ফিচার্ড সাহিত্য ও কবিতা

একটি প্যাকেট ও একজন সৈয়দ মাসুম ||| সদেরা সুজন

একটি প্যাকেট ও একজন সৈয়দ মাসুম ||| সদেরা সুজন

প্রায় প্রতিদিনই প্যাকেট/পার্সেল আসে। বিশেষ করে কোভিড মহামারী শুরু হবার পর থেকে বেড়ে গেছে। কাজ থেকে ফিরেই দরজার সামনে একটি বেশ বড় প্যাকেট দেখে প্রথমে তেমন অবাক হইনি, এভাবে প্রায়ই আমাজন থেকে আসা প্যাকেট দরজার সামনে থেকে সংগ্রহ করতে হয়। ভেবেছিলাম সন্তানরা হয়তো কোনো কিছু অর্ডার করেছে নিত্য দিনের মতো। প্যাকেজের উপরে হাতে লেখা দেখে একটু অবাক হয়েই দেখলাম। না সেটা সন্তানদের হবার কথা নয়!  প্রেরকের ঠিকানা দেখেই বুঝতে অসুবিধে হলোনা। সুদূর বিলেত থেকে অনুজ প্রতীম সৈয়দ মাসুমের পাঠানো প্যাকেজ। বুঝতেই পারছেন তা কি আর অপেক্ষা করার মতো। আমি কাজ থেকে ফিরে প্রথমেই সাওয়ার করতে যাই কিন্তু সে কর্মটি বাদ দিয়ে প্যাকেটটি খুলতেই দেখি তিন তিনটি বই। সৈয়দ মাসুমের লেখা সদ্য প্রকাশিত তিনটি বিশাল গ্রন্থ। আহা, বইগুলোর প্রকাশনা উৎসব থেকে বই সম্পর্কে প্রচুর লেখালেখি বাংলাদেশ এবং ব্রিটেনের বাংলা পত্রিকা এবং টিভিতে দেখেছি ফলে বই’র প্রতি বিশেষ আকর্ষণতো স্বাভাবিকভাবেই ছিলো। সেদিন বইগুলো হাতে পেয়ে অনেক বড় কিছু পাওয়ার মতোই আনন্দে মনটি ভরে উঠেছিলো। পাশাপাশি নতুন বই-এর গন্ধ বরাবরই আমাকে জাগিয়ে তুলে…  সেদিনও তুলেছিলো অন্য এক আমেজে।

ইন্টারনেটের যুগে এখন অনেক কিছুই ই উপহার পাওয়া গেলেও কিন্তু বই পার্সেলে উপহার পাওয়া বড্ড কষ্টসাধ্য। বেশ কয়েক বছর পূর্বে ‘বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী’ বইটি প্রকাশ হবার পরপরই পাঠিয়েছিলেন বড় সম্বন্ধীকের স্ত্রী আমাদের প্রিয় বৌদি শর্বরী চৌধুরী। বইটি পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলাম এবং বইটি পড়া শেষ হতে না হতেই খুব কাছের একজন দুইদিনের জন্য বইটি পড়তে নিয়েছিলেন, কতটুকু পড়েছেন জানিনা কিন্তু আজ পর্যন্ত বইটি পাইনি। এভাবে আমার প্রবাসজীবনের স্বল্প পরিসরে জমানো অসংখ্য বই থেকে শ্রদ্ধেয় লেখক হুমায়ুন আজাদ-এর ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ ‘ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল’ তসলিমা নাসরিনের বেশ কয়েকটি বই এবং বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক হামলার ওপরে সংগ্রহ করা বইগুলো বন্ধুরা নিয়ে গেছেন ফিরৎযোগ্য বলে কিন্তু বছর থেকে যুগ পেরিয়ে গেলেও বই আর ফিরে আসেনি। আসার সম্ভাবনা আমৃত্যু আছে বলে মনে হয় না।

৩/৪ বছর পূর্বে ঠিক এভাবেই একটি বিশাল বই উপহার পেয়েছিলাম সাংবাদিক ইসহাক কাজলের কাছ থেকে। ইসহাক ভাই নেই। চলে গেছেন না ফেরার দেশে। অনেক স্মৃতি অনেক কথা কাজল ভাইকে নিয়ে। দীর্ঘদিন একসাথে সাংবাদিকতা করেছি। সেই কবে আশির দশকের শুরুতে থেকে মফঃস্বল সাংবাদিকতা জীবনের পথ চলা। তখনই পরিচয় হয়েছিলো অগ্রজ সাংবাদিক, বন্ধু, ইসহাক কাজল ভাই’র সঙ্গে। এরপর দীর্ঘ কন্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। সেদিনের সাংবাদিকতা আজকের মতো ছিলো না। এখনতো হাতের মুঠোয় সব। আর সেদিন আজকের মতো এত সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল আর অনলাইন পত্রিকা ছিলোনা হাতে গোনা কিছু পত্রিকা আর একটি টিভি চ্যানেলই ছিলো গণমাধ্যম। যাক্ মৃত্যুর কয়েকমাস পূর্বে কাজল ভাই তাঁর ওপর প্রকাশিত গ্রন্থটি আমাকে পাঠিয়েছিলেন। যা এখনো আমাকে কাঁদায়, আমাকে ক্ষণে ক্ষণে হারিয়ে নিয়ে যায় অতীতের ফেলে আসা দিনগুলোর মাঝে, যেখানে কষ্টের মুখোমুখি হয়েও সোনাঝরা রোদের মাঝে জীবন চলতো…। আমার বন্ধু, প্রিয় স্বজন, প্রিয় মানুষ সহযোদ্ধা খ্যাতিমান সাংবাদিক-জেন্টলম্যান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ইসহাক কাজলের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা রেখেই ফের লিখতে হচ্ছে ব্রিটেনের বর্তমান সময়ে অত্যন্ত সুপরিচিত  লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক সৈয়দ মাসুমের কথা।

ব্রিটেনের বর্তমান সময়ে বাংলা ভাষায় অত্যন্ত সুপরিচিত লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক সৈয়দ মাসুম

আমরা সবাই একই এলাকায় জন্ম নিয়ে বড় হয়ে উঠা। সবুজে সুবুজ চাবাগান আর শিক্ষাদিক্ষায় সাহিত্যে, সংস্কৃতি, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আর ইতিহাস ঐতিহ্যে কমলগঞ্জ মৌলভীবাজার জেলার অন্যতম এক সর্বশ্রেষ্ঠ উপজেলা।  আজ অনুজ প্রতীম কবি সৈয়দ মাসুমের বইগুলো পেয়ে চোখের পলকে হারিয়ে গেলাম সেই ফেলে আসা স্বর্ণালী দিনগুলোর মাঝে, সেই যৌবনের আগুনঝরা স্বৈরাচার বিরোধি আন্দোলনে জয়বাংলার উত্তাল শ্লোগানে, সাহিত্য পরিষদের সভায় সাবরেজেস্ট্রি মাঠে শীতার্ত সন্ধ্যায় কবিতা আবৃত্তি, অথবা ছাত্রসংসদ নির্বাচনে ছাত্রের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটভিক্ষা, চাবাগানের সবুজের মধ্যে দিয়ে আঁকাবাকা পথে দুরন্ত গতিতে চলা, গ্রামের মেঠো পথে কখনো বৃষ্টিভেজা আল ধরে কোনোও বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে চা-মুড়ির আড্ডা, শীতার্ত কুয়াশাঘেরা সকালে কলেজের পিছনে শিমুল গাছের নিচে অপেক্ষারত কারো সাক্ষাৎ প্রত্যাশা… কিংবা আমার সেই ভানুগাছ বাজারে নব্বই দশকের ‘সপ্তবর্ণা’ লাইব্রেরীর আড্ডা। যেখানে সব শ্রেনির ও পেশার মানুষ সাহিত্য-সংস্কৃতির জম্পেশ আড্ডায় মেথে থাকতো। উপজেলার সর্বচ্চো কর্মকর্তা থেকে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, লেখক-সাংবাদিক এবং বিদেশি সংস্থা হীড বাংলাদেশের বন্ধুরা স্বল্প পরিসরে হলেও বিশাল ব্যাপ্তিতে  আড্ডায় সরগরম থাকতো সপ্তবর্ণা…। সেই সপ্তবর্ণাতে ছাত্রজীবনে প্রায় যেতেন আমাদের এই প্রিয় লেখক গবেষক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ি সৈয়দ মাসুম। সেদিনের স্মৃতি তিনি ভুলেননি, নস্টালজিয়া থেকেই লিখে চলছেন একের পর এক বই।

সম্প্রতি প্রকাশিত সৈয়দ মাসুম-এর তিনটি গ্রন্থের মধ্যে  ‘বিলেতে কমলগঞ্জের শতজন’ গ্রন্থটি পড়ে চোখের সামনে ভেসে উঠলো প্রিয় পরিচিত মানুষগুলোর চেয়ারা, সত্যিকথা বলতে কি প্রায় ৩২ বছরের প্রবাস জীবনে অনেক কিছুই ভুলতে বসেছিলাম। তাইতো বইটি আমাকে ফের কমলগঞ্জের অনেক মানুষকে, অনেক পরিবারকে, অনেক পরিচিত ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ফের দূর-বহুদূর থেকেও অবলোকন করার সুযোগ করে দিয়েছেন আমার এই অনুজ প্রতীম ভাই মাসুম।

‘কমলগঞ্জের শতজন’ শুধুই একটি গ্রন্থ নয় সেটা আগামী দিনের একটি ঐতিহাসিক মূল্যবান দলিল বলে আমি মনে করি।  বইটি পড়তে গিয়ে দেখতে পেলাম আশি এবং নব্বই দশকে কমলগঞ্জের ছাত্র রাজনীতি- আন্দোলন, লেখালেখি, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, সাংবাদিকতাসহবিভিন্ন বিষয়ে বেশ কয়েকবার আমাকে স্মরণ করেছেন লেখক। ধন্যবাদ সৈয়দ মাসুম। দীর্ঘদিন পরেও কেউ এভাবে আমার নামটি স্মরণ করায় সত্যিই আমি আপ্লুত। অসাম্প্রদায়িক চেতনার  বিশাল বড় হৃদয় না হলে বর্তমান সময়ে এমন কাজটি সহজে কেউ করতে চায়না।

লেখকের আরও দু’টি কবিতা বই ‘বিধ্বস্ত প্রাচীর’ ও ‘অরক্ষিতার আর্তনাদ’ নামে প্রকাশিত হয়েছে একই সময়ে। অসাধারণ কবিতাগুলো। অসাম্প্রদায়িক চেতনায়, সমাজ সচেতনেতায়, সমসাময়িক বিষয়,  প্রকৃতি,  প্রবাস, সমাজ-সংসার, ভাষা-আন্দোলন, ৭১-এর স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধসহ অনেক কিছুই কবিতায় তুলে ধরেছেন। সমাজে ঘটে যাওয়া  বর্বরতা, বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাশীনদের আস্ফালনসহ যুগ-যন্ত্রণার কথা গেঁথেছেন কবিতায়। এককথায় পড়ার মতো কাব্যগ্রন্থগুলো। বইগুলোর রুচিশীল প্রচ্ছদ আর সার্বিক কাজ আমাকে মুগ্ধ করেছে।  সৈয়দ মাসুম ব্রিটেনে দীর্ঘদিন যাবত ক্যাটারিং, প্রোপার্টি ইনভেষ্টমেন্ট ব্যবসা ছাড়াও একটি পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকের পাশাপাশি লেখালেখি এবং গবেষণা-সাংবাদিকতা করছেন যা বলা যায় বহুমুখি প্রতিভার অধিকারী সৈয়দ মাসুম। প্রিয় ভাই, প্রিয় বন্ধু, প্রিয় লেখক সৈয়দ মাসুম-এর জন্য রইলো অনেক অনেক শুভ কামনা। তাঁর শব্দ বিন্যাসে, চিন্তা-চেতনায় আলোকিত হোক সমাজ সংসার, মানবতা, প্রগতি এবং সত্য ও সুন্দরের পথচলা।

-সদেরা সুজন, সিবিএনএ-এর প্রধান নির্বাহী।

 





সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন