দেশের সংবাদ

কমলগঞ্জের ২শ বছরের ঐতিহ্যবাহী চড়ক পূজা ও মেলা শুক্রবার শুরু

কমলগঞ্জের ছয়চিরি সাগর দিঘীর পাড়ের
২শ বছরের ঐতিহ্যবাহী চড়ক পূজা ও মেলা শুক্রবার শুরু

অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলা। জনজীবনবৈচিত্র্যে ভরপুর কমলগঞ্জ উপজেলার নানা উৎসব-অনুষ্টানের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী লোকোৎসব হচ্ছে চড়কপূজা। বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আকর্ষণীয় ও অন্যতম লোকোৎসব এটি। প্রতি বছর বাঙলা পহেলা বৈশাখের(১৪ এপ্রিল) দিন ছয়চিরি সাগর দিঘিরপাড়ে চড়কপূজা ও মেলার আয়োজন করা হয়। কিন্তু পঞ্জিকা মতে চৈত্রের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তির দিনে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয় এবং বৈশাখের প্রথম দু-তিন দিনব্যাপী চড়কপূজার উৎসব চলে। চড়ক পূজা বহু প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে। এ পূজার অপর নাম নীল পূজা, মহাদেব পূজা, গম্ভীরা পূজা বা শিবের গাজন পূজা। এটি চৈত্র মাসে পালিত হিন্দু দেবতা শিবের গাজন উৎসবের একটি অঙ্গ। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে যা চৈত্র সংক্রান্তির মেলা নামে অভিহিত।

উপজেলার রহিমপুর ইউনিয়নের ছয়চিরী দিঘীর পারে ঐতিহ্যবাহী চড়ক পূজা বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ১৪ এপ্রিল শুক্রবার শুরু হচ্ছে। দুইশত বছরের ঐতিহ্যবাহী চড়ক পূজাকে কেন্দ্র করে কমলগঞ্জের ছয়চিরিসহ আশেপাশের এলাকার মানুষের মধ্যে বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা বিরাজ করছে। ২ দিনব্যাপী এ চড়ক পূজা ও মেলা শেষ হবে ১৫ এপ্রিল শনিবার। ঐতিহ্যবাহী এই চড়ক উৎসব দেখতে দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে হাজার হাজার লোকের ঢল নামবে। প্রাচীন ঐতিহ্য লালিত ছয়চিরি দিঘীর পাড়ে বাংলা পুঞ্জিকা মতে প্রতিবছরের চৈত্র সংক্রান্তিতে ২দিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে চড়ক পূজা উৎসব। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।

কমলগঞ্জ উপজেলার রহিমপুর ইউনিয়নের ছয়চিরি সাগর দিঘিরপাড় চড়কপূজার জন্য একটি দর্শনীয় স্থান হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এখনও। চৈত্রের কাঠফাটা রোদ ও গরমের দাবদাহ উপেক্ষা করে হাজারো মানুষের সমাগম ঘটে এই পূজায়। এখানে প্রায় ২০০ বছরেরও আগে থেকে এই চড়কপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সঠিক সময়কাল জানা না থাকলেও এলাকায় কথিত আছে (১৮০৪-১৮১০ইং) সালের কোন এক সময় রাজা ধর্ম্ম নারায়ণের পারিবারিক সহায়তায় শুন ভক্ত নামে এক লোক এলাকার লোকজনদের নিয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে কমলগঞ্জের ছয়চিরি সাগর দিঘিরপাড়ে চড়কপূজার শুরু করেন। কয়েক বছরের মধ্যেই এটি বৃহৎ পরিসর নেয়। ছয়চিরি দিঘির চার পাড়ের মধ্যে দিঘীর পূর্বপাড়ে ১টি, উত্তরপাড়ে ১টি এবং দক্ষিনপাড়ে ২টি চড়কগাছ স্থাপন করে একযোগে অনুষ্ঠিত হয় চড়কপূজা। যা বর্তমানে সিলেট বিভাগের প্রাচীন ও বৃহত্তম চড়কপূজা হিসেবে পরিচিত। প্রায় ৪শ বছর আগে রাজা ধর্ম্ম নারায়ণ এই দিঘিটি খনন করান। তাছাড়া বিগত ১শ বছরেরও অধিক সময়ে কখনওই এই দিঘির পানি শূন্য করা যায় নি। বেশ কয়েকবার পানি সেচে শুকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কোনো বার-ই এই দিঘির পানি শেষ হয়নি। পরিমিত একটি ধাপ শেষে পানি সেচ করলেও তার কমতি দেখা যায় না। লোকমুখে শোনা যায় এই দিঘি কোন এক আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী যার কারণবশতঃ দিঘি কখনও পানি শূন্য হয় না।

