যাপিত জীবন

জাপানের যাপিত জীবন – ১১ | সুশীল কুমার পোদ্দার

ধা রা বা হি ক…….পূর্ব প্রকাশের পর

জাপানের যাপিত জীবন – ১১ | সুশীল কুমার পোদ্দার

আস্তে আস্তে জাপানের অপরিচিত পরিবেশ আমাদের সঙ্গ দেয়; আর দেয় আসঙ্গ।বৃক্ষলতা ফল, ফুলকে একান্ত আপন ভেবে ভালবেসে ফেলি। রাস্তার পাশে এক সান বাধানো নদী। কুল কুল করে বয়ে যায় পাথরে এক মৃদু সিঞ্চন তুলে, তার পাশে ছোট ছোট মাছ খেলা করে। আমি আর আগের মত বিস্ময় ভরা চোখ দিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে দেখি না। তবে বাড়ির অনতিদূরের সুউচ্চ পাহাড় আমায় সতত হাতছানি দিয়ে ডাকে। সমতলের মানুষ হবার কারণে পাহাড়ের প্রতি আমার এক দুর্বার আকর্ষণ।  ঘনঘোর যুদ্ধের সময় আমি গারো পাহাডের কতো চরাই উতরাই আপন মনে চোষে বেড়িয়েছি। দেখেছি সুউচ্চ পাহাড়ি চূরায় ডুবে যাওয়া রক্তিম সূর্য। সেই স্মৃতি নিয়ে  আমরা  প্রায় বিকেলে অথবা ছুটির দিনে পাহাড়ী আকা বাঁকা পথ পেরিয়ে চলে যাই কোন এক নিরুদ্দেশের পানে।  পাহাড়ী প্রকৃতিকে রঙ্গে ঢঙ্গে সাজিয়ে এখানে সেখানে দাড়িয়ে থাকে  ফলভারে আনত পারসিমন বৃক্ষ। নিজ হাতে তুলে নেই সেই ফল। পথ মাঝে দেখা মেলে কৃষকদের সাথে। পাহাডের ঢালে বিশাল সবজীর ক্ষেত,  বিশাল বিশাল শ্বেতশুভ্র মুলা, হরেক রকম শিম। ওরা আমাদের  সম্মতি নিয়ে হাতে তুলে দেয় এটা ওটা।  ওদের সরলতা আমাদেক বিমুগ্ধ করে। মুখে এক নিমীলিত হাসি টেনে ওদের অভিবাদন আমাদের আরও কাছে  ডেকে নেয়।

ধীরে ধীরে আমরা যুক্ত হয়ে পড়ি নানা রকম স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সাথে। ওরা বিদেশী পরিবারকে গায়ে পড়ে সাহায্য করে। বাড়িতে এসে গৃহস্থালী তৈজসপত্র দিয়ে যায়। আমার সন্তানের কস্ট হচ্ছে ভেবে আমাদের ঘরে প্রায় জোর করে নতুন এসি লাগিয়ে দেয়।  এইভাবে মানুষের দেওয়া জিনিসপত্র দিয়ে  আস্তে আস্তে ভরে ওঠে আমাদের সংসার। প্রথম প্রথম আমরা যারা না বুঝে নগদ অর্থ দিয়ে সংসারের এটা ওটা কিনেছি তারা আক্ষেপ করে মরি। আমাদের বিদেশীদের চরিত্রে চলে আসে এক ব্যাপক পরিবর্তন, বিশেষ করে বিনামূল্যে জিনিস প্রাপ্তির জন্য। কোথাও কোন গ্যারেজ সেল, বা প্রাপ্তিযোগের কোন খোঁজ পেলে আমরা হৈ হৈ করে ছুটে যাই,  মাঝে মাঝে নিজকে দারিদ্রতার নিম্ন স্তরে নামিয়ে দিয়ে।এ বিষয়ে এগিয়ে থাকে  agriculturist রা। জাপান যেমন গবেষণার নাম করে হাঙর শিকার করে তার ফিন দিয়ে স্যুপ খায়, তেমনি আগ্রিক্যালচারিস্টরা জমিতে ধান চাল, শাক সবজী সব পরিবারের গবেষণাগারে জমা করে। তবে সবাই করে তা নয়;  যাদের ভাগ্যে সে সুযোগ  জোটে না তারা বাদে প্রায় সবাই মুখিয়ে থাকে। এ সব ছাড়া আমাদের চরিত্র হননে বিরাট এক ভূমিকা রাখে গমি।

গমির অর্থ হলো আবর্জনা। উন্নতবিশ্বে সিটি কর্পোরেশন বিভিন্ন প্রকার গৃহস্থালী বর্জ্য নিষ্কাশন করার জন্য  বিভিন্ন দিন নির্ধারণ করে দেয়। তার মধ্যে মাসের একটা বিশেষ দিন নির্ধারিত হয় বড় বড় জিনিস ফেলার জন্য,   যেটাকে ওরা বলে সোদাই গমী। ঐ দিন বিদেশী, বিশেষ করে আমাদের মত বাঙ্গালীদের মনে জেগে ওঠে এক উৎসবমুখর উত্তেজনা। অনেকে উত্তেজনায় অনেক দূর হতে সাইকেল চালিয়ে ছুটে আসে। সন্ধ্যার আলো জ্বলে উঠতেই  জাপানিজরা ফেলতে সুরু করে টেলিভিশন, টেপরেকর্ডার, কম্পিউটার, বাই সাইকেল, চেয়ার টেবিল সহ নানা রকম অপ্রয়োজনীয় জিনিস পত্র।  হাতে টর্চ লাইট নিয়ে ছুটে আসে হান্টার। মুহূর্তে উঠিয়ে নিয়ে যায় প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় জিনিস পত্রাদি।  বাই-সাইকেলের সাথে দড়ি দিয়ে বেধে, এখানে সেখানে ঝুলিয়ে, জীবনকে বিপন্ন  করে কোনমতে সাইকেল চালিয়ে ফিরে যায় অভিযাত্রী  তার আপন কুলায় । আস্তে আস্তে তার ঘর ভরে ওঠে। এক এক ঘরে একাধিক ফোন, একাধিক টেলিভিশন শোভা পায়। ডাইনিং টেবিলের পাশে শোভা পায় ভিন্ন ভিন্ন আকৃতির চেয়ার। রঙচটা সোফাতে হেলান দিয়ে আমরা ভেবে চলি আগামী মাসের সোদাই গমীর কথা।

সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। লাইনে নামতে দেরী হবার কারণে আমি আক্ষেপ করে মরি।  আমিও সাইকেল নিয়ে রাতের অন্ধকারে ভাগারের মাঝে নিজকে মাঝে মাঝে আবিষ্কার করি। মাঝে মাঝে পুরাতন সাইকেল ফেলে দিয়ে অপেক্ষাকৃত ভাল আরেকটা উঠিয়ে নিয়ে আসি।  মাঝে মাঝে বেশ কিছু জাপানিজের দেখা মেলে। ওরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। পুরাতন দোকানের ব্যবসায়ী । ওরা আমাদের সাথে প্রতিযোগিতা না করে আরো অধিক বড় জিনিস – ফ্রিজ, আলমারি, বৃহদাকার টিভি গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়। আমাদের গাড়ি না থাকার কারনে আমরা  ওদের পানে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। আস্তে আস্তে এই পুরাতন জিনিস উঠিয়ে নেওয়া আসা নেশায় পরিণত হয়। নির্দিষ্ট দিনে সকাল থেকেই আসতে থাকে টেলিফোন আমাদের দেশীদের কাছ থেকে। কোথায় কখন আমরা রেকী করবো তার পরিকল্পনা চলে। আমরা অনেকেই এই নেশায় আসক্ত হয়ে পরি। তবে এ নেশার কথা অনেকেই মুখ ফুটে  বলে না। প্রকাশ হয়ে পরে যখন কেউ  ঐ সব মহার্ঘ জিনিস পত্র  দেশে নিয়ে যেতে চায়। এয়ার পোর্টে বাড়তি ওজনের পয়সা গুণতে যখন কোন বাঙ্গালী ছাত্র অপারগতা প্রকাশ করে,  তার সেন্সেই এর সামনে যখন তার লাগেজ খোলা হয়,  বেড় হয়ে আসে ফেলা দেওয়া এক জাতীয় একাধিক  জিনিসপত্রের সম্ভার, তখন তাকে বিদায় জানাতে আসা দেশী বন্ধুরা নীরবে মাথা নত করে থাকে। সেন্সেই সহ অনেকের মুখে ভেসে ওঠে বিদ্রূপের নীরব হাসি।

 

জাপানের যাপিত জীবন – ১১ | সুশীল কুমার পোদ্দার ,  ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।
লেখকের স্মৃতিচারণের অন্যান্য পর্বগুলি দেখতে হলে 
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ১ |  যুদ্ধের স্মৃতি কথা ২ |  যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৩ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৪ |  যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৫ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৬ |  যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৭ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৮ | যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৯ |
স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ১ | স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ২ | স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ৩ | স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ৪ | ,
জাপানের যাপিত জীবন – ১ |জাপানের যাপিত জীবন – ২ জাপানের যাপিত জীবন – ৩ জাপানের যাপিত জীবন – ৪ জাপানের যাপিত জীবন – ৫ জাপানের যাপিত জীবন – ৬ জাপানের যাপিত জীবন – ৭ জাপানের যাপিত জীবন – ৮ জাপানের যাপিত জীবন – ৯

এস এস/সিএ


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন