঠাকুরমার ঘরে ভুত দেখেছিলে!
মেয়েঃ আর বোল না। ওমা! আমার গাটা কেমণ যেন ছম ছম করছে। সেদিন ঠাকুরমার ঘরে খাবার দিতে গিয়েছি। দেখি কি , ঠাকুরমা ফোকলা দাঁত বেড় করে ক্রমাগত হাসছেন। আমাকে বলল আরেক থালা খাবার দিতে। ঠাকুর দার সাথে একসাথে খাবে বলে। তাকিয়ে দেখি এক ফোকলা দাঁত বেড় করা বুড়োর ছায়া মূর্তি ঠাকুরমার পাশে শুয়ে আছে। আচ্ছা, আচ্ছা- বলত এটা কি তোমার কারসাজি?
ছেলেঃ কি করবো বল? ঠাকুরমা বুড়ো হয়ে গেছেন। কারুর সময় নেই তার সাথে কথা বলার। বল, একটা মানুষ কি শুধু খাবার খেয়ে বেচে থাকতে পারে? তাই তো ঠাকুরমার ঘরে holographic video player লাগিয়েছি। বল, ভালো করিনি?
মেয়েঃ তা, ভালো করেছো? তবে আমার শাড়ী, গহনা এটা তো সত্যি?
ছেলেঃ আজ সত্যি নয় , তবে সত্যি হতে কতক্ষণ।
মেয়েঃ মানে? এতক্ষণ তুমি বানিয়ে বানিয়ে বললে। আমায় বোকা বানানোর জন্য!
ছেলেঃ মোটেও নয়। দেখ, আমি স্বপ্নদ্রষ্টা। আমি তো দেখতে পাচ্ছি অনাগত ভবিষ্যৎ। ভেবে দেখ, কি বিপ্লব ঘটে যাবে।আমিতো ইতোমধ্যে গুগলের সুন্দর জীর সাথে আমার idea টা share করেছি। উনি তো খুব excited আমার idea টা নাকি অনেক sector এ apply করা সম্ভব। যেমন western world এ মানুষ কুকুর বিড়াল পোষেন একাকীত্ব কাটানোর জন্যে। এক্ষেত্রে holographic কুকুর বিড়াল প্রকৃত কুকুর বিড়ালের বিকল্প হতে পারে।
মেয়েঃ তুমি ঠিক বলেছ। আমার বিশ্রী লাগে যখন দেখি রাস্তায় আগে আগে কুকুর আর পেছনে তার মনিব হাতে plastic ব্যাগের ভেতর কুকুরের উচ্ছিষ্ট নেয়ে ঘুরছেন। আসলে উনাদের তোমার technology বাজারে আসা দরকার। কোন ঝামেলা থাকবে না, কোন pet food কিনতে হবে না, কোন insurance কিনতে হবে না। শুধু onetime investment
ছেলেঃ তার পর শুন, সুন্দরজী বলেছেন আমার idea apply করে সেই গাধার সামনে মূলা ঝুলিয়ে productivity বাড়ানোর কৌশলের মতো অনেক technology নাকি innovate করা সম্ভব। সত্যি আমার খুব ভয় করছে- তোমার এ ক্ষণজন্মা স্বামীটাকে ক্রিসের বাবার মতো কেউ অপহরণ করে না নিয়ে যায়!। please আমায় শক্ত করে ধরে রাখ। সত্যি আমার ভয় করছে…
মেয়েঃ আমারও ভয় হচ্ছে। সত্যি আমি ভয়ের অথই সাগরে তলিয়ে যাচ্ছি। আমার শাড়ি লাগবে না, গহনা লাগবে না। আমি আর কখনেো শাড়ি-গহনা র কথা মুখেই আনবো না। কথা দিচ্ছি।
।। সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী । ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স, মাস্টার্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।
অবলাচরণ – ১ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার
অবলাচরণ – ২ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার