ফিচার্ড মত-মতান্তর

চ্যানেল বিজয়ী ব্রজেন দাস

বাংলাদেশের-ভবিষ্যৎ-কি

চ্যানেল বিজয়ী ব্রজেন দাস

শিতাংশু গুহ, ০৮ই জানুয়ারি ২০২০, নিউইয়র্ক।। পাকিস্তানী মিডিয়া ‘টিএনএস’ দি নিউজ অন সানডে’র স্পোর্টস বিভাগে ড: সালমান ফরীদি ২৪শে জানুয়ারী ২০২১-এ লিখেছেন: ‘ব্রজেন দাস: দি গ্রেটেষ্ট সুইমার ইন পাকিস্তান’স হিস্ট্রি’। তিনি শুরুই করেছেন এ কথা দিয়ে যে, কিংবদন্তি বক্সার মোহাম্মদ আলী ১৯৮৫ সালে ব্রজেন দাসের সাথে সাক্ষাৎ হলে বলেন, ‘ইউ আর দি কিং অফ দি চ্যানেল, আই এম দি কিং অফ দি রিং, বাট আই থিং ইউর এচিভমেন্ট ইজ গ্রেটার দ্যান মাইন্’। ড: সালমান ফরীদি লিখেছেন, ১৯৬১ সালে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়ার করার পর ব্রজেন দাস বলেছেন, ‘দেন্ আই রিমেম্বার মাই প্যারেন্টস। আই হ্যাড নট ফেইল্ড মাই কান্ট্রি’। ড: ফরীদি বলেন, ব্রজেন দাস সেদিন শুধু যে দ্রুততম ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেছেন তা নয়, ১২দিনের মধ্যে তিনি দু’বার এবং ৬ষ্ট্ বার  চ্যানেল অতিক্রম করার রেকর্ড গড়েন। তিনি দেশের জন্যে প্রচুর সন্মান বয়ে আনেন।

স্পোর্টসের প্রতি তাঁর প্রচন্ড ঝোঁকের কথা উল্লেখ করে ড: সালমান ফরীদি জানান, ব্রজেন দাস ১৯৪৩-৪৫-এ ইন্টারস্কুল এবং ১৯৪৮-৪৯-এ ইন্টার-কলেজিয়েট প্রতিযোগিতায় অংশ নেন, এবং ১৯৫২ সালে পশ্চিমবঙ্গে ১শ’ মিটার ফ্রী-ষ্টাইল সাঁতারে চ্যাম্পিয়ান হন। ১৯৫৩-৫৬ তিনি পূর্ব-পাকিস্তানে ১শ’, ২শ’, ৪শ’, এবং ১৫শ’ মিটার ফ্রী-ষ্টাইল সাঁতারে পরপর চারবার চ্যাম্পিয়ান হ’ন। ১৯৫৫-তে পাকিস্তান জাতীয় প্রতিযোগিতায় তিনি ১শ’ ও ৪শ’ মিটার ফ্রী-ষ্টাইল সাঁতারে চ্যাম্পিয়ান হন এবং ইন্টার-ইউনিভার্সিটি প্রতিযোগিতায় ১শ’, ২শ’ ও ৪শ’ মিটার ফ্রিষ্টাইলে জয়ী হন। ১৯৫৬-তে তিনি মেলবোর্ন অলিম্পিকে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন। যদিও হাতে ব্যথা পাবার কারণে জাতীয় দলে অন্তর্ভুক্ত হ’ননি। এতে তিনি ভেঙ্গে না পরে দূরপাল্লা সাঁতারে মনোনিবেশ করেন। ব্রজেন দাস নিয়মিত শীতলক্ষ্যা ও মেঘনা নদীতে সাঁতার প্র্যাকটিস করতেন, বুড়িগঙ্গা নদীতে তাঁর সাঁতারে হাতেখড়ি। এবং নারায়ণগঞ্জ থেকে চাঁদপুর ৪৬মাইল তিনি মাত্র আড়াই ঘন্টায় সাঁতরে পার হ’ন।

এই নিবন্ধটি পড়ে মনে হয়েছে, পাকিস্তান এখনো ব্রজেন দাস-কে মনে রেখেছে? বাংলাদেশে কি আমরা তাকে মনে রেখেছি? ষাটের দশকের মধ্যভাগে আমরা যখন স্কুলে পড়ি, ব্রজেন দাস-র জীবনী আমাদের পাঠ্যসূচীতে ছিলো। তাঁর ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রমের বর্ণনা আমরা পড়েছিলাম। মানুষটি’র প্রীতি একটা শ্রদ্ধাবোধ জন্মেছিলো। আশির দশকের শুরুতে প্রেসক্লাবে সিনিয়র কেউ একজন (দু:খিত নামটি মনে নেই) আমায় ব্রজেন দাসের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন্। ব্রজেনদা একটি টেবিলে বসেছিলেন, তাঁর পাশে বসে আমি অবাক বিস্ময়ে আকাশ থেকে পড়ি! এই সেই ব্রজেন দাস? মনটা গর্বে ভরে গেলো। এতবড় একজন মানুষের সাথে পরিচিত হয়ে আনন্দিত হলাম। বললাম, আপনার কথা তো পাঠ্যসূচিতে পড়েছি। অন্তরঙ্গ হতে খুববেশি সময় নেয়নি। জানলাম তিনি প্রেসক্লাবের সহযোগী সদস্য। বাংলদেশের অনেক নামীদামী মানুষ তখন প্রেসক্লাবের সহযোগী সদস্য ছিলেন।

এরপর আরো বেশ ক’বার তাঁর সাথে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, আড্ডা দেয়ার সুযোগ হয়েছে। তাঁর মনের দু:খের কথা জেনেছি। পাকিস্তান আমলে যথাযোগ্য সন্মান তিনি পাননি। বাংলাদেশ আমলেও তাঁর তেমন কদর ছিলোনা। ১৯৯০-র মধ্যভাগে আমি আমেরিকা চলে আসি। একসময় শুনলাম তিনি মনের দু:খে কলকাতা চলে গেছেন। বাংলাদেশের অপর বিখ্যাত সাঁতারু মোশাররফ হোসেন-র সাথে একসময় আমার যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা ছিলো। মোশাররফ হোসেন কিন্তু ব্রজেনদা-কে ভীষণ শ্রদ্ধা করতেন, তাঁর কাছে ব্রজেনদা’র অনেক গল্প শুনেছি। ১লা জুন ১৯৯৮ সালে ব্রজেন দাস কলকাতায় মারা যান। শেখ হাসিনা তখন প্রথম দফায় প্রধানমন্ত্রী, তিনি মোশাররফ হোসেনকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেন এবং ব্রজেন দাসের শেষকৃত্য  ঢাকায় যথাযোগ্য মর্যাদায় সম্পন্ন হয়। এ অংশটুকু আমার মোশাররফ হোসেন-এর কাছ থেকে শোনা, তিনি নিজে আমায় পুরো ঘটনা বলেছিলেন।

১৯৯৯ সালে ব্রজেন দাস মরণোত্তর স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার পান। ১৯৭৬ সালে তিনি জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেয়েছিলেন। পাকিস্তান তাঁকে ‘প্রাইড অফ পারফরমেন্স’ পুরুস্কারে ভূষিত করেছিলো। চ্যানেল অতিক্রম করা সাঁতারু ব্রজেন দাস। তিনি একনাগাড়ে ১৯৫৮, ৫৯, ৬০, ৬১-তে ৬বার ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেন্। ১৯৫৮ সালে ২৩টি দেশ অংশ নেয়, ব্রজেন দাশ পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং চ্যাম্পিয়ান হ’ন। ১৮ই আগষ্ট মধ্যরাতে ফ্রান্স থেকে যাত্রা শুরু করে পরদিন বিকালে ইংল্যান্ডে এসে পৌঁছান ব্রজেন দাস। একই বছর তিনি ইতালির ক্যাপ্রি থেকে নেপলস পর্যন্ত ৩৩কিলোমিটার দূর-পাল্লার সাঁতারে ৩য় স্থান অধিকার করেন। একবছরে, অর্থাৎ ১৯৫৮ সালে তিনি ৩বার ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেন্। ১৯৬১ সালে স্বল্পসময়ে মাত্র ১০ঘন্টা ৩৫মিনিটে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে তিনি বিশ্বরেকর্ড গড়েন। ব্রজেন দাস বিক্রমপুরের ছেলে, কুচিয়ামোড়া গ্রামে ০৯ই ডিসেম্বর ১৯২৭ সালে তাঁর জন্ম। ১৯৪৬ সালে ঢাকার কেএল জুবলী স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর কলকাতায় বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও বিএ পাশ করেন।  বাংলাপিডিয়া জানায়, ব্রজেন দাস প্রথম এশিয়ান যিনি ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেন এবং একমাত্র এশিয়ান যিনি ৬বার ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেন।

ওপেন-ওয়াটার-পিডিয়া জানায়, ১৯৬৫ সালে ব্রজেন দাস ‘ইন্টারন্যাশনাল ম্যারাথন সুইমিং হল অফ ফেইম’ -এ ‘সম্মানিত সাঁতারু’ (অনার সুইমার’) হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হ’ন। তিনি প্রথম এশিয় যিনি ১৯৫৮ সালে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেন এবং ৬বার অতিক্রম করে তিনি ‘কিং অফ চ্যানেল’ শিরোপা অর্জন করেন (১৯৬০-৭৪) এবং এই প্রক্রিয়ায় ৪টি রেকর্ড গড়েন। দ্রুততম সাঁতারু হিসাবে তিনি ৩বছর তাঁর শিরোপা ধরে রেখেছিলেন। ১৯৬১ সালে তিনি বৃটেনের রানী কুইন এলিজাবেথ এবং ১৯৬৪ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন-র সাথে সাক্ষাৎ করেন। ‘ফেমাস-বার্থডেস’ জানায় ব্রজেন দাসের পিতার নাম হরেন্দ্র কুমার দাস। ‘ওপেন-ওয়াটার-সুইমিং’ ক্যালিফোর্নিয়ার হান্টিংটন বীচের ওয়াওসা  (wowsa) অনলাইন মিডিয়ার সৌজন্যে ষ্টিভেন মুনাটনেস গত ২০জুন ২০২১ ব্রজেন দাস কন্যা সঙ্গীতা পাল-এর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে। বাবা দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ এ সংখ্যায় সঙ্গীতা পাল বলেন, ‘আমার বাবা সাঁতারের জন্যে পাগল ছিলেন’। ১৯৫৮ সালে বাবা ‘বিলি-বাটলিং ক্রস চ্যানেল ইন্টারন্যাশনাল সুইম’ থেকে একটি আমন্ত্রণ পান, জুনে ইংল্যান্ড পৌঁছান। এরপর তো সবটা ইতিহাস। [email protected];

সূত্র: বাংলাপিডিয়া, ওপেন-ওয়াটার-পিডিয়া, টিএনএস-দি নিউজ ও সানডে, উইকিপিডিয়া, ফেমাস বার্থডেস, চ্যানেল সুইপিং ডোভার, ওপেন ওয়াটার সুইমিং, ব্রজেন দাস-নিউজ এবাউট ইউএসএ,

 





সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন