প্রবাসের সংবাদ

চারপাশে যেন যমদূত ঘুরছে …। নিউইয়র্কে করোনা সেবা দিতে গিয়ে অসুস্থ বাংলাদেশি চিকিৎসকের বর্ণনা

চারপাশে যেন যমদূত ঘুরছে
অর্পণা দেবনাথ লাবণী

চারপাশে যেন যমদূত ঘুরছে ….. ‘দুই সপ্তাহ আগেও কভিড-১৯ নিয়ে এখানে তেমন আতঙ্ক ছিল না। তারপর হঠাৎ করেই বাঁধভাঙা ঢেউয়ের মতো রোগী আসতে শুরু করল। এখন আমাদের ছয়তলা হাসপাতালের চারটি তলায় শুধুই করোনা আক্রান্ত মানুষ। প্রতিদিন রোগীর চাপ বাড়ছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মৃত্যুও বাড়ছে। সকালে যাকে চিকিৎসা দিয়ে আসি, সন্ধ্যায় শুনি সে মারা গেছে। চারপাশে যেন যমদূত ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রিয় কর্মস্থল হাসপাতালটি এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের জ্যামাইকা হাসপাতাল মেডিকেল সেন্টারে কর্মরত বাংলাদেশি চিকিৎসক অর্পণা দেবনাথ লাবণী এভাবেই বর্ণনা করলেন তার অভিজ্ঞতা। করোনা রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে এখন নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। জ্বর-কাশি-গলাব্যথাসহ করোনার প্রায় সব লক্ষণ থাকায় তাকে বাসায় আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। আইসোলেশনে থেকেই তিনি ফোনে কথা বলেন সমকালের সঙ্গে।

অর্পণা দেবনাথ জানান, নিউইয়র্কের কুইন্সের বাসার একটি ঘরে তিনি আক্ষরিক অর্থেই গৃহবন্দি। শনিবার অসুস্থ হওয়ার পর থেকে তিনি বাসার এক কোণের ঘর থেকে একবারের জন্যও বের হননি। তার শাশুড়ি দরজার বাইরে খাবার দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যাওয়ার পর তিনি সেই খাবার ঘরে নিয়ে আসেন। নিজের সবকিছু নিজেকেই পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হচ্ছে। সবচেয়ে কষ্টকর হলো, মাত্র ছয় মাস আগে তার ছেলে হয়েছে। একই বাসায় থেকেও চার দিন ধরে ছেলের সান্নিধ্য পাচ্ছেন না তিনি। সে তার ঠাকুরমার সঙ্গে রয়েছে। মাঝেমধ্যে ভিডিওকলে ছেলেকে একনজর দেখে নিচ্ছেন তিনি।
ডা. অর্পণা বলেন, ‘একজন মায়ের জন্য এটা যে কত বড় কষ্টের ব্যাপার তা বোঝাতে পারব না। খুব ইচ্ছা করে ছোট্ট সোনাটাকে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে থাকি। কিন্তু এ পরিস্থিতিতে তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সেও মায়ের কাছে আসার জন্য কান্নাকাটি করে। তবু তাকে ঝুঁকিতে ফেলার কোনো সুযোগ নেই।’

অর্পণা জানান, করোনা প্রতিরোধের শুরুতেই পর্যাপ্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় নিউইয়র্কের পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হচ্ছে। তাদের হাসপাতালসহ সব চিকিৎসা কেন্দ্রেই করোনা টেস্ট কিট ও ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামসহ (পিপিই) প্রয়োজনীয় উপকরণের সংকট দেখা দিয়েছে। সাধারণ গাউন পরে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিয়েছেন তিনি ও তার সহকর্মীরা। যে ‘এন-৯৫’ মাস্ক সর্বোচ্চ ২৪ ঘণ্টা ব্যবহার করা যায়, সেটি পরতে হচ্ছে সাত দিন। ফলে চিকিৎসক-নার্সরা আছেন মারাত্মক ঝুঁকিতে। বেশ কয়েকজন ডাক্তার আক্রান্তও হয়েছেন। ঘনবসতিপূর্ণ নিউইয়র্কে লকডাউন থাকলেও কারফিউ দেওয়া হয়নি। ফলে প্রচুর লোকজন এখনও ঘর থেকে বের হচ্ছেন এবং বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছেন।

করোনা সম্পর্কে সবসময় বলা হচ্ছে, যাদের বয়স বেশি এবং যারা অ্যাজমা, ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য রোগে ভুগছেন, তাদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। তবে বাস্তবে এর ভিন্ন চিত্র দেখার কথা জানিয়ে ডা. অর্পণা বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে এখন ৩শর বেশি রোগী। এর মধ্যে ২৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সীই বেশি। মৃত্যুর হার সব বয়সে প্রায় সমান। ২৪ বছরের এক যুবককে পেয়েছি, তার কোনো অসুখ ছিল না। অথচ সে আক্রান্ত হয়েছে। তাকে ভেন্টিলেটরে রাখতে হয়েছে। হাসপাতালে ৬০টি ভেন্টিলেটর ছিল, সবই ব্যবহার করা হচ্ছে। আরও চাহিদা থাকায় জানানো হয়েছে কর্তৃপক্ষকে। এখন পর্যন্ত ৪০ ভাগ রোগী সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরছেন। রোগীর তুলনায় চিকিৎসকও অপ্রতুল হয়ে পড়েছে। এ কারণে যারা গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বা এ রকম অন্যান্য রোগের চিকিৎসক, তারাও এখন করোনা আক্রান্তদের সেবা দিচ্ছেন। সবাইকে দিনে অন্তত ১২ ঘণ্টা ডিউটি করতে হচ্ছে।’

প্রয়োজনীয় ওষুধের সংকটের কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, নিউইয়র্কে চিকিৎসাব্যবস্থা একটু অন্যরকম। এখানে ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখে অনলাইনে ফার্মেসিতে পাঠিয়ে দেন। রোগী বা স্বজনকে সেখানে গিয়ে ওষুধ সংগ্রহ করতে হয়। তবে এখন এ ব্যবস্থাতেও কাজ হচ্ছে না। সংশ্নিষ্ট চিকিৎসককে গিয়ে ওষুধ আনতে হচ্ছে, তাও শুধু হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের জন্য। অবস্থা বেশি খারাপ হওয়ায় অগ্রাধিকার পাচ্ছেন তারা। টেস্ট কিটের সংকটের কারণে আগে তিন থেকে পাঁচ দিন লাগত করোনা পরীক্ষার ফল পেতে। এখন ভর্তি রোগীদের ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টায় রিপোর্ট দেওয়া হচ্ছে। আর হাসপাতালের বহির্বিভাগে জমা দেওয়া নমুনার ক্ষেত্রে দেওয়া হচ্ছে তিন দিন পর। আজ ডা. অর্পণার করোনা পরীক্ষার ফল পাওয়ার কথা রয়েছে। কিট সংকটের কারণে অসুস্থতার লক্ষণ শুনে জোরালো সন্দেহ না হওয়া পর্যন্ত পরীক্ষা করা হচ্ছে না বলেও জানান তিনি।

করোনার চিকিৎসা দিতে গিয়ে নিজের জীবনকেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছেন অর্পণা। সুস্থ হওয়ার পর কি আবারও কাজে যোগ দেবেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সেবার ব্রত যখন নিয়েছি, তখন আমৃত্যু এটাই আমার কাজ। নিজের ঝুঁকি চিন্তা করে পালিয়ে গেলে তো হবে না। তবে আমার মাধ্যমে পরিবারের অন্য সদস্য, বিশেষ করে আমার ছয় মাসের সন্তান আরুষ যেন অসুস্থ না হয়ে পড়ে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকব।’

বগুড়ার মেয়ে অর্পণা দেবনাথ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছেন। তার স্বামী সৈকত রায় পেশায় সফটওয়্যার প্রকৌশলী। তারা দু’জনই বেশ কয়েক বছর ধরে নিউইয়র্কে স্থায়ীভাবে রয়েছেন।

বিশ্বে করোনায় আক্রান্তের হার এখন সবচেয়ে বেশি যুক্তরাষ্ট্রে। এর মধ্যে নিউইয়র্কের অবস্থা বেশি খারাপ। সেখানে প্রায় ৬০ হাজার রোগী শনাক্ত হয়েছে। হাজার ছাড়িয়েছে মৃত্যু।

সূত্রঃ সমকাল

 

সি/এসএস



 

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 + three =