ফিচার্ড লেখালেখি

অতীতের ডায়েরী থেকে – একজন বিনয়ের কথা | সুশীল কুমার পোদ্দার

গ্রাফিকঃ সদেরা সুজন

অতীতের ডায়েরী থেকে – একজন বিনয়ের কথা | সুশীল কুমার পোদ্দার

সময় আপন গতিতে এগিয়ে চলে। প্রকৃতি তার রং বদলায়। শীর্ণ মগরা দুই ধার প্লাবিত করে হঠাৎ করে প্রমত্তা হয়ে ওঠে। আমার ঘুরে বেড়ানোর পরিধি সীমিত হয়ে পড়ে। নেত্রকোনার পাবলিক লাইব্রেরীর আমায় দেয় সঙ্গ ও আসঙ্গ। মাঝে মধ্যে স্মার্ট হবার জন্যে সহকর্মীদের সাথে অফিসার’স ক্লাবে যাই। পদ মর্যাদায় স্থুল, চেহারায় ততোধিক স্থুলকায় অফিসাররা সর্ট পড়ে টেনিস খেলেন। আমার কাছে কেমন যেন হাস্যকর মনে হয় । স্মার্ট হওয়া আমার আর হয়ে ওঠেনা।

প্রতিদিনের নিয়মে অফিসে যাই। প্রতিদিন সকালে সবাই জমায়েত হই জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে । ডিসি আমাকে সহ হিন্দু সহকর্মীদের কেন যেন বাবু বলে সম্বোধন করেন। প্রথম প্রথম কিছু মনে করিনি । সময় বয়ে যায়। আস্তে আস্তে এ সূক্ষ্ম বিভাজন আমার মনের আয়নায় একটা চির কেটে ফেলে। নিজকে কেমন যেন বহিরাগত মনে হয়। তবুও সময় পেলে আরও অন্যান্য কর্মকর্তাদের মতো ডিসির বাসভবনে যাই। মাঝে মাঝে তিনি হয়তো ভুলে যান আমার ধর্মীয় পরিচয়। অত্যন্ত আপন করে নেন। ঘুরে দেখান বিশাল বাগান বাড়ি। গাছ থেকে পেঁপে কেটে নিজ হাতে খাওয়ান। জীবনের নিগুঢ় কথা বলে ফেলেন অকপটে। আমি মানুষের তাৎক্ষনিক সরলতায় বিমুগ্ধ হই । মানুষের চোখের জল আমায় ভীষণ বিচলিত করে। কখনো ভেবে দেখিনা সরলতার পেছনে কপটতা লুকিয়ে আছে কিনা, চোখের ঐ অশ্রুজলের পেছনে আছে কিনা কোন নির্মম উপহাস। তাই আমি অভিভূত হয়ে পড়ি মানুষটার এ সরলতায় । আরো অভিভূত হই তার সততায়। ভ্রান্তি কাটতে সময় লাগেনা। ভীষণ ভাবে দংশিত হই। তবু আমার ব্যক্তিত্বের এ বিশেষ দিকটাকে আমি আজ অবধি লালন করে যাই।

সময়ের সাথে সাথে পরিচয় হয় জেলার আরো অনেক কর্মকর্তার সাথে যারা পান ও সিগারেটের ভাষায় কথা বলেন। মানুষের কাছ থেকে কখনো কৌশলে কখনো অকপটে চেয়ে বসেন পান খাবার পয়সা। আমি চরিত্রে প্রচণ্ড অন্তর্মুখী তাই শিখতে চেষ্টা করি মানুষকে সহজে আপন করে নেবার আচরণ শৈলী, কথা বলার শৈলী। এক দিন এমনি এক পান খাওয়া ??? সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেম আপনি এতো পান খান কেন? উনি হেসে বললেন – সরকারি চাকুরী পাবার পর থেকেই পান খাওয়া শুরু করেছি। পান খাওয়া একটা আর্ট। পানের একটা নিজস্ব ভাষা আছে যেটা বুঝে নিতে হয়। সত্যি আমি অযোগ্য – এ ভাষাটা রপ্ত করতে পারিনি।

মন না বসলেও jurisprudence পড়তে শুরু করি। টেবিলে জমা হতে থাকে ফাইল। আমার ইক্তিয়ারে অনেকগুলো trespass কেস। স্থানীয় একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি বেশ কিছু জায়গা দখল করে আছেন। শুনানির ডেট পড়েছে। হঠাৎ একদিন সেই গণ্যমান্য ব্যক্তি আমার অফিসে উপস্থিত। তিনি সালাম দিয়ে চেয়ার টা টেনে নিয়ে বসলেন। খুব শান্ত ভাবে বলে গেলেন ‘ ম্যাজিষ্টেট সাহেব শুনলাম আপনার আন্ডারে আমার কিছু কেস আছে? খুব ভালো করে দেখবেন। আপনি নতুন এসেছেন তাই বোধ হয় আমার কথা শুনেন নি। আপনার পিয়নের কাছে আমার পরিচয় জেনে নিবেন। ??? সাহেব আমার গরীব খানায় পা রাখেন। একদিন সময় করে চলে আসবেন।’ হুমকি ও আসন্ন বিপদের কথাটা সহকর্মীদের সাথে শেয়ার করলাম। কেউ বললো ভয় পেও না ; কোপায়ে দিবা (মনে হয় পাবনার স্থানীয় কোন অভিব্যক্তি )। আমার কোপানোর আগেই কেস টা স্থানান্তরিত হলো।

এক বিকেলে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ে। বৃষ্টি আমায় কেন যেন বড় বিষণ্ণ করে দেয়। আমার জীবনের সমীকরণকে আরো জটিল করে তোলে। মাঝে মাঝে মনে হয় ভুল বাস ধরে অচেনা গন্তব্যে এসে পড়েছি। মাথায় বৃষ্টি নিয়ে ফিরে আসি সার্কিট হাউসে। দরজার কাছে দাড়িয়ে আছে আমাদের বিনয় (ছদ্য নাম) । ও বড় ভালো ছেলে, বড় বিনয়ী। দারিদ্রতা ওকে তেমন এগুতে দেয়নি। বিএ পাশ করে অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে একটা পিয়নের চাকুরী পেয়েছে। ও যে কার পিয়ন তা আমি জানিনে। কখনো সার্কিট হাউসে, কখনো ডিসি, কখনো এনডিসি সবার ফয়-ফরমাশ খেটে যায় মাথা নত করে। যখন ওর জীবনটা দূর্বিসহ করে তোলে আমাদের মতো মনিবের দল, ও ছুটে আসে আমার কাছে। কখনো বসে না। দরজা ধরে বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি ওর ব্যথিত হৃদয়ে স্নেহের পরশ দিয়ে ওকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করি। ওকে আমি বড় বেশী ভালবেসে ফেলি। ওকে আমি আমাদের মতো একজন বিসিএস কর্মকর্তা হিসেবে দেখতে চাই। ও আমার কাছে সময় পেলেই চলে আসে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করতে । ও application form জমা দেয়। খবরটা কেমন করে যেন রাষ্ট্র হয়ে যায়। মনিবের দল ওকে নিয়ে ক্রমাগত উপহাস করে। বিনয় সমস্ত বিদ্রূপকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যায়। ও যেন পরীক্ষা দিতে না পারে তার জন্যে ওকে দিনান্ত পরিশ্রম করায় এক পদ মর্যাদাবান অফিসার। আমি সর্বকনিষ্ঠ। আমার যে কিছুই করার নেই শুধু অনুপ্রেরণা দেয়া ছাড়া । আজ ওর প্রিলিমিনারী পরীক্ষা । ওর তো আজই ঢাকা যাবার কথা। এতো তাড়াতাড়ি ফিরে এলো কি করে। তবে কি??? আমি আর ভাবতে পারিনে। বিনয় আজ দাড়িয়ে আছে স্তব্ধ হয়ে। আমাকে দেখেও ও দেখলো না। জানালোনা কোন অভিবাদন। আমার বুঝতে আর বাকি রইলো না। ওকে পরীক্ষা র জন্য যেতে দেওয়া হয়নি। আমি কোন ভাষায় ওকে সান্ত্বনা দেব! আমার কথায় প্রলুব্ধ হয়ে কতো কষ্টে করে ও পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল। এমনটা ঘটবে আমি কেন বুঝতে পারিনি! আমিতো আমার ঐ সংকীর্ণ হৃদয় সহকর্মীকে (এখন সম্ভবত ডেপুটি সেক্রেটারী) ভালভাবেই চিনি। তাকে অনেক বার ওকে নিয়ে বিদ্রূপ করতে দেখেছি। কিন্তু ভাবতে পারিনি মানুষ এতো হৃদয়হীন হতে পারে, নামতে পারে এতো নীচে! আমি ওর কাঁধে আস্তে করে হাত রাখি। ও আর পারলো না নিজকে ধরে রাখতে। চোখ ভরা জল নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো বৃষ্টি ভেজা বিষণ্ণ প্রকৃতির দিকে।

চলবে…

অতীতের ডায়েরী থেকে – একজন বিনয়ের কথা | সুশীল কুমার পোদ্দার ,  ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

 


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন