সাহিত্য ও কবিতা

মরব না কেউ বিফলতার বিষম আবর্তে

মরব না কেউ বিফলতার বিষম আবর্তে

 

মরব না কেউ বিফলতার বিষম আবর্তে || বিজ্ঞানের হাত ধরে পৃথিবী আজ মানুষের হাতের মুঠোয়। আমরা গ্লোবাল ভিলেজের বাসিন্দা। গ্লোবাল ভিলেজ মানেই আধুনিক বিশ্ব। বিজ্ঞানের কল্যাণে আজকের আধুনিক বিশ্বে আমাদের জীবনের ভাঁজে ভাঁজে কেবলই গতিময়তা। তবে অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কার যুগে যুগে মানব সভ্যতাকে পেছনের দিকে টেনে রাখতে চেয়েছে। কিন্তু সমস্ত প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে মানুষ দুর্বার গতিতে সামনের পানে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই তো মানব–ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক বাণী উচ্চারণ করেছিলেন বাংলার মধ্যযুগের কবি বড়ু চণ্ডীদাস, “সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই”।

পাথরযুগে গোহাবাসী মানুষ যখন আবিস্কার করলো আগুন তখনই তারা বুঝতে পারলো কাঁচা মা্ংসের চেয়ে পোড়া বা রান্না করা মাংস কত উপাদেয়। অণ্ধকার গোহা থেকে আলোকিত গোহা কত সুন্দর আর সুবিধাজনক। প্রচণ্ড শীত থেকে বাঁচা কত সোজা। অথচ তাদের কাছেই তো সেই আগুনের চেহারা ছিল ভীষণ ভয়ানক। বজ্রপাতে গাছগাছালি পুড়ে ছাই হয়ে যেতো। অগ্নুৎপাতের ফলে মাটি ফুঁড়ে জলন্ত আগুনের ধারা বয়ে যেতো, ছড়িয়ে পড়তো। মানুষের কাছে এক দৈব দানবীয় শক্তির নাম ছিল আগুন। মানুষই তো সেই আগুনকে বশে আনলো।

খ্রিস্টের জন্মের পাঁচশ বছর পূর্বে পিথাগোরাসসহ কয়েকজন অনুসন্ধিৎসু দার্শনিক মত প্রকাশ করেছিলেন পৃথিবী সূর্যের একটি গ্রহমাত্র, সূর্যকে ঘিরে অন্য সকল গ্রহের মত পৃথিবীও ঘুরছে। এর প্রায় দুই হাজার বছর পরে কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও এই তথ্য সমর্থন ও প্রচার করার কারণে অন্ধ বিশ্বাসী আর কুসংস্কারাচ্ছন্ন শসাকগোষ্ঠী কর্তৃক তাদেরকে অমানবিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল। শুধু তাই নয়, ইতালির দার্শনিক ফিলিপ্পো ব্রুনো বলেছিলেন, এই পৃথিবীর মতো আরও গ্রহ আছে। পৃথিবী গোল। সূর্য এই মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয়। সূর্য একটি নক্ষত্র ছাড়া কিছুই নয়। এজন্য ব্রুনোকে ভয়ঙ্কর পরিণতির শিকার হতে হয়েছিল। তাঁকে রোমে জনসমক্ষে জীবন্ত পুড়িয়েই হত্যা করা হয়েছিল কিন্তু তাই বলে সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর যে আবর্তন তা কি থেমে গিয়েছিল?

মধ্যযুগে মানুষ বিশ্বাস করতো, যেকোনো অসুখ-বিসুখ কিংবা রোগ মহামারির কারণ মানুষের পাপ। তাদের ধারনা ছিল রোগ–ব্যাধি বা মহামারি হলো মানুষের পাপাচারে অতিষ্ঠ দেবতাদের এক ধরনের শাস্তি। তাই জরা-পীড়া ও মহামারিগ্রস্থ মানুষ তন্ত্রমন্ত্র, ঝাড়ফোঁক ও তাবিজকবচ ব্যবহার করে আরোগ্য লাভের চিন্তা করতো। সে যুগে সুইজারল্যাণ্ডের রসায়নবিদ ডা. ফিলিপ্রাস ঘোষণা করলেন, মানুষের রোগ মহামারির কারণ কোনো পাপের ফল বা অশুভ শক্তি নয়, রোগের কারণ জীবাণু বা ভাইরাস। পরজীবী এ জীবাণু বা ভাইরাসকে দমন করতে পারলেই মানুষ আরোগ্য লাভ করবে। তখনকার সময়ে অন্ধবিশ্বাসী আর কুসংস্কারে নিমজ্জিত মানুষজন সে সত্য মেনে নেয়নি। বরং তাকে বিচারের মুখোমুখী দাঁড় করিয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছিল। তিনি অবশ্য সুইজারল্যান্ড থেকে পালিয়ে জীবন রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু আজ আমরা কমবেশি সবাই জানি যেকোনো রোগ বা মহামারির মূল কারণ জীবাণু বা ভাইরাস।

বিজ্ঞানের নানা নেতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও মানুষ আজ বুঝে গেছে- যে কোনো রোগ বা মহামারির মূল কারণ কোনো না কোনো জীবাণু বা ভাইরাস। সমাজবিকাশের ধারাবাকিতায় বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে মানুষ একের পর এক আবিস্কার করে চলেছে বিভিন্ন টিকা বা প্রতিষেধক। এতে অকাল মৃত্যু থেকে রেহাই পাচ্ছে অসংখ্য প্রাণ।

আশির দশকের গোড়ার দিকে কলেরা রোগের ভয়াবহ ছোবল আমরা দেখেছি। কলেরাকে গ্রামাঞ্চলে মনে করা হতো ‘বলা’ বা ‘বল্লা’। সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে লাঠিতে আগুন জ্বালিয়ে মিছিল দিয়ে সেই ‘বলা’ বা ‘বল্লা’ তাড়াতে দেখেছি। দল বেঁধে মানুষ তখন হুজুরের নিকট থেকে তাবিজ পানিপড়া ইত্যাদি এনে রোগীকে পরাতো খাওয়াতো। তারপরও গ্রামের অনেক নারী-পুরুষ-শিশুকে অকালে জীবন দিতে হয়েছিল। তবে কিছুদিনের মধ্যেই কলেরা নিরাময়ের ঔষধ হিসেবে এলো ওরস্যালাইন। আধা লিটার পানির সাথে এক মুঠো গুড় ও তিন আঙুলের এক চিমটি লবণ। যা সকলেরই জানা। কলেরা এখনও আছে যার অন্য নাম ডায়রিয়া কিন্তু সেই ‘বলা’ বা ‘বল্লা’ নেই। বিজ্ঞানই কেবল সেদিনের সেই ভ্রান্ত ধারণা দূর করেছে।

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী যে মহামারি দেখা দিয়েছে তা করোনাভাইরাস রোগ বা সংক্রমণ নামে পরিচিত। কিন্তু এ ভাইরাস নিয়ে গুজবের অন্ত নেই। নানা জনের নানা ব্যাখ্যা। কেউ বলছেন, এ হলো সৃষ্টিকর্তার গজব। কেউ বলছেন, করোনাভাইরাস আল্লাহর সৈনিক। মুসলমানদের কিচ্ছু হবে না- এমনটিও অনেকে বলেছেন। তদুপরি কিছু সরকারি সিদ্ধান্ত অনেকাংশে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে সরকারি ছুটি ঘোষণা, লকডাউন, সভাসমাবেশ নিষিদ্ধ, চৈত্রসংক্রান্তি, নববর্ষ ইত্যাদি বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন থেকে বিরত থাকা সর্বোপরি ধর্মীয় উপাসনালয়ে জমায়েতের ব্যাপারে  বিধিনিষেধ খুবই সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। তদুপরি অন্ধবিশ্বাসীরা নানা যুক্তি দেখিয়ে মসজিদ স্বাভাবিক ভাবে পরিচালনার জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছে। তাদের ধারণা মসজিদে এবাদত বন্দেগি করলে করোনাভাইরাস বিদায় হবে।

বিজ্ঞানীরা যদিও এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসেরর কোনো প্রতিষেধক বা টিকা আবিস্কার কেরতে পারেননি তবে এই ভাইরাসের গতিবিধি, সনাক্তকরণ কিট ইত্যাদি আবিস্কার করে মানবজাতিকে সতর্ক করে দিচ্ছেন। এই সতর্কতার ফলে লাখো মানুষের প্রাণ বেঁচে যাচ্ছে।

বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে, কোভিড–১৯ হলো করোনাভাইরাসের এক নতুন প্রজাতি। এই রোগটি প্রথম চীনের উহান শহরে চিহ্নিত হয়েছিল। তখন থেকেই রোগটির নাম করা হয়েছিল করোনাভাইরাস রোগ ২০১৯ যা কোভিড–১৯ নামেও পরিচিত। করোনা থেকে ‘কো’, ভাইরাস থেকে ‘ভি’, এবং ‘ডিজিজ’ [রোগ] থেকে ‘ডি’ নিয়ে এর সংক্ষিপ্ত নামকরণ করা হয় কোভিড–১৯। এটি একটি নতুন ভাইরাস যা অতীতের সার্স ভাইরাস এবং কয়েক ধরনের সাধারণ সর্দি–জ্বর জাতীয় ভাইরাসের পরিবারভুক্ত। এ্ ভাইরাসের প্রতিষেধক বা টিকা আবিস্কারের কিছু আশাব্যঞ্জক খবর আমরা শুনছি। আমাদের বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরাও বসে নেই।  আশা করছি স্বল্প সময়ে বিজ্ঞানের হাত ধরেই করোনাভাইরাস রোগের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।

এই সমেয় আমাদের দেশের কতিপয় আলেম উলামা দেশের সহজ সরলপ্রাণ ধর্মভীরু মানুষকে নানা রকম বয়ান দিয়ে বিভ্রান্ত করা থেকে বিরত থাকুন। সম্ভব হলে স্বাস্থ্যবিধির ব্যাপারে সরকার যেসব নির্দেশনা জারি করেছেন তা প্রচার করুন। ইতোমধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় লাখো মানুষের অংশগ্রহণে জুবায়ের আহমদ আনসারীর জানাজা অনুষ্ঠিত হলো তার জন্য হয়তো আমাদেরকে চরম মূল্য দিতে হবে। মসজিদ উন্মুক্ত করে দিতে সিলেটের ৩১৩ আলেমের যে আহবান তাও আত্মঘাতি সিদ্ধান্তের শামিল। তাদের যুক্তি হলো “যেহেতু বিশ্বব্যাপি এ ব্যাপারে একমত যে, এই মহামারি আল্লাহর সৃষ্ট তাই সরকারের সতর্কতার পূর্বেই আমাদের মুসলমানদের করণীয় হল আল্লাহর কাছে ক্ষমা, ইস্তেগফার, তওবা ও তাঁর ইবাদাত বন্দেগির মাধ্যমে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করা”। আচ্ছা এই কঠিন দুর্যোগের সময়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা, ইস্তেগফার, তওবা ও তাঁর ইবাদাত বন্দেগি কি ঘরে বসে করা যায় না? করোনাভাইরাস মোকাবেলা একটি যুদ্ধ। এই যুদ্ধে সবাইকে যুক্ত হতে হবে। যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে এর বিরোধীতা করবে ইতিহাস তাদেরকে কখনও ক্ষমা করবে না। যেমন করেনি একাত্তরে যারা ধর্মকে পুঁজি করে বিরুধীতা করেছিল। তাই রাষ্ট্রযন্ত্রকে কঠোর হস্তে এদেরসহ বিভিন্ন অন্ধবিশ্বাসী পুরুহিত-বাবাদেরও দমন করতে হবে। পাশাপাশি সামাজিকভাবেও এদেরকে বয়কট করা দরকার। সর্বোপরি করোনাভাইরাস মোকাবেলার অংশ হিসেবে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এখনই সোচ্চার হতে হবে। তা না হলে আমাদেরকে ‘বিফলতার বিষম আবর্তে’ পড়ে মরতে হবে যে!

মহিদুর রহমান, কবি ও লেখক

 

 

সিবিএনএ/এসএস


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে cbna24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

 

সংবাদটি শেয়ার করুন