চড়কপূজার বিশেষ অঙ্গের অপর নাম নীলপূজা। গম্ভীরাপূজা বা শিবের গাজন এই চড়কপূজারই রকমফের। যে গাছে চড়ক ঘোরানো হয় তা কিন্তু কোন সাধারণ গাছ নয়। এটি একটি বিশেষ ধরনের তন্ত্র-মন্ত্রসাধিত বিশেষ গাছের টুকরা (প্রায় ২৫/৩০ফুট লম্বা)। যেটি প্রতি বছর পূজার পর একটি নির্দিষ্ট পুকুরে বিসর্জন দেয়া হয় এবং তা আবার ঠিক এক বছর পর ঐ পুকুর থেকে তোলা হয় পূজার জন্য। এবং বলা হয় যে, এক বছর পর নাকি সেটি আপনা-আপনি পুকুরে ভেসে উঠে। পূজার দিন পুকুর থেকে চড়ক গাছটিকে তুলে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয়। এতে জলভরা একটি পাত্রে শিবের প্রতীক শিবলিঙ্গ বা সিঁদুরমথিত লম্বা কাঠের তক্তা (‘শিবের পাটা’) রাখা হয়, যা পূজারিদের কাছে “বুড়োশিব” নামে পরিচিত। পতিত ব্রাহ্মণ এ পূজার পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন।

তারপর পূজারীদের পিঠের চামরায় লোহার বর্ষি (প্রায় ৩-৪ সুতা পরিমাণ মোটা বাকানো লোহার বড়ি) গাঁথা হয়, সেটাও নাকি মন্ত্রদ্বারা সাধিত; যাতে কোন প্রকার রক্তপাত কিংবা ব্যাথা-বেদনা হয় না। যে তান্ত্রিক এই কাজটি করেন অর্থাৎ পূজারীদের পিঠে বর্ষি গাঁথেন, জানা গেলো তিনি নাকি অনেক সাধনা করে এসব করেন। বিষয়টা মোটেও ছেলেখেলা নয়। অনায়াসে পিঠের চামড়া টেনে তুলে এত বড় একটা বর্ষি গেথে দিলেন, যা দেখলে রীতিমতো মাথা ঘুরে যায় যে কোন সুস্থ মানুষেরও।

অনেক শিশু-মহিলাতো অজ্ঞান পর্যন্ত হয়ে যান এই দৃশ্য দেখে। এই পূজার বিশেষ বিশেষ অঙ্গ হলো কুমিরের পূজা, জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর হাঁটা, কাঁটা আর ছুঁড়ির (বলিছেদ) ওপর লাফানো, বাণফোঁড়া, শিব গৌরীর বিয়ে, অগ্নিনৃত্য, বর্ষিগাঁথা অবস্থায় চড়কগাছে দোলা এবং দানো-বারনো বা হাজরা পূজা করা। অনেকে আবার বলিচ্ছেদ-ত্রিশূল হাতে উদ্দাম নেচে বেড়ান শিব-কালির বেশে।

ছয়চিরি চড়ক পূজা সর্ম্পকে জানা যায়, চড়ক পূজা উৎসবের ১০/১২ দিন পূর্ব থেকে বিভিন্ন এলাকার পূজারীর মধ্যে ৪০/৫০ জন সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষিত হয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিব-গৌরী সহ নৃত্যগীত সহকারে ভিক্ষাবৃত্তিতে অংশ নেন। এ ক’দিন তারা পবিত্রতার সহিত সন্যাস ব্রত পালন করে নিরামিষ ভোজি এবং সারাদিন উপবাস পালন করেন। চড়ক পূজার ২ দিন পূর্বে পূজারীরা শ্মশানে গিয়ে পূজা অর্চনা করেন ও শেষে গৌরীর বিয়ে, গৌরী নাচ ও বিভিন্ন গান গেয়ে ঢাকের বাজনায় সরগরম করে গোটা এলাকা। ছয়চিরি দিঘীর পাড়ে ভক্তরা নৃত্য করার জন্য কলাগাছ ও বাঁশের খুটি বেষ্টিত মন্ডলী তৈরী করে। পূজার প্রথম দিন নিশি রাতে তান্ত্রিক মন্ত্র ধারা কাচ পড়া দিয়ে জলন্ত ছাইয়ের উপর মানুষরুপি কালী সেজে নৃত্য করে। অন্য ভক্তগণ নৃত্যের তালে তালে, ছন্দে ছন্দে ঢোলক, কাশি, করতাল বাজিয়ে থাকেন।

এসময় দর্শনার্থীরা জয়ধ্বনি এবং নারীদের কন্ঠে হুলুদ ধ্বনি দিতে থাকেন। জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে এই ‘কালীনাচ’ অত্যন্ত আকর্ষনীয় এবং তান্ত্রিক মন্ত্র দিয়ে ৭টি বলিচ্ছেদ (লম্বা দা) এর উপর শিব শয্যা করেন। শিবের উপর উঠে কালী ভয়ানক এক অদ্ভুত রুপ ধারন করেন। এসময় উপস্থিত দর্শনার্থী সবাই আতঙ্কিত হয়ে উঠেন। কালীকাঁচ শেষ হওয়ার পর সকালে পূজারীরা পূজা করে পান বাটা দিয়ে চড়ক গাছকে নিমন্ত্রণ জানানো হলে পার্শ্ববর্তী ঐত্যিহাসিক ছয়চিরি দিঘী থেকে ভেসে উঠে ১০০ ফুট লম্বা চড়ক গাছ। এ গাছের চুড়া থেকে মাচা পর্যন্ত চারটি পাখার মতো করে বাধা হয় চারটি মোটা বাঁশ এবং তাতে যুক্ত করা হয় মোটা লম্বা রশি। আগের বছর উৎসব শেষে এই দিঘীতে ডুবিয়ে রাখা হয়ে ছিল চড়ক গাছ। দিঘীর পাড়ে গর্ত খুড়ে সোজা এবং খাড়া করে পোঁতা হয় এ গাছ।

১৪ এপ্রিল শুক্রবার দুপুর থেকে নারী পুরুষ দর্শনার্থীর বিশাল সমাগম ঘটবে। বিকেল বেলা ভক্তরা মন্ডলীতে বিশাল দা (বলিছেদ) দিয়ে নৃত্য, শিবের নৃত্য ও কালীর নৃত্য দেখানো হয়। নৃত্য শেষে ঐতিহাসিক ছয়চিরি দিঘীতে স্নান করে ভক্তদেরকে লোহার শিকড় শরীরের বিভিন্ন অংশে পিষ্ট (গাঁথা) করা হয়। বিশেষ করে জিহ্নবা ও গলায় গেঁথে দেয়া হয়। নৃত্যের তালে তালে চড়ক গাছ ঘুরানো হয়। দেবতার পূজা-অর্চনা শেষে অপরাহ্নে মূল সন্ন্যাসী ৪ জন ভক্তের (জ্যান্ত মানুষের) পিঠে লোহার দু’টি করে বিরাট আকৃতির বড়শি গেঁথে রশিতে বেঁধে ঝুলিয়ে চড়ক গাছ ঘুরানো হয়। এ সময়ে দর্শনার্থীদের অনেকে বাতাসা আর কলা উপরের দিকে উড়িয়ে দেন আর দর্শনার্থীরা তা কুড়িয়ে নেন।

১৫ এপ্রিল শনিবার ফেরা চড়ক পূজা অনুষ্ঠিত হবে। ওই দিন দেবতার পূজা অর্চনা করা হবে। ঐতিহ্যবাহী ছয়চিরি দিঘীর চার পাড়ের মধ্যে দিঘীর পূর্বপাড়ে ১টি, উত্তর পাড়ে ১টি এবং দক্ষিন পাড়ে ২টি চড়ক গাছ স্থাপন করে পূজা অনুষ্ঠিত হবে। তান্ত্রিক মন্ত্রের ধারা বিভিন্ন অলৌকিক ধর্মীয় কর্মসূচী উপভোগ করার জন্য প্রতি বছরের মত এবারও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার নারী-পুরুষ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে দর্শনার্থীর উপস্থিতি ঘটবে বলে আশা করছেন আয়োজকরা। চড়ক পূজা উপলক্ষে এক বিশাল মেলা বসবে। মেলায় গ্রামীণ ঐতিহ্যের বিভিন্ন রকমারী জিনিসপত্রের সয়লাব থাকবে।

চড়ক পূজা ও মেলা পরিচালনা কমিটি প্রতি বছরের মতো এবারও মেলা সুষ্ঠ ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করার লক্ষে ইতিমধ্যে সব প্রস্তুতি নিয়েছেন। যুগ যুগ ধরে এ চড়ক উৎসব এ অঞ্চলের হিন্দুদের বেশ নাড়া দিয়ে আসছে। বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দু’দিন ও ১লা বৈশাখ বসে মেলা। শেষ চৈত্রের গোধুলীলগ্নে চড়ক গাছ মাটিতে পুঁতে ঘোরানো হয়। এর আগে ভক্ত ও পূজারীরা চড়ক গাছে ফুল, দুধ ও চিনি দিয়ে পূজা দেয়।

কমলগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় সাধারণত দেবনাথ, শব্দকর, মালাকার ও চা-শ্রমিক সম্প্রদায়ের লোক যেখানেই আছেন, সেখানেই আয়োজিত হয় এই চড়কপূজা। যেমন, কমলগঞ্জ উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নের যোগীবিল গ্রামে হয় চৈত্রের ২৪/২৫ তারিখ। এর তিনদিন পর হয় শ্রীনাথপুর গ্রাামে। পঞ্জিকা মতে ৩০চৈত্র, বাংলাদেশ ১লা বৈশাখ (১৪ এপ্রিল) তারিখে অনুষ্ঠিত হয় কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখোলা চা বাগানে ও রহিমপুর ইউনিয়েনের ছয়শ্রী(ছয়চিরি) গ্রামে। তাছাড়া কমলগঞ্জের আরও বেশ কয়েকটি স্থানে চড়কপূজা অনুষ্টিত হয়।

প্রত্যেকটি জায়গায় চড়কপূজাকে ঘিরেই বসে রকমারী পণ্যের মেলা ও নানা ধরনের মুখরোচক খাবারের দোকান। তবে বিশেষ করে ছয়চিরি দিঘিরপাড়ের মেলাটি বেশ বড় আকারের হয়। মেলায় হরেক রকমের সামগ্রী নিয়ে বসেন বিক্রেতারা। মাটির পাত্র, হস্তশিল্প, কাঠের তৈরি নানান সামগ্রী, মুড়ি, মুড়কি, মিঠাই, শিশুদের খেলনা সামগ্রীসহ প্রায় সবই পাওয়া যায় মেলায়। চৈত্রসংক্রান্তি ও বাঙালির প্রাণের পহেলা বৈশাখ হওয়াতে এই দিনটিতে কমলগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত সকল ধর্মের সকল জাতির মানুষের অংশগ্রহণে বয় আনন্দবন্যা।

চড়কপূজা উদযাপন কমিটির নেতা অঞ্জন প্রসাদ রায় চৌধুরী জানান, চড়ক পূজা উদযাপনের লক্ষ্যে আমরা আলাপ-আলোচনা করে সবধরণের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি পূজা ও মেলা সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করার জন্য সবার সহযোগিতা কামনা করেছেন।



 

 


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন