সাহিত্য ও কবিতা

আমার মতো পার্বতীদের পূজো নেই  ||| পিকলু প্রিয়’র গল্প


আমার মতো পার্বতীদের পূজো নেই  ||| পিকলু প্রিয়’র গল্প

 অজো পাড়া গ্রামের মেয়েটি, নাম তার পার্বতী মা, বাবা, ভাই, নিয়েই পার্বতীদের দারিদ্রতার সংসার! পার্বতীর বড় ভাই প্রকাশ একটা কোম্পানিতে চাকুরি করে, পার্বতী শহরে একটা দর্জির দোকানে চাকুরি করে। টানাটুনির সংসার তার মধ্যে বেঁচে থাকার অদম্য যুদ্ধ তবুও যে অন্ত নেই  তাদের নতুন নতুন স্বপ্নের ! স্বপ্নই বুঝি মানুষের বেঁচের থাকার চাবিকাঠি।
নতুন আরেক সদস্যের আগমনের জন্য স্বপ্নের সিঁড়িতে পা রাখলো পার্বতীর পরিবার। পার্বতীর ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হলো, তবে সংসারের ক্ষেত্রে পার্বতীর বড় ভাই খুব উদাসীন! তবে এদিকে পার্বতীরও বিয়ের বয়স হয়েছে, তাতে কী বড় ভাইয়ের বিয়ে বলে কথা, প্রত্যেকটি পরিবারের মেয়েরা চায় তাদের বড় ভাইদের বিয়ের অনুষ্ঠানটা শেষে করে তাদের বিয়ে হউক। “পুরুষ বা নারী যেই হউক বিয়ে ব্যাপারটা যার যার ব্যক্তি ইচ্ছে থাকা উচিৎ”।
সকল জল্পনা কল্পনা ও দারিদ্র্যতার সাথে লড়াই করে অবশেষে পার্বতীদের পরিবারে নতুন সদস্যের আগমন হলো। নতুন বউ, নতুন সংসার, তারি সাথে বদলাতে থাকে পরিবারের প্রাণবন্ততা! যদিও পার্বতী ও তার মা বাবা মেনে নিচ্ছিলেন অনেক কিছুই, কারণ তারা হয়তো বুঝতেন পৃথিবীতে সব থেকে বড় লড়াই, সংসার লড়াই! এই লড়াইয়ে ধংসটাই বেশি থাকে। তবুও যে দিনশেষে টিকে থাকার লড়াই করে যেতে হয়!
চলছে জীবন, চলছে যুদ্ধ, চলছে সংসার, তার মধ্যেই এলো দূর্গা পূজাের আমেজ। কত আয়োজন, কত প্রয়োজন, কত স্বাদ- আল্লাদ, চারদিকে পূজাের কেনাকাটার ধূম কত জল্পনা কল্পনা। কিন্তু পার্বতীর পরিবারের পূজার আয়োজন’টা কেমন?
পার্বতীর বড় ভাই আর ভাইয়ের বউ মিলে শহরের বড় শপিং মহলে গেলেন পুজোর শপিং করতে। প্রকাশ তার বউয়ের জন্য প্রায় পনেরো হাজার টাকার শপিং করলেন। অথচ প্রকাশের মাসিক আয় বারো হাজার টাকা। এদিকে বাড়িতে বৃদ্ধা মা বাবা ছোট বোন পার্বতীর কথার তারা একটিবারও ভাবলেন না। শপিং শেষে তারা বাড়ি ফিরলেন। শপিং এর বিষয় নিয়ে পরিবারের কাছে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার কিচ্ছা শুনিয়ে সমাপ্তি দিলেন প্রকাশ ও তার বউ!
কিন্তু মা বাবা বলে কথা আমৃত্যুই ছেলে মেয়েদের সুখের জন্য নিজেদেরকে উৎসর্গ করে থাকেন। প্রকাশ আর উনার বউ তারা যতটুকু সহজে তাদের বুঝিয়েছেন এবং নিজেদেরকে খুব বু্দ্ধিমান ভাবছেন আসলে মোদ্দা কথা হলো মা বাবারা বুঝেন না কী সেটাই ভাবা উচিত! বিষয়টা এমন ছিল যে মায়ের কাছে এসে মামার বাড়ির গল্প বলা হচ্ছে।
এদিকে, সারা দিনের ক্লান্তি শেষে যখন পার্বতী বাড়ি ফিরলো তখন সে দেখতে পেল রঙ্গমঞ্চের ধারাবাহিক নাটকখানা। মুখ তুবড়ে নীবরে সবকিছু হজম করে নিলো পার্বতী। মনে মনে ভাবলো আজ পঞ্চমী, কাল ষষ্ঠী, আর যাই হউক পূজোতে মা বাবাকে নতুন কাপড় পড়াতে হবেই।
পরের দিন পার্বতী দর্জির মালিক’কে বললো দাদা আমাকে এইবার এক মাসের বেতন অগ্রীম দিতে হবে। দর্জির মহাজন জানতে চাইলেন ক্যানো? পার্বতী বললো বেশ কিছুদিন যাবত শরীরটা খুব অসুস্থ। আপনাকেও বলছি না দোকানে কাজের চাপ বেশি। আজ দোকানে আসার পথে ডাক্তার দেখিয়েছিলাম প্রায় তিন হাজার টাকার উপরে ঔষধ কিনতে হবে। যদি সুস্থ না থাকি তা হলে কাজ করবো কী করে দাদা। দয়াকরে আমাকে এই মাসের বেতনের সাথে অগ্রীম আরেক মাসের বেতন লাগবে। আমি’তো আপনার এখানেই কাজ করছি। অবশেষে দর্জির মহাজন টাকা দিলেন।
সারাদিন কাজ করে রাতে বাড়ি ফিরার সময় শপিং মহলে গেল পার্বতী। মায়ের জন্য একটা শাড়ি, বাবার জন্য একটা পাঞ্জাবি, ভাইয়ের জন্য একটা শার্ট, বউদির জন্য একটা শাড়ি, অবশিষ্ট পার্বতীর হাতে আর মাত্র পঞ্চাশ টাকা। শহর থেকে বাড়ি ফিরতে বাস ভাড়া চল্লিশ টাকা। সারা দিনের পরিশ্রম ক্লান্তিময় শরীর কতশত ইচ্ছে’কে ফানুস করে ঘরে ফিরলো পার্বতী। হাসিমাখা মুখ কত উল্লাস মা, বাবা, দাদা, বউদি, এদিকে এসো পূজাতে ৪ দিনের ছুটি পেয়েছি সাথে বোনাসও পেয়েছি তাই সবার জন্য নতুন জামা কাপড় এনেছি। কাল ষষ্টি আমরা সবাই নতুন জামা কাপড় পড়ে পূজো মন্ডপে যাবো। সবাইকে সবার জামা কাপড় বুঝিয়ে দিলো পার্বতী। হঠাৎ মা আর বাবা পার্বতীকে প্রশ্ন করলেন কি’রে পার্বতী তোর নতুন কাপড় কোথায়? পার্বতী খুব রাগি ভাব দেখিয়ে বললো আর বলো না শাড়ি থেকে ব্লাউজ পিস কেটে ব্লাউজ বানানোর জন্য সুবোধ দার দোকানে দিয়ে এসেছি বলেছে কাল বিকালে দিয়ে দিবে। বাবা কিছু দিন আগে আমার জন্য যে জামাটা কিনে এনেছিলেন ষষ্টি’তে সেটা পড়বো এবং তোমাদের’কে নিয়ে বেড় হবো। প্রথমে বাবার দেওয়া উপহার’টা গায়ে লাগিয়ে মন্ডপে যেতে আমারও খুব ইচ্ছে তাই সুবোধ দাকে আর তেমন তাড়াহুড়ো করতে বলি নাই।
আজ ষষ্ঠী পার্বতী ও তার পুরো পরিবার মিলে শহরে পূজোতে ঘুরতে বের হলো। শহরে খুব বড় একটি পূজো মন্ডপ আছে সেখানে খুব জাকজমক ভাবে পূজো হয়। সেখানে গেলো তারা। সবাই দুর্গা মাকে প্রমাম করছেন, প্রসাদ খাচ্ছেন, আরতি দেখছেন, হই হুল্লোড় করছেন, আর মনে মনে কত কিছু আশা করছেন!  সেই সাথে কত রকমের আমোদে ফূর্তি হচ্ছে! পার্বতী দাঁড়িয়ে দেখছে আর চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে মনে হচ্ছে চোখের জলে এখনি বন্যা হয়ে যাবে ভিতরে আর্তনাদে সকল ডাক ঢুল বন্ধ হয়ে যাবে। পূজো মন্ডপটা একটা পতিত জমিতে রুপ নিবে। হঠাৎ পার্বতীর মা এসে বললেন কি’রে তুই এখানে একা একা দাড়িয়ে কী করছিস যা মাকে প্রনাম করে আয়, আরো কত মন্ডপ দেখার বাকি রয়ে গেছে! পার্বতী মন্ডপের সামনে গিয়ে দূর্গা মা’কে প্রমান করে মনে মনে বললো মা’গো আমার মত পার্বতীদের কোন পুজো নেই, কোন আয়োজন নেই, কোন  প্রয়োজন নেই, আছে শুধু বেঁচে থাকার লম্বা একটি দীর্ঘশ্বাস। বিশ্বাস করো প্রতিমা আমার দুর্গা রক্তে মাংসে গড়া আমার ‘মা’ ভালো থাকো প্রতিমা। প্রনাম শেষে প্রনামী বক্স-এ পার্বতীর অবশিষ্ট দশ টাকা দিয়ে এলো।
তারপর বাবাকে বললো বাবা শরীরটা ভালো বোধ করছি না আমাকে একশো টাকা দাও আমি বাড়ি ফিরে যাই তোমারা মন্ডপ দেখে ঘুরে ঘুরে আসো। বাবার কাছ থেকে একশো টাকা নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো পার্বতী পুজো মন্ডপ থেকে পায়ে হেঁটে গেল তিন মাইল জায়গা সেখান থেকে নব্বই টাকা দিয়ে বাসে করে বাড়ি ফিরলো পার্বতী।
দিনশেষে এইভাবেই অধিকাংশ পার্বতীরা অদৃশ্য লীলাখেলা’কে মুখ বুঝে সয়ে যায়।
এইভাবেই অধিকাংশ পার্বতীরা অনেক আমোদ,  প্রমোদ, যল্পনা, কল্পনা, অনলশিখায় পুড়িয়ে এগিয়ে যায় নিজ সত্তায়।
পার্বতীদের মত রক্তে মাংসে সাহসে বুদ্ধিতে শত শত স্বয়ং দুর্গার আর্বিভাব হউক।

লেখাঃ পিকলু প্রিয়, কবি ও সংবাদ কর্মী, 

 

সিএ/এসএস


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন