লেখালেখি

অমিত পর্ব – ১১   |||| সুশীল কুমার পোদ্দার


পূর্ব প্রকাশের পর….

অমিত পর্ব – ১১   |||| সুশীল কুমার পোদ্দার

গেরুয়া আর আলখাল্লা পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে আছে। ওরা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে  উঠছে শারীরিক জটিলতা থেকে। তবে আগের মতো আর নেই। ভীষণ বিমর্ষ,  ভীষণ চুপচাপ হয়ে গেছে ওরা। ওরা কেউ তেমন অপ্রয়োজনে কথা বলেনা। শুধু  নিঃশব্দে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে উদাস আকাশের পানে । ওরা জেনে গেছে ওদের  অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা। এমন পরিণতির কথা আলখাল্লা ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি।  গেরুয়া হয়তো কিছুটা ধারনা করতে পেরেছিল। তাইতো সে সেদিন হলরুমে অচেতন হয়ে পড়েছিল অনিশ্চিত জীবনের ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে। সেদিন প্যারামেডিকরা ছুটে এসেছিল। জ্ঞান ফিরানোর অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ওকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। আলখাল্লা সারাক্ষণ  গেরুয়ার পাশে ছিল। ওকে হাসপাতালে নেবার পরেই ও সেদিন ফিরে এসেছিল হল রুমে।

দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার পর ওর নাম আসে। ও ইমিগ্রেসন কর্মকর্তার সামনে বসে ছিল সহজ ভাবেই। ও ভাবতে পারেনি তার অতীত জীবনের সমস্ত অপকর্মের ইতিহাস তার চোখের সামনে। অবৈধ উপায়ে অর্জিত সমস্ত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি তার বাজেয়াপ্ত হয়েছে। দেশ থেকে আবেদন এসেছে বিদেশে বিভিন্ন সেক্টরে লগ্নিকৃত অর্থ ও সম্পদ দেশে ফিরিয়ে দেবার জন্য। ইমিগ্রেসন অফিসার তাকে সে কথা জানাতেই আলখাল্লা মুষড়ে পড়ে। আলখাল্লাকে আরও বলা হয় বিদেশে পাচারকৃত অর্থের ইতিবৃত্ত  জানাতে। আলখাল্লা আমতা আমতা করেছিল। পাশে দাঁড়ানো সেক্যুরিটি অফিসার তাকে বলেছিল সে যদি তাদের সাথে সহযোগিতা না করে তবে ডিপ মাইন্ড রিডিং প্রযুক্তির সাহায্যে তার মনের মাঝে লুকানো তথ্য উদ্ধার করা হবে। তার নাজুক শরীর সেই অপ্রিয় সত্য সহ্য করতে  পারেনি। ডায়াবেটিক, উচ্চ রক্তচাপ সহ শরীরের নানাবিধ জটিলতা সেদিন একযোগে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল।

তবে অমিত সেদিন পেয়েছিল অভাবনীয় সম্মান।   বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর সব দেশ তার জন্য দুয়ার  খুলে  দিয়েছে।  কানাডার সমাজ কল্যাণ দপ্তর অমিতকে উপদেষ্টা করে  প্রাথমিক ভাবে আলখাল্লা ও  গেরুয়ার দেখভাল করার জন্য বিশেষ অনুমতি দিয়েছে। আলখাল্লার শরীরে কৃত্রিম প্যাঙ্ক্রিয়াস স্থাপন করা হয়েছে।  বাইশ শতকের পৃথিবী  আজ ডায়াবেটিক -১  ও ডায়াবেটিক -২ এর মতো নীরব ঘাতক মহামারীকে জয় করেছে।  ন্যানো টেকনোলজির  অভূতপূর্ব বিকাশ আজ অতিশয় ক্ষুদ্র  রোবট তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। আলখাল্লার শরীরের রক্তে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে এমনি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রোবট – ওরা প্রতিনিয়ত শরীরের রক্তচাপ, রক্তের শর্করা মেপে অগ্নাশয়কে খবর পাঠাচ্ছে। আলখাল্লা যুগান্তরের বয়ে বেড়ান ঘাতক ব্যমো থেকে মুক্তি পেলেও  গেরুয়ার সাথে ওর চলছে মানসিক চিকিৎসা।  ওদের চিকিৎসার ফলাফলের উপর নির্ভর করছে ওদের ভবিষ্যৎ। ওদের কোন দেশ পুনর্বাসনের জন্য নিতে যেহেতু আগ্রহী নয়, তাই সিদ্ধান্ত হয়েছে ওদের সন্মতিতে  ওদের ভিন্ন গ্রহতে বসতি স্থাপনের জন্য পাঠান হবে। তবে ভিন্ন গ্রহে মনুষ্য বসতির স্থাপনে তাদেরই পাঠান হবে যাদের থাকবে উৎকৃষ্ট মানবিক গুণাবলী, ঘৃণার চেয়ে ভালবাসায় বিশ্বাসী, হিংসা, ও অতিরিক্ত লোভ থেকে বিমুক্ত  নিয়ন্ত্রিত জীবনাচারণে বিশ্বাসী মানুষ। গেরুয়া ও আলখাল্লার অতীত জীবনাচারণের এই বিশেষ ত্রুটিগুলো ঝেড়ে ফেলতে, ওদের মস্তিষ্ক নতুন করে re-wired করতে ওদের সাথে কাজ করে চলেছে  বেশ কিছু নিউরো সাইকোলজিস্ট।

অমিত একসময় যাদেরকে ঘৃণা করতো,  নিজকে সরিয়ে রাখতো  অস্পৃশ্য ভেবে, আজ ওইসব অর্থলিপ্সু অমানবিক মানুষগুলোকে কাছ থেকে দেখে তার আর ঘৃণা জাগে না। ওদের জন্য জাগে এক গভীর সহানুভূতি। আজ  ওদেরকে  ওদের অপকর্মের জন্য আর একক অপরাধী মনে হয় না। ও নিউরো সাইকোলজিস্টদের সাথে কথা বলে জেনেছে ওদের এমন অস্বাভাবিক অর্থ লিপ্সার পেছনে রয়েছে অনেক অনুঘটক। সমাজ এবং রাষ্ট্রও এরজন্য কম দায়ী নয়।  মানুষ অপরাধ করে, অন্যের অর্থ আত্মসাৎ করে সুখের পথ খোঁজে,  আবার অন্য কেউ সামান্য অপরাধ করেও আত্মদহনে দগ্ধ হয়।  কে সেই অনুঘটক যা মানুষকে অপরাধ করতে প্ররোচিত করে? অমিত এমনি গভীর সত্য  অনুসন্ধানে  নিজকে নিয়োজিত করেছে ।

অমিত আজ জানতে পেরেছে এর জন্য দায়ী মানুষের রহস্যময় মস্তিষ্ক । প্রতিটি  মানুষ কাম, ক্রোধ, লোভ লালসা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। আস্তে আস্তে তার ফ্রন্টাল লব বিকশিত হয়, সে তার মানবিক গুণাবলি, সাদা -কালোর, পাপ-পূর্ণের পার্থক্য বুঝতে পারে। শিক্ষা,  সামাজিকতা, এবং সর্বোপরি পরিবারের সংস্কারের কাছ থেকে সে আস্তে আস্তে শিখে ফেলে কার্য-কারণ সম্পর্ক,  অন্যয় করলে তার পরিণাম। বংশ পরম্পরা থেকে প্রাপ্ত  মূল্যবোধ  তার শিক্ষার সাথে  যুক্ত হয়ে মস্তিষ্ক  তার চিন্তা চেতনার একটা নিজস্ব প্যাটার্ন তৈরি করে। মানুষ সেই প্যাটার্নের বাইরে গেলেই আমাগডীলা  তার পুরাণ স্মৃতি ঘেঁটে,  কার্য-কারণ সম্পর্কের তথ্য ভাণ্ডার ঘেঁটে  তাকে সতর্ক করে দেয় – যুদ্ধ বা পলায়নের সঙ্কেত দিয়ে ।  কিন্তু  অর্থ, প্রতিপত্তি, ক্ষমতা  অথবা শারীরিক কোন প্রতিবন্ধকতা আমাগডীলাকে হাইজ্যাক করে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে।  আবার কারো কারো মস্তিষ্ক  এমন ভাবে  wired  যা অতি সহজে  অপরাধ করার জন্য প্ররোচিত করে ।  হয়ত আলখাল্লা, গেরুয়া এমনি কোন অনুঘটকের স্বীকার। ওদের মস্তিষ্ক হয়তো ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়েছে সমাজ বা রাষ্ট্রের আনুকূল্য পেয়ে !

কেমন করে একজন বিবেকবান মানুষ আস্তে আস্তে অর্থলিপ্সু,,  বিবেকহীন হয়ে যায়,  কে ওদের প্ররোচিত করে এমন কাজে, কেমন করে বাইশ শতকের চিকিৎসা বিজ্ঞান  অপরাধীদের মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে পরিবর্তন ঘটিয়ে স্বাভাবিক, বিবেকবান মানুষে পরিবর্তন করে – সে উত্তর জানতে  ওর মনটা আঁকুপাঁকু করে … চলবে…

 

অমিত পর্ব – ১১ |||| সুশীল কুমার পোদ্দার ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।

 

সিএ/এসএস


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন