ফিচার্ড লেখালেখি

অবলাচরণ – ৮ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ-৫

পর্ব প্রকাশের পর….

অবলাচরণ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

কালা খাঁ অবলার পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইল। অত্যন্ত নিকটে আসিয়া তাহাকে চিনিতে চেষ্টা করিল। ইদানীং সে কারোকেই তেমন চিনিতে পারে না। কিন্তু আজ সে অবলাকে চিনিতে পারিয়া তাহার কাছে বাড়ি ফিরিবার করুণ আকুতি জানাইল। অবলা এই মানুষটাকে একদা অত্যন্ত ভয় করিত। বাবা-মা কি বুঝিয়া তার নাম রাখিয়াছিল কালা পাহাড়। ইতিহাসের সেই প্রবল প্রতিহিংসা পরায়ণ দুর্জয় মানুষটি এক মুসলিম তরুণীকে বিবাহ করিয়া তাহার স্বগোত্রীয়দের কাছে , ব্রাক্ষ্মনদের কাছে চরম ভাবে উপেক্ষিত হইয়াছিল। তাই সে প্রবল আক্রোশে ধ্বংস করিয়াছে একের পর এক মন্দির, ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছে অসংখ্য বিগ্রহ, লুট করিয়াছে মন্দিরের অঢেল সম্পদ। অবলা তাহার কিশোর কালে এই সুগঠিত মানুষটিকে দেখিয়া বাবার মুখে শুনা ইতিহাসের সেই কালো ছায়া দেখিতে পাইত। কিন্তু সময় কালাপাহাড়ের আচরণ ও ব্যক্তিত্বে ইতিহাসের সেই কালাপাহাড়কে দেখিতে না পাইয়া তাহার নাম হইতে পাহাড় ছাঁটিয়া দিল। সে সবার মুখে পরিচিত হইলো শুধু কালা বলে।

আজ সে বয়সের ভারে হেলিয়া পড়িয়াছে। মতিভ্রম রোগ তাহার মস্তিস্কে বাসা বাধিয়াছে। বাড়ী হইতে বাহির হইলেই সে পথ হারাইয়া ফেলে। তাহাকে পাওয়া যায় রেলস্টেশনে, বাস স্টেশনে । সে ঠায় দাঁড়াইয়া থাকে বাড়ী ফিরবে বলে। আজও সে রেলস্টেশনের দিকেই যাইতেছিল। অনেকেই তাহাকে এমন অবস্থায় দেখিতে পাইলে বাড়িতে পৌছাইয়া দেয়। হঠাৎ হঠাৎ বাড়ী হইতে অনির্দিষ্ট পথে তাহার হারিয়া যাওয়াতে তাহার আপন জনেরা আজ আর উদ্বিগ্ন হয় না। কালা খাঁ আজ তাহার সন্তানদের কাছে এক জীবামৃত বোঝায় পরিণত হইয়াছে।

অবলা তাহাকে লইয়া পথ চলিতে লাগিল। কালা খাঁ চলিতে চলিতে একরকম ছোঁ মারিয়া তাহার হাত হইতে ফুলটা কাড়িয়া লইল। হঠাৎ করিয়া সে একটা গানের কলি বার বার গাইতে চেষ্টা করিয়া ব্যর্থ হইলো। অবলা গভীর মনোযোগ দিয়া বুঝিতে চেষ্টা করিল সে গানের কলিকে। দীর্ঘক্ষণের চেষ্টায় সে বুঝিতে পারিল তাহার গানের মুখরা । অবলা দ্বিধাহীন কণ্ঠে সুর করিয়া গাহিয়া উঠিল –

‘কেউ বলে ফাল্গুন, কেউ বলে পলাশের মাস,                                                           আমি বলি আমার সর্বনাশ । ‘                                                                                  কালা খাঁ যোগ করিল –                                                                                            ‘কেউ বলে দখিনা, কেউ বলে মাতাল বাতাস                                                             আমি বলি আমার দীর্ঘশ্বাস।’

দুজনেই গানের অন্তরাটুকু ভুলিয়া গিয়াছে। কিন্তু তাহাতে তাহাদের কোন আক্ষেপ নাই। তারা মুখরাকেই অন্তরা বানাইয়া হ্রদয় উজাড় করিয়া বারংবার গাহিয়া গেল। কালা খাঁকে দেখিয়া কি এক অব্যক্ত কষ্টে অবলার চোখ আর্দ্র হইয়া উঠিল। সন্ধ্যার তমসাঘন প্রান্তরের মাঝে তাহাদের সুর ক্রমশ হারাইয়া গেল। কালা খাঁ কে বাড়িতে পৌঁছাইয়া দিয়া অবলা আবারও পথ চলিতে লাগিল।

আজ তাহার বাড়ী ফেরার পথ অনেক দীর্ঘ। বার বার তাহার কালা খাঁর কথা মনে পড়িতে লাগিল। কালা খাঁর দরাজ গলার সুরেলা কন্ঠ হৃদয়ের সবগুলো তন্ত্রীকে নাড়া দিয়া তাহার কানে বাজিতে লাগিল। এক সময়ের শক্তিশালী মানুষটি আজ সময়ের কাছে হার মানিয়াছে। প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়ালে সে আজ পথ মাঝে পথ খুঁজিয়া বেড়ায়। অবলার মনে হইলো হয়তো কালা খাঁর মতো অসংখ্য মানুষ অন্ধকারে পথ হাতড়াইয়া ঘরে ফেরার চেষ্টা করিতেছে, নিজের সন্তানের দিকে অসহায় ভাবে তাকাইয়া ভাবিতেছে – ও যেন কে? এমনি ভাবিতে ভাবিতে অবলা তাহার সম্মুখ দরজায় আসিয়া দাঁড়াইল।

দরজা খুলিলেই এক বিস্তীর্ণ প্রান্তর। হরেক রকম ফলফুল আর সবজী ভরা এক বিরাট বাগিচা। তাহাদের দিকে তাকাইলেই মনটা ভাল হইয়া যায়। অবলা ঘরে না ঢুকিয়া বাগানে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। তাহার গোলাপ গাছ গোলাপে উপচাইয়া পড়িয়াছে। বাগান বিলাস অসংখ্য কাগজের ফুলে নিজকে সাজাইয়াছে, গন্ধরাজ ছড়াইয়া রাখিয়াছে এক পাগল করা সুভাস। সে কোথায় যেন পড়িয়াছে – পশ্চিমা দেশে বড় বড় উদ্যান গড়িয়া উঠিয়াছে। সেই উদ্যানে মনভোলা মানুষের দল কলরব করিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়। ফুলের ঘ্রাণে, ফুলের স্পর্শে ওরা ফিরে পায় তাহাদের হারান স্মৃতি। অবলা তাহার জীবনের উদ্দেশ্যকে তাহার চোখের সামনে মূর্তিমান দেখিতে পাইয়া মুহূর্তে উত্তেজিত হইয়া পড়িল। সে কল্পনায় দেখিতে পাইল তাহার এই বিশাল অঙ্গন জুড়িয়া অন্তহীন ফুলের সমারোহ। অসংখ্য প্রজাপতি রঙ্গিন পাখনায় রঙ ছড়াইয়া, মৌমাছিরা গুন গুন করিয়া, পাখীরা কলরব করিয়া সেই বাগানকে স্বর্গীয় উদ্দ্যানে পরিণত করিয়াছে। জলসিঞ্ছনরত ব্যস্ত কালা খাঁকে সে ঘুরিয়া বেড়াইতে দেখে একগাছ হইতে অন্য গাছে। মুখে তার হাসি, গলায় সেই ভুলিয়া যাওয়া গানের কলি –

কেউ বলে নদী, কেউ তটিনী,

কেউবা দিয়েছে নাম তরঙ্গিনী

আমিতো তাকে কোনো নামে ডাকিনি

সে যে আমার চোখেই জলোচ্ছাস।

অবলার মন সুরের মূর্চ্ছনায় আচ্ছন্ন হইলো। তাহার অজান্তেই তাহা বুদবুদের মতো তাহার কন্ঠ হইতে নির্গত হইলো সংগীতের অবয়বে –

কেউ বলে ফাল্গুন, কেউ বলে পলাশের মাস,

আমি বলি আমার সর্বনাশ।।

 

চলবে..


।। সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।

 



 


অবলাচরণ – ১ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ২ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৩ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৪ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৫ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৬ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অবলাচরণ – ৭ ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

সংবাদটি শেয়ার করুন